আসুন আমরা সকলে মিলে জনবিরোধী এফআরডিআই আইনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলি–প্রসেনজিৎ বসু ও দেবর্ষি চক্রবর্তী
আচমকা নোটবন্দি এবং তাড়াহুড়ো করে পণ্য পরিষেবা কর (GST) লাগু করে দেশের অর্থব্যবস্থা এবং জনজীবনকে বিপর্যস্ত করার পর
মোদী সরকার আবার এক জনবিরোধী পদক্ষেপ নিতে চলেছে— প্রস্তাবিতএফআরডিআই আইনের
মাধ্যমে [Financial Resolution and Deposit Insurance (FRDI), Bill 2017]।
আমাদের দেশে ব্যাঙ্কিং, বীমা, পেনশন, শেয়ার বাজার ইত্যাদির আর্থিক ক্ষেত্রগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন নিয়ামক সংস্থা আছে—ব্যাঙ্কের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, বীমার জন্য বীমা নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ, শেয়ার বাজারের জন্য সেবি, ইত্যাদি। এই নিয়ামক সংস্থাগুলির কাজ আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং সাধারণ মানুষের জমানো টাকার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। প্রস্তাবিত এফআরডিআই আইন এই সমস্ত নিয়ামক সংস্থাগুলির উপরে একটি নতুন সংস্থা চাপিয়ে দিতে চাইছে, যার নাম রেজোলিউশন কর্পোরেশন (Resolution Corporation)। আপাতদৃষ্টিতে এই কর্পোরেশনের প্রধান কাজ হবে- যদি ব্যাঙ্ক, বীমা কোম্পানির মতন কোনও আর্থিক সংস্থা দেউলিয়া হয়ে যায় তাহলে সেটার পুনরুজ্জীবনের ব্যবস্থা করা এবং সেটা বাঁচানো না গেলে সেই সংস্থার আমানতকারী এবং অন্যান্য ঋণদাতাদের ক্ষতিপূরণ সুনিশ্চিত করা। কিন্তু দেউলিয়া আর্থিক সংস্থার পুনরুজ্জীবন বা আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণের যে পদ্ধতি এই আইনটি কার্যকর করতে চাইছে সেটি লাগু হলে আমানতের সুরক্ষাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিও বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়বে।
এই বিলটিতে বলা হয়েছে যে দেউলিয়া আর্থিক সংস্থার পুনরুজ্জীবন করতে সাধারণ আমানতকারীদের টাকাও ব্যবহার করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার ব্যাঙ্কে রাখা ডিপোসিটের বদলে আপনাকে ওই দেউলিয়া ব্যাঙ্কের কিছু মূল্যহীন শেয়ার ধরিয়ে দেওয়া হবে। এই “বেইল ইন” (bail-in) পদ্ধতিটি জি-২০-র মাধ্যমে আমাদের দেশের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ২০০৭-০৮-এর আর্থিক সঙ্কট এবং তারপর কয়েক লক্ষ কোটি সরকারি টাকা খরচ করে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিকে বেল-আউট করে বাঁচানোর পরে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে আর্থিক ক্ষেত্রে এই বেইল ইন পদ্ধতি চালু হয়েছে। চিন, রাশিয়া, ব্রাজিল-সহ অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশই কিন্তু আমানতকারীদের স্বার্থের কথা ভেবে এই “বেইল ইন” পদ্ধতি চালু করেনি। তাহলে আমাদের দেশে মোদী সরকার এটা চালু করতে চাইছে কেন?
বর্তমানে কোনও ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে গেলে আমানত বীমা সংস্থা-র (Deposit Insurance and Credit Guarantee Corporation) মাধ্যমে ১ লক্ষ টাকা অবধি আমানতকারীদের টাকা ফেরত পাওয়া সুনিশ্চিত আছে। মোদী সরকার এফআরডিআই আইনের মাধ্যমে এই আমানত বীমা সংস্থাটিকে বন্ধ করে আমানত বীমার দায়িত্বও তুলে দিতে চাইছে রেজোলিউশন কর্পোরেশনের হাতে। এই ১ লক্ষ টাকার আমানত বীমার সীমাটি ঠিক করা হয়েছিল ১৯৯৩-তে। মূল্যবৃদ্ধির নিরিখেই এই টাকার অঙ্ক অনেক বাড়ানো প্রয়োজন। সেটা না করে কেন্দ্রীয় সরকার প্রস্তাবিত এফআরডিআই আইনে এই টাকার অঙ্কটিকেই উহ্য করে দিয়েছে। চিনে এই আমানত বীমার সীমা নির্ধারিত হয়েছে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা, ব্রাজিলে ৪০ লক্ষ টাকা, রাশিয়াতে ১২ লক্ষ টাকার উপরে। তাহলে ভারতে এই আমানত বীমার সীমা কম করে ১০ লক্ষ টাকা হবে না কেন? সেই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চুপ।
প্রস্তাবিত এফআরডিআই আইনের সব থেকে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে, কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বা বীমা কোম্পানি যদি কোনওসময় অসুবিধায় পরে তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে সে আর অর্থসাহায্য নিতে পারবে না। নিজের ক্ষমতায় সেই সংস্থা ঘুরে না দাঁড়াতে পারলে আমানতকারীদের এবং অন্যান্য ঋণদাতাদের টাকা ব্যবহার করে তাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা হবে। রেজোলিউশান কর্পোরেশন মনে করলে যেকোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বা বীমা কোম্পানিকে পুনরুজ্জীবিত না করে বন্ধও করে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকার বা আরবিআই-র আর কিছু করার ক্ষমতা থাকবে না।
ভারতে স্বাধীনতার সময়ে বেশীরভাগ ব্যাঙ্ক এবং বীমা কোম্পানি ছিল বেসরকারি ক্ষেত্রে। কিন্তু পরের দশকগুলিতে মুহুর্মুহু ব্যাঙ্ক ফেল হওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকায় ধাপে ধাপে ব্যাঙ্ক এবং বীমা কোম্পানিগুলির জাতীয়করণ করা হয়। এটা উল্লেখযোগ্য যে জাতীয়করণের পরে কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক আজ অবধি ফেল করেনি। বরং ১৯৯১-তে উদারীকরণের পরে নতুন করে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির রমরমা শুরু হওয়ার পর থেকে ৬টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক ফেল করেছে, এবং এই সবকটি দেউলিয়া ব্যাঙ্ককেই কোনও না কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সাথে সংযুক্ত করে আমানতকারীদের জমানো টাকা বাঁচানো হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং বীমা কোম্পানিগুলি আছে বলেই গ্রাহকদের আমানত সুরক্ষিত আছে। গত দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের ব্যাঙ্কগুলি যেমন আমানতের টাকা নিয়ে শেয়ার বাজারে ফাটকা খেলে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল, আমাদের দেশে কিন্তু এরকম কোনও ঘটনা ঘটেনি। অথচ এফআরডিআই আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং বীমা কোম্পানিগুলিকেই দুর্বল করে দিতে চাইছে। এই জনবিরোধী আইন পাশ হলে আমাদের দেশের আর্থিক ক্ষেত্রে আমানতের সুরক্ষা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।
ভারতে গত দশ বছরে দেশের বড় বড় কর্পোরেটরা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির থেকে লক্ষ, লক্ষ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ৭ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। মোদী সরকারের আমলে ৩ লক্ষ কোটি টাকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণ কর্পোরেটদের জন্য মকুব করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অথচ বিজয় মাল্যের মতন অসাধু ঋণখেলাপিদের কোনও শাস্তিই হয়নি, তারা বহাল তবিয়তে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এখন প্রস্তাবিত এফআরডিআই আইনের মাধ্যমে এই ঋণখেলাপি কর্পোরেটদের পাপের প্রায়শ্চিত্তের বোঝা মোদী সরকার চাপিয়ে দিতে চাইছে সাধারণ আমানতকারী এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ঘাড়ে। এটা কি আমরা মুখ বুঝে মেনে নেব?
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584