কলমে শুভশ্রী মৈত্র
আশংকা ছিলই, তা সত্যি করে মঙ্গলবার রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে শোকজের নোটিস পাঠালো কেন্দ্র। যদিও মঙ্গলবার থেকে তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত কিন্তু চিঠিতে তারিখ রয়েছে ৩১ মে ২০২১ অর্থাৎ তখনো তিনি রাজ্যের মুখ্যসচিব পদে আসীন ছিলেন। আগামী তিনদিনের মধ্যে তাঁকে চিঠির উত্তর দিতে।
এখন প্রশ্ন তাঁর বিরুদ্ধে হঠাৎ করে কেন্দ্র এমন খড়্গহস্ত হয়ে উঠলো কেন! মূলত ২৮ মে ‘ইয়াস’ পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর কলাইকুন্ডার মিটিংয়ে সর্বক্ষণ উপস্থিত না থেকে দীঘা-র সাইক্লোন পরবর্তী পরিস্থিতি পরিদর্শনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বেরিয়ে যান তিনি। আর এখান থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। সেদিনই আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি পাঠায় কেন্দ্র, ৩১ মে সকাল দশটার মধ্যে দিল্লিতে ডিওপিটি দপ্তরে হাজিরা দিতে হবে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
কিন্তু কেন্দ্র সরকার তো ইতিমধ্যেই তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব হিসেবে কাজ করার জন্য তিন মাসের এক্সটেনশন মঞ্জুর করেছে তার কি হবে! কোভিড এবং ইয়াস এই দুই ধাক্কা সামলাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রকে আবেদন করেন যে আলাপন বাবুর কর্মজীবনের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে ৩১ মে, তাঁকে আরো ৩মাস এক্সটেনশন দিয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিব রাখার অনুমোদন দিক কেন্দ্র। সে অনুমতি কেন্দ্র দিয়েও ছিল। এর মধ্যে এল প্রধানমন্ত্রীর কলাইকুন্ডার মিটিং এবং এখানেই সংঘাতের শুরু।
জানা গেল, কলাইকুন্ডার বৈঠক শুধু মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নয়, সেখানে হাজির থাকবেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সহ রাজ্য বিজেপির আরো কিছু নেতা। পত্রপাঠ মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত, ওই বৈঠকে তিনি থাকবেন না। প্রটোকল অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রী সাক্ষাৎ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে, ইয়াস সাইক্লোনে রাজ্যের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে গেলেন পূর্ব নিধারিত সূচি অনুযায়ী দীঘা- ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল পরিদর্শনে; সঙ্গে মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর থেকেই কেন্দ্রের রোষে আলাপন। কিন্তু এর মধ্যে কোথাও রাজ্য সরকারকে কিছু জানানোর ‘প্রটোকল’ মেনে চলা হলো না কেন্দ্রের তরফ থেকেও, সোজাসুজি আলাপনকে দিল্লি পৌঁছনোর নির্দেশ দেওয়া হলো। এই ‘ইগো’র লড়াই লড়তে গিয়ে কার্যত কেন্দ্রই প্রথম রাউন্ডে এগিয়ে দিল রাজ্যকে।
আলাপন এরপর আর তিন মাসের এক্সটেনশন নিলেন না, নির্ধারিত অবসরগ্রহণের দিনেই অর্থাৎ ৩১মে অবসর গ্রহণ করলেন। কিন্তু অনেকেরই আশংকা ছিল একেবারে কোন শাস্তির খাঁড়া আলাপনের ওপর আসবে না এমনটা হতেই পারে না। ১জুন শোকজের চিঠিই তার প্রমাণ। আইনত কোন আমলাকে নিয়ে কেন্দ্র – রাজ্য মতানৈক্য হলে কেন্দ্রের কথাই বলবৎ থাকবে। এটা যেমন একেবারে ঠিক একই সঙ্গে এটাও ঠিক যে আগে তো ‘মতানৈক্য’ হতে হবে! অর্থাৎ কেন্দ্র রাজ্যকে জানাবে তারা কোন আমলাকে রাজ্য থেকে সরিয়ে নিতে চায়, রাজ্য অসম্মত হলে তবেই হবে মতানৈক্য। এক্ষেত্রে রাজ্যের সে সুযোগই ঘটেনি।
আরও পড়ুনঃ সম্মুখ সমরে রাজ্য ও কেন্দ্র!
এছাড়াও আলাপন পর্বে একাধিক আইএএস বিধি লঙ্ঘন করেছে দিল্লি, এমনটাই বলছেন একাধিক আইএএস’রা। তাঁদের মতে, আইএএস (ক্যাডার) রুলের ৬(১) বিধি অনুযায়ী কোন আমলাকে রাজ্য থেকে সরিয়ে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে জানাতে হবে, এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো হল তাকে। পরবর্তী বিধি লঙ্ঘন- ‘ট্রান্সকশন অফ বিজনেস রুল’ এর ৬(১) বিধির প্রথম অনুচ্ছেদ বলছে, কোন আইএএস অধিকারিককে ডিওপিটি দপ্তরে এসে রিপোর্ট করতে বলার ক্ষমতা নেই ‘নিয়োগ সংক্রান্ত ক্যাবিনেট কমিটি’র। আর যদি নির্দেশ দিতেই হয় সেখানে উল্লেখ থাকতে হবে ঠিক কোন পদে ওই অফিসারকে যোগ দিতে বলা হচ্ছে। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এটিও মানা হয়নি। ও হ্যাঁ, প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দুই সদস্যের এই নিয়োগ কমিটিতে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আলাপন সেদিনের মিটিংয়ে উপস্থিত না থাকার কারণ দর্শাবেন কিনা বা কি কারণ দর্শাবেন তা একেবারেই তাঁর পেশাগত বিষয়। তবে প্রটোকল বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন তাতে উঠে এসেছে আরো একটি তথ্য। তাঁরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী রাজ্যে এলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশকে সম্পূর্ণ ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতির পূর্ণ সময় উপস্থিত থাকতে হয়।
একইভাবে উপস্থিত থাকতে হয় রাজ্যের মুখ্যসচিবকেও, এটাই প্রটোকল; কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বিমান অবতরণ করেছিল কলাইকুণ্ডায়, যা কিন্তু কোন সাধারণ বিমান বন্দর নয় এটি বায়ুসেনার একটি বিশেষ বিমানঘাঁটি। সেনাবাহিনীর কোন কিছুতেই সাধারণ প্রশাসনিক নিয়ম খাটে না। কাজেই এক্ষেত্রেও তাকে সাধারণ প্রটোকলের ভিত্তিতে বিচার করা যাবে না। তবে একথা নিশ্চিত করে বলা আলাপন – কেন্দ্র সংঘাত যদি আদালতেও গড়ায় তা দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584