এক্সক্লুসিভঃ পার্বতীর ‘কুসুম কাহিনি’

0
872

নবনীতা দত্তগুপ্ত, বিনোদন ডেস্কঃ

“হিজরা একটা পেশা। সব রূপান্তরকামীরা তালি বাজায় না, হিজরা হয় না৷ হতে চায় না৷ তারাও চায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিকা কিংবা অভিনেত্রী হতে। আমিও চাই একজন অভিনেত্রী হতে।” কথাগুলো নিউজ ফ্রন্টকে জানালেন রূপান্তরকামী অভিনেত্রী কুসুম সামন্ত। শুনলেন নবনীতা দত্তগুপ্ত।

Actress Kusum Samata | newsfront.co

জন্মের সময় বাপ-মা নাম রেখেছিলেন বিশ্বজিৎ সামন্ত। বিশ্বজিতের মনের মধ্যে বছর তিন-চার থেকেই বেড়ে উঠতে থাকে কুসুম সত্তা। অর্থাৎ নারী সত্তা। ছোটবেলায় শখ হত মেয়ে সাজার। মায়ের শাড়ি-গয়না গায়ে চড়াতে ভাল লাগত। ক্রিকেট ফুটবল টানেনি কখনও। টানত কিতকিত, পুতুল খেলা আর রান্নাবাটি।

ছোটবেলায় দাদাদের নয়, কুসুম। ফলো করতেন দিদিদের। কাজল, নেলপালিশ পরে স্কুলে গিয়ে মাস্টারদের কাছে বকুনিও খেয়েছেন। ক্লাস সিক্স-সেভেন থেকে প্রেমের চোখে দেখতেন ছেলেদের, মেয়েদের নয়। ছোটবেলায় মা-দিদিরা মেয়ে সাজাটাকে মজা হিসেবে নিতেন। তাঁরাও সাজাতেন ভাইকে মেয়েদের মতো করে। কিন্তু বেশিদিন নয়।

Kusum Samata | newsfront.co

পাড়ায় অনেকে তাকে হাফ লেডিস, বৌদি, ছক্কা বলে ডাকত। কষ্ট পেতেন কুসুম। তবু মনের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন এক নারীকে। স্কুলজীবনে নিজের মতো আরও কয়েকজনকে পেয়ে একটু স্বস্তি মিলেছিল, যে সে একা নয় এরকম আরও অনেকে আছে যারা তার মতোই পুরুষ হয়ে পুরুষকেই মন দেয়। কোনও পুরুষ বন্ধুর কাছে নিজেদের কথা জানাতে গেলে তারা হেসেই উড়িয়ে দিত। এভাবেই কেটেছে টেলিভিশনের পার্বতী থুড়ি কুসুম সামন্তর স্কুলবেলা।

কুসুম নামটা অবশ্য তিনি নিজে নিজেকে দেননি। বিশ্বজিৎ নাম নিয়েই বেঁচেছিলেন। নামটা দিয়েছিলেন রূপান্তরকামী অধ্যক্ষা ডঃ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়।

Kusum in Phirki | newsfront.co

স্কুলে পড়াকালীন নাটক করতেন কুসুম। হাইস্কুলের পালা চুকিয়ে শুরু করেন যাত্রা। সেখানে সেই বৃহন্নলার চরিত্রই দেওয়া হত তাঁকে। কেউ অন্য কোনও পেশার চরিত্র দেয়নি কখনও। তখন থেকেই মঞ্চে শাড়ি, চুড়ি পরে অভিনয় করতেন কুসুম। নিজের ভাল লাগা অসীম হলেও তাঁকে নিয়ে দলে অনেক সমস্যা তৈরি হয়।

আরও পড়ুনঃ এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউঃ আমি ত্রিকোণ প্রেমের প্রেমিকা হতে চাই- সুজি ভৌমিক

যাত্রাদলে ছেলেরা মেয়ে সেজে অভিনয় করে। আর সেখানে কুসুম নিজে মানসিকভাবে একজন মেয়ে। তিনি নিজেকে পুরুষ মনেই করতেন না কখনও। তাঁকে নিয়ে দলে সমস্যা হলে বাবা-মা আপত্তি জানান যাত্রা করাতে।

Yatra | newsfront.co

বলেন, পুরুষের কোনও কাজই করতে হবে। তা সে অভিনয় হোক বা অন্য কাজ। কেননা তুমি একজন ছেলে। বাবা-মায়ের কথাকে গুরুত্ব দিতে যাত্রা ছেড়ে অন্য কাজ খুঁজতে শুরু করেন। কারণ যাত্রাতে কেউ পুরুষের চরিত্র দিত না। মেয়ের চরিত্র তো নয়ই। যাত্রা ছেড়ে অন্য কাজ খুঁজতে গেলে সেখানেও ঘটল বিপত্তি।

Yatra | newsfront.co

কুসুম ছেলে নাকি মেয়ে তা নিয়ে সন্দিহান ব্যক্তিরা তাকে ‘হিজরে’ হিসেবে গণ্য করে বলে- “একে কী কাজ দেব? এ তো হিজরে।” কথাটা একাধিকবার নানাজনের কাছ থেকে শুনে অপমানিত বোধ করে বাড়ি ফিরে আসতেন কুসুম।

আরও পড়ুনঃ নব্বই এর নস্টালজিয়া নিয়ে পুজোয় হাজির সিধু, শৌভিক

আমতলা নিবাসী কুসুম একদিন বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে এলেন নিউ মার্কেটে। সেদিন তাঁকে পিছন থেকে কেউ ডেকে ওঠে। পিছন ফিরে তাকাতেই কুসুম দেখেন সেই মানুষটি ডঃ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। কুসুম বলেন, “ডঃ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি খবরের কাগজের পাতায় দেখেছি। সেই মানুষটি আমায় পিছন থেকে ডাকলেন!

Kusum with Parambrata | newsfront.co

ব্যাপারটা ভেবেই আমি কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। আমায় জিজ্ঞেস করলেন আমি কী করি। আমি বললাম আমার যাত্রা করার কথা। আমার ফোন নম্বর নিলেন। এরপর একদিন আমায় ফোন করে বললেন, নাটক করবি? আমি রাজি হয়ে গেলাম। আমি তো মনে প্রাণে ফিরতে চাইতাম অভিনয়ে। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেহান্তর মনান্তর’-এ অভিনয় করি আমি। এরপর বহু নাটক এবং শর্ট ফিল্ম করেছি।”

Firki serial | newsfront.co
‘ফিরকি’ ধারাবাহিকে কুসুম সামন্ত

‘ফিরকি’ ধারাবাহিকে পার্বতী চরিত্রে আসার আগে তাঁর অভিনয় জার্নি শুরু হয় প্রায় ১৪-১৫ বছর আগে। তখন শুধুই হিজরের চরিত্রে অভিনয় করতেন কুসুম। বেশ কয়েকটি সিরিয়ালে অভিনয় করেছেন।

যেমন কাজললতা, শেষ থেকে শুরু, শুভদৃষ্টি। এ ছাড়াও বাংলা ছবি সমান্তরাল সহ একাধিক শর্ট ফিল্মে অভিনয় করেছেন কুসুম। তবে, ‘ফিরকি’র ঠিক আগে অভিনয় করতেন ‘নবদিগন্ত’ গ্রুপ থিয়েটারে। নির্দেশক ছিলেন সুমিত ভট্টাচার্য। এরপর ‘ফিরকি’ ধারাবাহিকে তিনি এলেন পার্বতী মাসি হয়ে৷

Cinema | newsfront.co

‘ফিরকি’ প্রসঙ্গে কুসুম জানান, “পার্বতী কুসুমকে অনেক সম্মান দিল৷ অনেক ভালোবাসা দিল। যারা বিশ্বজিৎকে কুসুম বলে মেনে নিতে পারত না, কটূ কথা শোনাত তারাই আজ ডেকে কতগা বলে৷ কোনও এপিসোড ভাল লাগলে জানায়। তারা আজ আর বিশ্বজিৎ বলে ডাকে না। ইনফ্যাক্ট বছর দুই-তিন হল বেশিরভাগ মানুষ আমায় কুসুম বলেই ডাকে৷ বিশ্বজিৎ আর ডাকে না৷ তবে যাদের সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হয়েছে বা কোনও স্কুলের বন্ধু আমায় বিশ্বজিৎ বলেই ডাকে। তাতে আমি রেগে যাই না। নামে কী যায় আসে। আসল তো কাজ।

আমি কাজে তো কুসুম। কুসুম হয়েই কাজ করতে চাই৷ ফিরকিতে আমার চরিত্রটা একজন হিজরার। তবু তার মধ্যে একটা মাতৃসত্তা কাজ করে। সে ফিরকির মাসি। অর্থাৎ মায়ের মতো। তবে শুধুই একজন হিজরার চরিত্র নয় অন্যান্য চরিত্রেও কাজ করতে চাই। আমি বলছি না আমাকে কোনও নারীর চরিত্র দিতে।

Yatra Pala | newsfront.co

আমি রূপান্তরকামীর চরিত্রই করব। কিন্তু শুধুই হিজরা নয়। আমরা ভ্যানও চালাতে পারি, ডাক্তারও হতে পারি, ইঞ্জিনিয়ার, অভিনেত্রী, পরিচারিকা সবই হতে পারে একজন রূপান্তরকামী মানুষ। তাহলে তাকে শুধুই একজন হিজরার চরিত্র দেওয়া হবে কেন? আমাদের একটু ডাক্তার, শিক্ষিকা কিংবা পরিচারিকার চরিত্রেও ভাবুক না প্রযোজক-পরিচালকেরা।

আমার তাঁদের কাছে একটাই অনুরোধ, আমাদের একটু অন্য চরিত্রও দেওয়া হোক। হিজরা তো একটা পেশা। সব মেয়েরা যেমন বেশ্যা হয় না, সব রূপান্তরকামীরা তেমনি হিজরা হয় না৷ হতে চায় না৷ তারাও চায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিকা কিংবা অভিনেত্রী হতে। আমিও যেমন চাই একজন অভিনেত্রী হতে। আমার মতো এমন অনেকে আছে যারা অভিনেত্রী হতে চায়। কিংবা অন্য কিছু হতে চায়। সিনেমা, সিরিয়াল, নাটক তো সমাজের কথা বলে। আমরা কি সমাজের বাইরে?”

কুসুম আরও জানান, “সবার সামর্থ থাকে না লিঙ্গ পরিবর্তন করানোর। কিন্তু রূপান্তরকামীরাও চায় মা হতে। জন্ম দিলেই কেবল মা হওয়া যায়- আমি সেটা মনে করি না। দত্তক নিয়ে যারা কোনও বাচ্চাকে মানুষ করে তারাও মাতৃস্নেহেই নিজের সবটুকু দিয়ে তাকে আগলে রাখে। তাকেই মা হিসেবে চেনে সেই শিশুটি।

ঠিক যেভাবে ফিরকিকে মাতৃস্নেহে বড় করেছে লক্ষ্মী। আমি জি বাংলা এবং অ্যাক্রোপলিশের কাছে কৃতজ্ঞ আমায় এমন একটা রোলে সুযোগ দেওয়ার জন্য। পার্বতী মাসি একজন হিজরাকে ছাপিয়ে একজন মাসি। তার মধ্যে একজন মায়েরও বসবাস।

আমরাও ভালোবাসতে জানি, আমরাও মা হতে চাই, আমরাও সংসার করতে চাই। কিন্তু আমাদের সাধপূরণ বাস্তবে সম্ভব হয় না। ব্যতিক্রম ঘটে না তা নয়। ঘটেছে। কিন্তু কটা ব্যতিক্রম চোখে পড়ে বলুন তো? তাই অনস্ক্রিনে হোক না আমাদের নিয়ে গল্প বাঁধা।

একজন রূপান্তরকামীকে দেখানো হোক না একজন শিক্ষিকা কিংবা একজন ডাক্তার কিংবা একজন পরিচারিকার চরিত্রে। দেখি না মানুষ আমাদের সেভাবে দেখতে চান কিনা? গল্প নির্মাতাদের কাছে আমার এই একটাই আর্জি।”

টালিগঞ্জ পাড়ায় যখন কাজের জন্য কুসুম ঘুরে বেড়াতেন তখন অনেকেই বলেছেন, “তোমার মতো চরিত্র লাগলে ডাকব।” কুসুমের প্রশ্ন- “আমার মতো চরিত্র মানে? কেবলই হাততালি দেওয়ার চরিত্র? আমরা তো শিক্ষিকাও হতে পারি, আরও কত কী পেশায় নিযুক্ত হতে পারি। সেগুলো আমাদের দিয়ে করানো যাবে না কখনও?”

কুসুমের কাছে তাঁর জীবনের কিছু গল্প জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার জীবনে অনেক গল্প। শেষ হবে না আজ। তবু বলি। অনেক অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছে। প্রথমে তো বাবা-মা-পরিবার মেনেই নিতে চায়নি আমার নেলপালিশ পরা, একটু অন্যরকমভাবে হাঁটাচলা করা। যে সময়ে আমার মধ্যে কুসুম উঁকিঝুঁকি মারত সেই সময় কারোকে পাশে পাইনি।

আজ যখন পার্বতী হিসেবে পরিচিত হয়েছি মানুষের কাছে তখন সবাই কুসুমকে ভালোবাসে। আমি অভিনয়ের পাশাপাশি কম বেশি সামাজিক কাজও করি। তা সে যাই হোক, এমনও হয়েছে রাতের অন্ধকারে অসভ্যতা করার জন্য একজন হাত ধরেও টেনেছে। তাকে কামড়ে দিয়ে পালিয়েছি। বাসে উঠলে ভাবি কোন সিটে বসব। মন তো বলে লেডিস সিটে বসতে। কিন্তু বসলেই দেখি মেয়েরা মিটিমিটি হাসে। সরে সরে বসে।

আবার সুলভ শৌচালয়ে গিয়েও পড়েছি বিপদে। না পেরেছি পুরুষদের শৌচালয়ে ঢুকতে, না পেরেছি মহিলাদের শৌচালয়ে ঢুকতে। হসপিটালে গেলে মেয়েদের বেড পাব নাকি ছেলেদের তা নিয়েও পড়েছি ফাঁপড়ে। এখন অবশ্য আমাদের জন্য বাসে আলাদা সিট, রাস্তায় শৌচালয় এমনকী হাসপাতালে আমাদের জন্য আলাদা বেডের ব্যবস্থা করেছে সরকার থেকে। তাই আমরা এই রাজ্যের সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ।”

কুসুমের কাছে জানতে চাই, যদি কখনও আজকের মতো কাজের ব্যস্ততা না থাকে কাজ কমে যায় তখন কী করবে? কারণ একজন অভিনেতা কিংবা অভিনেত্রীর কেরিয়ারে ওঠানামা চলতেই থাকে।

কুসুম সদর্পে বলেন- “কাজ পাব না কেন? আমার বিশ্বাস আমি আমার কাজ দিয়ে, ব্যবহার দিয়ে সকলের মন জয় করতে পারব। তাই একবার না একবার আমাকে ঠিক নির্মাতারা মনে করবেন৷ কাজ কম বা বেশি থাকতেই পারে। কিন্তু থাকবে। আমি পজিটিভ ভাবি সবসময়।”

এই পুজোতে কম ঘোরা আর ভাল খাওয়ার দিকে নজর আছে কুসুমের। ঘুরলেও সবরকম সাবধানতা মেনে চলবেন তিনি। আর অন্যদেরও সেটাই করার অনুরোধ জানিয়েছেন কুসুম।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here