কৌস্তভ ভট্টাচার্য,শিকাগো: এই ধরুন আপনার অফিসের গাড়িবারান্দায় বসে চা খেতে খেতে রোজ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখা যায়। কিম্বা ডেস্কে বসে কাজ করতে করতে টুক করে একটু চোখ তুললেই হাওড়া ব্রিজ। কোলকাতায় এ’রম সৌভাগ্যবান নিশ্চয়ই ক’জন আছেন। আমার ডেস্ক থেকে খুব চেষ্টা করলে রাজারহাট সার্ভিস রোডটুকু দেখা যায় বড়োজোর। তাই ভাই বুঝে গেছি আমি নিশ্চিতভাবে গতজন্মে যুধিষ্ঠিরের লাইনে শেষকথাগোছের কিছু একটা ছিলাম। নইলে একজন্মের পুণ্যে এ’রকম জায়গায় আপিস আর সেখানে এ’রকম সীট পাওয়া যায়না।
শিকাগো শহরটা ঠিক লেক মিশিগানের পাড় ধরে লম্বালম্বি এগিয়েছে। শহরটার ঠিক মাঝে ডাউনটাউন। আম্রিকি লব্জে যেকোনো শহরের মুখ্য বাণিজ্যকেন্দ্র। কোনো এক সুদূর অতীতে নিউইয়র্কে শব্দটার প্রচলন। শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নাম মিশিগান এভিনিউ (নীচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে) – যেটা খুব ছোটো করে বোঝাতে গেলে এখানকার পার্ক স্ট্রীট।
এই মিশিগান এভিনিউয়ের মধ্যে দিয়ে যেখানে শিকাগো নদী রাস্তা পেরিয়েছে ঠিক সেখানেই আমার অফিস, যার জানলার ঠিক পাশে আমার বসার জায়গা।
এবার একটু স্থানমাহাত্ম্য বলা যাক। আফিস থেকে ঠিক চারটে বাসস্টপ বা ব্লক দক্ষিণে আর্ট ইন্সটিটিউট যেখানে বিবেকানন্দ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার পাশেই মিলেনিয়াম পার্ক শিকাগোর বিখ্যাত স্টীলবীন শুদ্ধু। একবাসে চড়ে পনেরো মিনিটে স্কাইডেক অথবা উইলিস টাওয়ার যাওয়া যায়, যেটা পশ্চিম গোলার্ধের দ্বিতীয় উচ্চতম বহুতল। শিকাগো থিয়েটার হেঁটে যাওয়া সম্ভব। নেভি পিয়ার এক বাসে। ফিল্ড মিউজিয়াম ক্যাম্পাসও তাই। এই ফিল্ড মিউজিয়ামে টিরেনোসরাস রেক্সের জীবাশ্ম থেকে পাওয়া ৯০% সম্পূর্ণ একটা কঙ্কাল আছে, যেটা এই মূহুর্তে সবচেয়ে সম্পূর্ণ কঙ্কাল – বাকিগুলো ৫০%-৭০% সম্পূর্ণ। আমার অফিস যে জায়গায় তার নাম ওয়াকার ড্রাইভ,এখানেই ফোর্ট ডিয়ারবর্ন বলে একটা দুর্গ ছিলো আমেরিকার আদিযুগে। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গাটাই শিকাগো নদী ও লেক মিশিগানের আদি মোহনা। পরে শহরটাকে মাটি ভর্তি করে বাড়ানো হয়েছে। শিকাগো নদীতে ঘুরে ঘুরে শহরের মুখ্য স্থাপত্য দেখার সুন্দর ব্যবস্থা আছে – যার লঞ্চগুলো, হেঁ হেঁ নিজের মুখে আর কিই বা বলি – আমার অফিসের সামনে থেকেই ছাড়ে।
তো এই লঞ্চে করে আর্কিটেকচার ট্যুরে বেরিয়েই জানা গেলো আমারর অফিসের ঠিক উল্টোদিকের দু’দুটো বাড়ির গপ্পো। তার একটা আজকে বলবো। আরেকটা পরের দিন।
অনেকদিন ধরেই দেখেছি আমার বাড়ির উল্টোদিকে শিকাগো ট্রিবিউনের আপিস। খবরের কাগজ হিসেবে নিউ ইয়র্ক টাইমস না হলেও নামটা জানা। জানলাম বাড়িটার নাম ট্রিবিউন টাওয়ার এবং নিওগথিক ভাবাদর্শে বানানো বাড়িটা গতশতাব্দীর মুখ্য আর্টডেকো বাড়িগুলোর একটা। এবার আর্টডেকো খায় না মাথায় দেয় সে নিয়ে এতোদিন আমারর বিশেষ আগ্রহ ছিলোনা। একটু ইন্টারনেট ঘেঁটেও বিশেষ আগ্রহ লাগলোনা। সেটা আমারই অক্ষমতা।
যেটা বেশি মজার সেটা এই বাড়িটা বানাবার গপ্পোটা। ১৮৬৮তে আসল ট্রিবিউন টাওয়ারটা বানানো হয়। কিন্তু ১৮৭১-র “গ্রেট শিকাগো ফায়ার” নামের আগুনে অনেককিছুর সাথে সেটারও ইতি ঘটে। ফলত: ১৯২২-এ আবার নতুন করে ট্রিবিউন টাওয়ার বানাতে একটা ডিজাইন প্রতিযোগিতা ঘোষণা করে শিকাগো ট্রিবিউন, সংস্থার হীরকজয়ন্তী উপলক্ষে। এখানে বলে রাখা ভালো উপরোক্ত অগ্নিকান্ডের ফলেই শিকাগোতে উঁচু উঁচু বাড়ি বানাবার দিকে মানুষে ঝোঁকে, আর এখানেই পৃথিবীর প্রথম স্কাইস্ক্রেপারগুলো তৈরী হয়।
যাই হোক ডিজাইন কম্পিটিশনে জিতলেন জন মিড হাওয়েলস আর রেমন্ড হুড নামের নিউইয়র্কের দু’জন স্থপতি। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞের মতে সবচেয়ে ভালো ডিজাইনটা দিয়েছিলেন একজন ফিনিশ স্থপতি। নাম এলিয়েল সারিনেন। এই ডিজাইনটা দ্বিতীয় হয়। কিন্তু ভবিষ্যতে একগাদা বাড়ির ডিজাইনে “সারিনেন টাওয়ার”এর প্রভাব দেখা যায়। এমনকি রেমন্ড হুডের রকারফেলার সেন্টারের কাজেও সারিনেনের ডিজাইনের প্রভাব আছে।
এলিয়েল সারিনেনকে নিয়ে আরেকটু ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে জানলাম ভদ্রলোক হেলসিঙ্কি সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশন ডিজাইন করেছিলেন। এই প্রতিযোগিতার পর পাকাপাকি ভাবে আমেরিকাতেই চলে আসেন এবং শিকাগোতে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেন। তাঁর ছেলে এরো সালিনেন পরে বিখ্যাত স্থপতি হয়েছিলেন। এলিয়েল ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানে অধ্যাপনা করেছিলেন বহুদিন। কিন্তু আমেরিকা থাকাকালীন তাঁর স্কাইস্ক্রেপার ডিজাইনের একটাও বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ পরবর্তী বহু স্থপতি তাঁর কাজে প্রভাবিত।
এখানে এসেই আমার বঙ্গীয় মন একটু কঁকিয়ে উঠলো। ভদ্রলোক ফিনল্যান্ডে জন্মে নিখাদ বঞ্চিত হলেন। তখন বাঙলায় নবজাগরণ ইত্যাদি চলছে। এরকম একটা আদর্শ ট্র্যাজিক নায়ক পেলে আজ অবধি অন্তঃত পাঁচটা বায়োপিক নেমে যেতো। প্রথমটায় বড়ুয়াসাহেব মুখ্য চরিত্রে থাকতেন, লেটেস্টটায় মহানায়ক। শেষ সীনে হেলায় নিজের ডিজাইনটা মাটিতে ফেলে দিয়ে মোটরবাইকে দিগন্তে মিলোতেন হুইস্কিরসে মজে, কাগজটা কুড়িয়ে নিতেন রজতাভ দত্ত – জ্যাকেটের টুপি দিয়ে মাথা ঢেকে – নাম রেমন্ড হুড কিনা।
ভিসা ও ভাড়াবাড়ি যাপন -প্রথম পর্ব পড়ুন এই লিঙ্কে
Pic Credit: Anurupa Pathak Bhattacharya
কৌস্তভ ভট্টাচার্য এর ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584