এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউঃ পঁচিশ বছর আগে ‘নেপোটিজম’ শব্দটা জানলে অনেক কথা বলার ছিলঃ সোমা ব্যানার্জি

0
1367

মুখোমুখি নবনীতা দত্তগুপ্ত

অভিনয়জীবনের ২৫ টি বছর পার করে ফেললেন অভিনেত্রী সোমা ব্যানার্জি। এই পঁচিশ বছরে পাওয়া-না পাওয়ার ঝুলি পরিপূর্ণ। অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন নবনীতা দত্তগুপ্ত’র সঙ্গে।

Soma Banerjee | newsfront.co

নবনীতাঃ আগে বলো এই লকডাউনে কেমন ছিলে আর আছো?

সোমাঃ সবাই যেমন আছে আমিও তেমনই। ঠিক নেই। ঠিক থাকার চেষ্টা করছি। হঠাৎ করেই সব থমকে গেল যেন। আশা রাখি আবার সব আগের মতো হবে৷

নবনীতাঃ হবে তো বটেই। আচ্ছা, সোমা দি প্রথমেই তোমার সাম্প্রতিককালের একটা দুর্দান্ত কাজ নিয়ে কথা বলব।

সোমাঃ কোনটা? আচ্ছা বেশ। বলো বলো।

Soma Banerjee | newsfront.co

নবনীতাঃ ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’ তে তুমি হাসিয়েছো এবং কাঁদিয়েছো। এই দুটোর মধ্যে তুমি কোন পোর্সনটা বেশি এনজয় করেছো?

সোমাঃ দুটো ঘিরে দু’রকমের অনুভূতি৷ যখন তোমরা আমার সংলাপে হেসেছো তখন আমি মজা পেয়েছি যখন শুটটা করেছি। আর যখন কেঁদেছো তখন আমি নিজেই শট দেওয়ার সময় অনুভব করেছি একজন ভাল শাশুড়ি হিসেবে সর্বোপরি একজন সচেতন, আধুনিক মানুষ হিসেবে এটাই করণীয় ছিল। ওরকম একটা চরিত্র পেয়ে আমি আপ্লুত হয়েছিলাম। কী দারুণ স্ক্রিপ্ট ছিল বলো তো? একইসঙ্গে মানুষ আমার সংলাপ শুনে হেসেছে আবার কেঁদেছে। এ বড় পাওয়া জানো তো?

Soma Banerjee | newsfront.co

নবনীতাঃ এই মুহূর্তে কোনও সিরিয়ালে তোমায় দেখা যাচ্ছে না কেন?

সোমাঃ ছয় মাস ধরে তো লকডাউনের কারণেই করিনি কিছু। ভরসা পাচ্ছিলাম না জানো তো? স্যানিটাইজিং নিয়ে চিন্তাতেই ছিলাম। অফার আসেনি তা নয়। এসেছে। কিন্তু ভরসা পাইনি৷ অপেক্ষা করছিলাম সব কবে ঠিক হবে।তবে, এবার একটা সুখবর দিই। খুব শিগগিরই টেলিভিশনে ফিরছি সুশান্ত দাসের ‘টেন্ট’ প্রযোজনা সংস্থার হাত ধরে। বাকিটা লুক সেটের পরে জানাব।

নবনীতাঃ অনেকদিনের অভিনয় জার্নি তোমার। প্রচুর চরিত্র উপহার পেয়েছি তোমার কাছ থেকে। কোন চরিত্রটাকে নিজের অভিনয়জীবনের মাইলস্টোন মনে করো?

সোমাঃ একজন অভিনেতার-অভিনেত্রীর কাছে সব চরিত্রই সমান কদর পায়। তাও যদি বলতে বলো বলব, ‘জন্মভূমি’র পরী আর ‘মা’ -এর হীরা আম্মার চরিত্র দুটো আমায় অন্য জায়গা দিয়েছিল টেলি কেরিয়ারে।

Soma Banerjee | newsfront.co
হীরা আম্মার লুকে সোমা ব্যানার্জি

‘জন্মভূমি’র ক্রেজ নিয়ে তো নতুন কিছু বলার নেই। ১৯৯৬ থেকে ২০০২ সাল অবধি চলেছিল সিরিয়ালটা। কত মানুষ যে ভালোবেসেছে সিরিয়ালটাকে তা আর বলার নয়। আমার নিজের চোখে দেখা, কারো হয়ত বাড়িতে টিভি নেই সে অন্যের বাড়িতে জানলার বাইরে দাঁড়িয়েও দেখেছে ‘জন্মভূমি’।

টিভির শো রুমেও চলত সিরিয়ালটা। কত লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত! ওই সময় সন্ধেবেলা রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে শোনা যেত কখনও পরীর গলা আবার কখনও পিসিমা বা রতিকান্তর গলা। এমনই জনপ্রিয় ছিল সিরিয়ালটা। এরপর ‘মা’-এর কথা বলি। হীরা আম্মাকে কেউ সহ্য করতে পারত না। আমার হাঁটাচলা, কথা বলা, সাজ পোশাক সবই ছিল অন্য ধাঁচের। খুব সাড়া পেয়েছি ওই চরিত্রটাতেও। মাইলস্টোন বললে এই দুটোর কথাই বলব।

Soma Banerjee | newsfront.co

এছাড়াও ‘ভজগোবিন্দ’র সোনা মা, ‘কেয়া পাতার নৌকো’র ফতিমা সবই ছিল খুব আপন। এরপর ‘জরোয়ার ঝুমকো’তে কমেডি রোল করেছিলাম। টেলিভিশনে আমাকে কেউ মজার রোলে ভাবতে পারে না৷ ভাবে আমি খুব সিরিয়াস। কিন্তু ‘জরোয়ার ঝুমকো’তে আমিও হাসাতে পারি দেখিয়ে দিয়েছিলাম। (সহাস্যে)

নবনীতাঃ সোমা দি তোমার নিজের কখনও পরিচালনায় আসতে ইচ্ছে করে না?

সোমাঃ ইচ্ছে করে তো। দেখা যাক। আমার কর্তা অর্থাৎ রানা ব্যানার্জি তিনিও তো ডিরেক্টর তুমি জানো। বহু সিরিয়ালে কাজ করেছেন। ছবি পরিচালনা করেছেন। তার মধ্যে দুটো রিলিজও করেছে। আমরা নিজেদের মধ্যে খুব ফিল্মি আলোচনা করি। আমি কোনও চরিত্র পেলে সেটা কেমনভাবে করা যেতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা করি। ও আমাকে বলে, তুমি কী ভাবছ চরিত্রটা নিয়ে? এভাবেই একে অপরের কাজ নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকি। ভাবি একে অপরের কাজ নিয়ে। এভাবেই হয়ত একদিন পরিচালনার পথে পা বাড়াব। সবটাই সময় বলবে।

নবনীতাঃ অনেক বছরের অভিনয়জীবন। ক্ষেপ আক্ষেপ আছে কোনও?

সোমাঃ আছে তো। ‘জন্মভূমি’র আগেও আমি কাজ করেছি বেশ কয়েকটা। ‘জন্মভূমি’ চলাকালীন প্রায়ই প্রযোজকরা দেখা করতে এসে তাঁদের আসন্ন কাজ নিয়ে কথা বলতেন। এমন কথা বলতেন মনে হত আমি ওই ছবিতে কাজটা করছি সেটা ফাইনাল।

Soma Banerjee | newsfront.co

এরপর দিনকয়েক গেলে আমি নক করেছি যখন, আমাকে বলা হয়েছে- “আসলে ব্যাপারটা হল কি, আপনি টেলিভিশনে ‘ওভার এক্সপোসড’ তাই আপনাকে নিতে পারছি না। পরে সেই জায়গায় অন্য কারোকে নেওয়া হত। খুব ধাক্কা খেতাম তখন। তবে, ভেঙে পড়তাম না। ভাবতাম, এই টেলিভিশনের জন্যই একদিন কেউ আমায় বড়পর্দায় ভাল কাজ দেওয়ার জন্য ডাকবে। হয়ত যাদের থেকে বঞ্চিত হলাম তারা নয়, অন্য কেউ। আর হলও তাই।

‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’ নিয়ে যখন পরিচালক অরিত্র মুখার্জি কথা বলতে এল আমি জানতে চাইলাম, তুমি আমাকে কী ভাবে চেনো? অরিত্র আমাকে বলল- “কেন? টেলিভিশনের মাধ্যমে।” বুঝতেই পারছো আমি কী বলতে চাইলাম। আমি জানতাম এমন দিন আসবে যেদিন টেলিভিশনে ব্যস্ত থাকার কারণে আর টেলিভিশনের কারণে ‘ওভার এক্সপোসড’ হওয়ার দরুণ ছবিতে ভাল চরিত্রের জন্য ডাক পাব।

নবনীতাঃ ইন্ডাস্ট্রিতে আজ ‘নেপোটিজম’ কথাটা বেশ মাথাচাড়া দিয়েছে। কথায় কথায় একে অন্যের দিকে এই ব্যাপারে আঙুল তুলছে। তুমি কী বলবে এই ব্যাপারে।

সোমাঃ ঠিকই। আজকাল ‘নেপোটিজম’ শব্দটা খুব শুনি। নতুন শুনি বলতেও আপত্তি নেই। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে যদি এই শব্দটা এত মাথাচাড়া দিত, আমি অনেক কথা বলতে পারতাম। নেপোটিজমের একের পর এক উদাহরণ দিতে পারতাম।

Soma Banerjee | newsfront.co

নবনীতাঃ এতদিনের অভিনয়জার্নি, অনেক জায়গায় যেতে হয়। কোন চরিত্র নিয়ে খুব সাড়া পেয়েছো?

সোমাঃ আবারও পরী আর হীরা আম্মার কথা বলতে হয়। একবার এক ফ্লোরে এক প্রবীণ টেকনিশিয়ান দাদা আমায় বলছেন- “পরী একটু সরো তো।” আমি তো অবাক! দশ বছর পরেও কেউ কোনও চরিত্রকে এভাবে মনে রাখে! আরেকবার এক জায়গায় গেছি নিজের চরিত্র নিয়ে বলতে। স্টেজে ওঠার পর কয়েকজন আমাকে বলছেন- “আপনার শাড়িটা তুলে আমাদের দেখান তো আপনার পা দুটো সত্যিই আছে কিনা? ঠিক করে একবার হেঁটে দেখান তো।”

Soma Banerjee | newsfront.co

মানে ওঁদের ধারণা আমার পা দুটো সত্যিই নেই। হীরা আম্মার হাঁটাটা এতটাই মানুষের কাছে রিয়েল মনে হয়েছিল। আবার যখন লীনা দি আমায় ‘কেয়া পাতার নৌকো’তে বাঙাল ভাষা বলার দায়িত্ব দিল তখন খুব ভয়ে ছিলাম। কারণ আমি বাঙাল নই, ঘটি। বাঙাল ভাষা আমার দ্বারা রপ্ত করা কঠিন। কিন্তু কয়েকদিন পর অনেকেই বলল- “তোমার কথা শুনে তোমাকে ওপার বাংলার লোক বলেই মনে হয়। দারুণ বাঙাল ভাষা বলো।” বাংলাদেশে আমার অনেক ফ্যান ফলোয়ার আছে জানো তো? আর কী বলব? এই সব ভাল লাগা নিয়েই তো বেঁচে থাকা। রোজ বাঁচি এই সব সঙ্গে নিয়েই।

নবনীতাঃ তুমি এবং রানা দা দুজনেই রুপোলি পর্দার মানুষ। মেয়েরাও কি সেই পথে হাঁটতে চায়?

সোমাঃ এখনও সেভাবে আগ্রহ দেখায়নি। বরং কস্টিউম, ফ্যাশন দুনিয়া, ফোটোগ্রাফি নিয়ে বেশি আগ্রহী দুজনেই। বড় মেয়ে জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়ছে। দেখা যাক কোন পথে যায়। অনেকে অভিনয় করাতে চেয়েছে বড় মেয়েকে দিয়ে। কিন্তু এক্ষুণি রাজি নয় সে। ও রাজি হলে আমার আপত্তি নেই। দুজনেই খুব সিনেমা দেখে। আলোচনা করে নিজেদের মধ্যে।

Soma's family | newsfront.co
দুই কন্যের সঙ্গে সোমা

নবনীতাঃ তুমিও তো দারুণ সাজুগুজু করো।

সোমাঃ হ্যাঁ। পোশাক, সাজগোজ নিয়ে আমি দারুণ খুঁতখুঁতে। ফ্লোরেও নিজের স্ক্রিপ্ট বা সিনের সঙ্গে পোশাক না মানালে সেটা পরি না। ই পি-দের বলি নিজের পছন্দ-অপছন্দের কথা। ভালোভাবেই বলি। ওরা বেশিরভাগ সময়েই আমার মতকে গুরুত্ব দেয়। হয়ত অনেকটা সিনিয়র বলে। আমি থিয়েটারের মানুষ। আমি চরিত্রের জন্য যা খুশি পরতে পারি, বলতে পারি।

Soma Banerjee | newsfront.co

জোর গলায় বলতে পারি, এটুকু জানি কোন সিনে বা কোন চরিত্রে কোন পোশাক মানাবে। ই পি-দের রাখা হয় ওই দিকটা দেখার জন্য। আমার প্রশ্ন সকলেই কি সবটা বোঝে? বুঝতে হলে অনেকটা পথ পেরোতে হবে৷ বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, তরুণ মজুমদার, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ কার সঙ্গে না কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আরে এঁদের থেকে কিছু তো শিখেছি, কিছু তো জেনেছি।…

আরও পড়ুনঃ এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউঃ মানসিক প্রতিবন্ধীর চরিত্রে কাজ করতে চান মানসী

নবনীতাঃ সেটা ঠিক।

সোমাঃ কারোকে অসম্মান না করেই বলছি, বেশিরভাগ কিচ্ছুটি জানে না। অনেক শেখা প্রয়োজন তাদের। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে ‘ই পি’ শব্দটা শুনতে? শুনতে না। কারণ প্রয়োজন পড়ত না। ডিরেক্টর অনেক বেশি জানেন। তিনি তাঁর ভাবনা দিয়ে একটা চরিত্রকে চলান এবং বলান। তিনি চরিত্রটিকে কেমন সাজে দেখতে চান খুব ভাল জানেন। ‘ই পি’ পদটা নিয়ে কেউ রুজি রোজগার করছে সেটা ভাল কথা। কিন্তু তার আগে শেখাটা দরকার।

Soma Banerjee | newsfront.co

নবনীতাঃ সামনেই পুজো। কী বলবে সকলকে?

সোমাঃ খুব সাবধান। কম বেরোবেন। পারলে কারো বাড়িতে বসে আড্ডা মারুন। ঠাকুর অবশ্যই দেখবেন। মাস্ক মাস্ট। দূরত্ব বজায় রাখুন। রোগটা যেন না ছড়ায়। অনেক কাজ বাকি আছে এখনও। জীবনযাত্রা থমকে গেছে। জীবনকে অত সহজে থামতে দেওয়া চলবে না।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here