নিউজফ্রন্ট, ওয়েবডেস্কঃ
৯ ডিসেম্বর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হয়ে যাওয়ার পর গোটা দেশে এ নিয়ে অনেক সওয়াল-জবাব শুরু হয়েছে। বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলিও ভারতের সাংবিধানিক ব্যবস্থার এই আমূল সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক মন্তব্য, লেখালেখি করছে। নিউইয়র্ক টাইমস এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার ভারতীয় সংসদের একটি কক্ষ থেকে মুসলিম প্রান্তিকীকরণের একটি বিল পাশ করা হয়েছে। মোদি সরকারের হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদকে ঘনীভূত করতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের যেসব অভিবাসী ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে এই বিল পাশ।
এই পদক্ষেপটি ইসলাম বাদে দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত মূল ধর্মের অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্বের একটি সুস্পষ্ট পথ দেবে। ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাসে এটি সবথেকে বড় কূটনৈতিক পদক্ষেপ। স্বাধীনতার পর এই আবার ভারতের ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ তকমায় আঘাত হানা হল।
৩১১/৮০ ভোটে ৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হয়। লোকসভায় পাশ হয়ে বিলটি রাজ্যসভায় যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু রাজ্যসভায় মোদির যথেষ্ট সহকর্মী রয়েছেন, তাই সিএবি আইন হিসাবে জারি হতে কোনও বাধা কাজ করবে না।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের নামে দেশের ২০০ মিলিয়ন মুসলিম নাগরিককে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরকের তকমা দেওয়া হচ্ছে— এই বিষয়টি মুসলিমদের খুব ভাবাচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আইনবিদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসি জানিয়েছেন, আমরা এক সর্বগ্রাসী সরকারের দিকে এগোচ্ছি। দেশটাকে থিয়োরি দিয়ে চালানো হচ্ছে। সংসদে বক্তব্য রাখতে রাখতে আবেগপ্রবণ হয়ে তিনি বিলের একটি কপি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন।
এই বিলটি এই বছর আসামে শুরু হওয়া একটি বিতর্কিত কর্মসূচির সাথে মিলে গেছে, যেখানে রাজ্যের ৩৩ মিলিয়ন বাসিন্দাকে কাগজপত্র-সহ প্রমাণ করতে হয়েছিল যে তারা বা তাদের পূর্বপুরুষরা ভারতীয় নাগরিক ছিলেন। রাজ্যের নাগরিকত্বের তালিকা থেকে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষদের বাদ দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে বেশিরভাগ মুসলমান এবং বেশিরভাগই ভারতের আদি বাসিন্দা।
ওই গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আসামে দুই মিলিয়ন মুসলিম বাসিন্দাকে নাগরিক তালিকা থেকে যেভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেই একই জিনিস মোদি সরকার বাকি রাজ্যগুলির ক্ষেত্রেও করতে চান। শাসক দল বিজেপি-র মূল লক্ষ্যই হল ভারতকে মুসলিমহীন একটি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে রুপান্তরিত করা।
প্রথমে আসামে নাগরিকত্ব তালিকা তৈরি, পরে মুসলিম প্রধান রাজ্য কাশ্মীর থেকে ৩৫-এ, ৩৭৭ ধারা রদ করে, কাশ্মীরকে লাদাখ ও জম্মু-কাশ্মীরে ভাগ করা এবং তার পরে অযোধ্যাতে হিন্দু মন্দির গড়ার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়—এসবই মোদি সরকারকে হিন্দু মৌলবাদী রাষ্ট্র গঠনের মদত জুগিয়েছে।
নতুন নাগরিকত্ব বিল নিয়ে মোদির দল বলেছে যে তারা নিপীড়িত হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানদের (এবং কয়েকটি সংখ্যা লঘু ধর্মের বাসিন্দাদের) যারা মূলত মুসলিম দেশ(পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ) থেকে ভারতে চলে এসেছিল তাদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে।
তবে ভারতে বহুদিন ধরে বাস করা মুসলিম বংশধরের সদস্যরা যদি সঠিক প্রামাণ্য নথি না দেখাতে পারে, তবে তাদের কারাগারে বন্দী বা নির্বাসন পর্যন্ত হতে পারে।
মোদির শাসনকালে, মুসলিমবিরোধী এই মনোভাব মূলধারার জনসাধারণের কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সমীক্ষা বলছে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ভয় ও হামলা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আরও বেড়েছে। পাশাপাশি হিন্দু ধার্মিকতা এবং জাতীয়তাবাদের প্রকাশ্য চিত্রগুলি সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
খ্যাতনামা ভোজপুরী নায়ক ও সংসদ সদস্য রবি কিষান সিটিজেনশিপ বিল সম্পর্কে বলেছেন, পৃথিবীতে মুসলিম প্রধান দেশ আছে, আছে ইহুদি প্রধান দেশও। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা নিজস্ব পরিচয় আছে। আমরা সংখ্যায় এক বিলিয়ন এরও বেশি। তাই আমাদের অবশ্যই একটি পরিচয় থাকতে হবে।
রবি কিষানকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, উনি হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্র গঠনের কথা বলছেন কি না, তখন উনি হেসে বলেন, ভারতবর্ষ বরাবরই হিন্দু রাষ্ট্র ছিল। এদেশে যারা মুসলিম, তারাও মূলত হিন্দু (এটি একটি হিন্দু মৌলবাদী ধারণা)। সমস্ত হিন্দু মৌলবাদীরাই বিশ্বাস করেন, ভারতে বসবাসকারী মুসলিমরা, সম্প্রতি ধর্মান্তরিত হয়েছে। শত শুত বছর আগেই যে মুসলিমরা ভারতে প্রবেশ করে এখানকার অধিবাসী হয়ে যায়, এই ধারণাকে বিশ্বাস করতে তারা নারাজ।
লোকসভায় আইনজীবীদের নাগরিকত্ব বিলের পক্ষে ভোট দেওয়ার অনেক আগেই এর বিরোধিতা করে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল দেশের নানা প্রান্তে। আসামে গত গ্রীষ্মে যখন নাগরিকত্ব কর্মসূচি শুরু হয়েছিল, হাজার হাজার মানুষ তখন রাস্তায় মিছিল করেছিলেন। প্ল্যাকার্ড উঠিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে বিলের বিরোধিতা করেছিলেন। এমনকি মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কুশপুতুলও ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
অন্যদিকে, বিরোধী জাতীয় কংগ্রেস দলের নেতাদের দাবি, এই বিলটি ভারতের গণতন্ত্রের জন্য সবথেকে বড় বিপদ। দেশ স্বধীন হওয়ার পরে, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠাতা নেতারা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং জওহরলাল নেহেরু একটি সিদ্ধান্ত স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছিলেন যে দেশে ৮০ শতাংশ হিন্দুদের বাস হলেও এই দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কখনওই হিন্দু জাতি হিসাবে পরিগণিত হবে না। সংখ্যালঘু বিশেষত মুসলমানদের সাথে সমান আচরণ করাই সমীচীন ভাবে ধরা হবে।
আরও পড়ুনঃ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশের প্রতিবাদে ডিব্রুগড়ে প্রতিবাদীদের বিক্ষোভ
পার্টির নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, “ভারত প্রত্যেকের, সমস্ত সম্প্রদায়, সমস্ত ধর্ম, সমস্ত সংস্কৃতির অন্তর্গত।” পাশাপাশি পার্টির বুদ্ধিজীবী হেভিওয়েট শশী থারুর এই বিলটিকে ‘সর্বাত্মক আক্রমণ’ বলে অভিহিত করেছেন।
তবে কংগ্রেস পার্টি তার ১০০ বছরেরও বেশি ইতিহাসে একটি নেতিবাচক দিক হল, বিজেপি দলের সংখ্যা গরিষ্ঠ কর্মী সমর্থক লোকসভার দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ন্ত্রণ করে।
মোদি সমালোচকদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে এই বিলটি জনগণকে অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন করতে পারে। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই রকম অর্থনৈতিক দূরাবস্থা আগে আর কখনও আসেনি। বড় বড় শিল্পাঞ্চল, অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে এইরকম মন্দা আগে এভাবে আসেনি।
আসামের মানবাধিকার আইনজীবী আমান ওয়াদুদ এই বিষয়ে বলেছিলেন, অর্থনীতির চূর্ণবিচূর্ণ অবস্থা। সিএবি দেশের মেরুকরণ এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করার একমাত্র ইস্যু।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584