নিজস্ব সংবাদদাতা, ওয়েব ডেস্কঃ
বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ়, আজীবন দেখে এসেছেন একই চিত্র, দলিত হওয়ার কারণে সামাজিক দূরত্ব। যা করোনা আবহে তৈরি হওয়া নয়; আরও গভীরে এই সামাজিক ব্যাধি।
কোনও জিনিস কিনতে দোকানে গেলে দোকানদার বলে, একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে। চমকে উঠবেন না, এ হলো দলিতদের জন্য উচ্চবর্ণের তৈরি করা সামাজিক দূরত্ব বিধি। পঞ্চাশ পেরোনো প্রৌঢ়ের কথায়, “উচ্চবর্ণের লোকেরা সবসময় এমন দুর্ব্যবহার করে। সেটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে, এখন আর অপমানিত বোধ করি না।”
হাথরাস জেলায় ১৯ বছরের দলিত তরুণীর গণধর্ষণ-মৃত্যুর পরও ‘চুপ’ থাকতে হয়েছে দলিত সম্প্রদায়কে। উচ্চবর্ণের চার যুবক নির্মম অত্যাচার করে মেয়েটিকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছে, তাও ‘নিরব’ থাকতে হয়েছে নিম্মবর্ণের মানুষকে।
আরও পড়ুনঃ যোগী রাজ্যে ফের ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যু দলিত মহিলার
কারণ সারাজীবন ধরে তাঁরা এটাই দেখেছেন, উচ্চবর্ণের মানুষজন হাজার অপরাধ করলেও তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে নেই। দোকানপত্র, স্কুল, স্থানীয় মন্দিরেও প্রবেশাধিকার নেই তাঁদের। এমনকী মৃত্যু পরবর্তী দেহ সৎকারের স্থানটিও ‘আলাদা’ কারণ তাঁরা দলিত।
আবার সেই দলিত সমাজের নারী যৌনাঙ্গ কিন্তু ভোগ করতে বাধলো না উচ্চবর্ণের মানুষজনের। সেই সমাজের মেয়েটি যখন চরম নির্যাতিত হল, তখন চারদিকে হইহই, দেশের কিছু সংবাদমাধ্যম নড়েচড়ে বসল, কিন্তু এই পরিবার গুলি আশার আলো দেখে না আজও, তারা পরিস্থিতি বদলের আশাও করে না।
আরও পড়ুনঃ ধর্ষকের প্রকাশ্য এনকাউন্টারের পক্ষে সওয়াল লকেটের
৫০ বসন্ত কাটানো ব্যক্তি মেনে নেন, “আমরা দলিত, এটাই আমাদের অপরাধ।” মিডিয়ার এই সব, আড়ম্বরে তাঁরা বরং ভয় পান কারণ বেশিরভাগই কাজ করেন উচ্চবর্ণের মানুষের জমিজিরেতে শ্রমিক হয়ে। মুখ খুললে যদি চাকরি চলে যায়!
১৯ বছরের নির্যাতিতার পরিবারের প্রতিবেশীরা সকলেই ‘উচ্চবর্ণের ব্রাক্ষ্মণ, ঠাকুর’। এমন চরম দুর্দিনে তাঁরা কেউই অবশ্য এই দলিত পরিবারের পাশে এসে দাঁড়াননি। নির্যাতিতার মা এর আক্ষেপ, “আমরা ওঁদের জমি থেকেই গরুর খাবার আনি। ভেবেছিলাম একবার অন্তত খবর নিতে আসবেন।“
আরও পড়ুনঃ দেহ সৎকার ঘিরে পুলিশ কেন এত বাড়াবাড়ি করল- হাতরাসে মৃত তরুণীর পরিবারের প্রশ্ন
নির্যাতিতার কাকিমার গলাতেও সেই একই আক্ষেপ। তিনি বলেন, “আমারও মেয়ে আছে। যদি ঠাকুরদের কারওর সঙ্গে এমনটা হত পুলিশ কখনই এমন আচরণ করতে পারত না।”
এই অত্যাচার চলে আসছে আবহমানকাল। এই সমাজেরই একটি মেয়ে জানালেন তাঁর বিয়ের দিনের স্মৃতির কথা। সমাজে ‘অচ্ছুত’ বলে তাঁর পালকি মূল রাস্তা দিয়ে যাওয়ার অনুমতি পায়নি। তিনি বলেন, “আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল, কিন্তু পরিবারের সকলে আমাকে বোঝালো যে এটাই রীতি। আমাদের আপোস করা শিখতে হবে।”
উচ্চবর্ণের প্রতি এই সমাজের একটাই ক্ষোভ- “আমরা বাঁচলাম কি মরলাম ওঁদের কিছু যায় আসে না।” স্কুলে এদের সঙ্গে কেউ মেশে না, পঞ্চায়েতের মিটিংয়ে এদের ডাক পড়ে না, মৃত্যুর পরও খোঁজ নেওয়া হয় না।
বরং গ্রাম প্রধান বলেন, “যুবকেরা নির্দোষও হতে পারে। আমি পরিবারের মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এমন অভিযোগ করা উচিত নয়।“ নির্যাতিতার পরিবার আজও ক্ষীণ গলায় কেবল একটিবার বলেন, “আমরা দলিত এটাই আমাদের অপরাধ”।
প্রশ্ন উঠছে উত্তরপ্রদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে, প্রশ্ন উঠছে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে, কিন্তু এই জাতপাতের সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে কবে প্রশ্ন উঠবে! শুধু ভোটের সময় কি দলিত থেকে মানুষ হওয়ার সুযোগ পাবেন এঁরা? নাকি সুযোগ করে দেবেন? উত্তর নেই, শুধুই অনন্ত প্রতীক্ষা।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584