শুভশ্রী মৈত্র, কলকাতাঃ
ঘোড়া ছিল কার, হবে কার ? এখন এই খেলাই চলছে বাংলার রাজনীতিতে। একদিকে ভাঙছে তৃণমূলের সাজানো ঘর, আর সেই ঘর-ভাঙা ঘোড়াদের নিয়ে নিজেদের ঘর সাজাচ্ছে বিজেপি। ভোটের আগে শাসকদলকে যতটা সম্ভব দুর্বল করে দিয়ে সেই ফাঁক গলে কি করে ঢুকে পড়া যায় বাংলায় সেই চেষ্টাতেই উঠেপড়ে লেগেছেন দিলীপ-কৈলাসরা।
ভোটের আগে বা পরে ভালো অংকের টাকার বিনিময়ে একটি দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা চলে যাচ্ছেন অন্য দলেএবং তাঁদের সমর্থনে সরকার গড়া হচ্ছে, এই দৃশ্য আমাদের দেশে অপরিচিত নয় তবে এই ‘ঘোড়া কেনাবেচা’ সংস্কৃতি মূলত গোবলয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পশ্চিমবঙ্গ এতদিন এই ‘ঘোড়া সংস্কৃতি’-র অংশ ছিল না, বাংলার ইতিহাসে এই ট্রেন্ড একওবারেই অচেনা।
সংখ্যা বলছে এখনো পর্যন্ত তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়েছেন পঞ্চাশের বেশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। যদিও এর মধ্যে পঞ্চায়েতের হিসেব ধরা হয়নি। বিধায়ক, সাংসদ, প্রাক্তন বিধায়ক, পুর প্রতিনিধিরাই শুধু আছেন এই পঞ্চাশ জনের মধ্যে। বিজেপি থেকে তৃণমূলে আসার সংখ্যাটা কম হলেও একদম শূন্য নয় তবে ফারাক হলো, তাঁদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি কম। কিছু বিশিষ্ট নেতানেত্রীরা বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাঁকুড়ার সাংসদ সৌমিত্র খাঁ-এর স্ত্রী সুজাতা খাঁ।
তবে মূল ট্রেন্ডটা দেখা যাচ্ছে, কতকটা যেভাবে পুরনো দিনের কলকাতার কোনও কোনও বাসের কন্ডাক্টর বাস থামিয়ে প্রায় মানুষের দরজায় কড়া নেড়ে ডেকে ডেকে এনে বাসে তুলতেন, ঠিক সেভাবে বিজেপি নেমে পড়েছে হাতে ‘অফার লেটার’ নিয়ে। ওদিকে তৃণমূলের নেতাদের একাংশও টোপ গেলবার জন্য হাঁ করেই ছিলেন। একসময়ে সারদা, নারদা, টেট, আপার প্রাইমারি, উমপুনে যারা লাগামছাড়া দুর্নীতি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের গায়ে কালি লাগিয়েছেন, তাদের মধ্যেই দল ছাড়ার হিড়িক বেশি।
আরও পড়ুনঃ নন্দীগ্রামে গুলি চালনার ঘটনায় অধিকারী পরিবারই ষড়যন্ত্রকারীঃ মমতা
এখন হঠাৎ তাঁদের মনে হয়েছে যে দলে থেকে মানুষের জন্য কাজ করা আর সম্ভব হচ্ছে না, কারোর কারোর আবার শ্বাসরোধ হয়ে আসছে! তাই 5G স্পিডে ডেটা ট্রান্সফার করবার মত গতিবেগে তৃণমূল সাফ করে জনপ্রতিনিধি ও নেতানেত্রীরা ট্রান্সফার হয়ে এখন বিজেপিতে।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নানের কথায়, অন্য রাজ্যে টাকার খেলা হলেও এমনটা মনে করার কারণ নেই যে এরাজ্যে টাকা ছাড়াই সব দল বদল করে বিজেপিতে যাচ্ছে। দুর্নীতির মামলা এবং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাত থেকে বাঁচতেই সব দল বদল করছে। ইডি, সিবিআইয়ের ভয়ে তৃণমূলের বিধায়ক, মন্ত্রীরা দল ছাড়ছেন। সেই সঙ্গে কেউ কেউ টাকাও পেয়েছেন বিজেপির থেকে
আরও পড়ুনঃ এক যুবককে সপাটে চড় কষিয়ে বিতর্কে টালিগঞ্জের বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়।
এ প্রসঙ্গে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, পদের লোভেও কেউ কেউ বিজেপিতে গিয়েছেন। তৃণমূল কংগ্রেসে থাকার সময় যাঁরা প্রচুর টাকা কামিয়েছেন বেআইনিভাবে। সেই টাকাই বাঁচাতে এখন বিজেপিতে আশ্রয় নিচ্ছেন। সেই সঙ্গে সিবিআইয়ের ভয় তো রয়েছেই। ইদানিংকালে যাঁরা বিজেপিতে গিয়েছেন, তাঁরা টাকা বাঁচাতে এবং তল্লাশি থেকে বাঁচার জন্যেই দল বদল করেছেন। সঙ্গে উপরই পাওনা হিসেবে বিজেপিতে গিয়ে মোটা অঙ্কের টাকাও পেয়েছেন অনেকেই।
আর রাজ্যের ভোটাররা বলছেন, যে জনপ্রতিনিধিরা মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ করবেন বলে ভাবা হয়েছিল, তাঁরা আসলে রাজনীতির ময়দানকেও টাকা রোজগারের রাস্তার বাইরে আর কিছুই ভাবছেন না? একইসঙ্গে সিনেমা ও সিরিয়ালের নায়ক নায়িকাদের এই রাজনীতিতে যোগদানের হিড়িক, সকলেরই আবার মানুষের জন্য জন্য কাজ করার কি অকুলিবিকুলি! আর বিজেপিতে যোগ দেওয়ার দুই দিনের মধ্যে ভোটের টিকিট মিলছে, এমন ‘উইন উইন’ প্রজেক্ট কি বারেবারে আসে!
সাধারণ ভাবে যে কোনও দলীয় রাজনীতিতে যোগদানের পূর্বশর্ত হল সেই রাজনীতির দর্শন বিষয়ে চর্চা, পথে নেমে কাজ করা। বামপন্থা বা ডানপন্থা হোক অথবা অতিদক্ষিণপন্থা, যে কোনও নীতিকে টিকিয়ে রাখতে গেলে দরকার পড়ে ব্যক্তিগত সততা, ত্যাগ, আদর্শ। বিজেপির দীনদয়াল উপাধ্যায়রা সারাজীবন নাকি শক্ত মেঝের উপর শুয়েছেন, যাতে ভোগ তাঁদের গ্রাস না করতে পারে।
অথবা একদা সংঘপ্রধান সুদর্শন, যিনি কপর্দকশূন্য অবস্থায় মারা যান। কিন্তু বর্তমানের এই কোটি কোটি টাকার খেলা বিজেপির আদর্শগত ভিতকে ধসিয়ে দিতে বাধ্য। স্বল্পদিনের লাভের বিনিময়ে তাঁরা নিজের দলেরই দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে দিয়ে যাচ্ছেন না তো? এই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আড়াআড়ি ভাগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে গেরুয়াশিবিরে, আদি এবং নব্য।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584