শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতাঃ
সুদীর্ঘ লকডাউনে যেন পালটে গিয়েছে পুলিশের কাজের ধরনই। যে পুলিশকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা থেকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হতে দেখা যেত, এখন তাদের কাজ মানুষকে কনটেনমেন্ট জোনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, গরিব অসহায় নাগরিকদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করাটাই যেন এখন পুলিশের প্রধান কাজ। ঠিক যে কাজটা আগে করতেন সমাজসেবী থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা।
তাহলে কি রাজ্যে অপরাধ একেবারেই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে? লালবাজারের একটি সূত্রের দাবি, সাধারণ চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন থেকে ধর্ষণের মত অপরাধ বাস্তবিকই বিপুল হারে কমে গিয়েছে। কিন্তু লকডাউনের সৌজন্যে সাইবার ক্রাইম বেড়ে গিয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ।
লালবাজার সূত্রে জানা গিয়েছে, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত লকডাউন মেয়াদের সময় দৈনিক অপরাধের গড় কমতে কমতে একসময়ে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি চলে এসেছিল। সংক্রমণের ভয়ে অপরাধীরাও গৃহবন্দি হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি জেল থেকে অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়ার পরেও অপরাধ বাড়েনি। চুরি, ডাকাতির মামলা দায়ের করতেই হয়নি পুলিশকে।
আরও পড়ুনঃ সহকর্মী কোভিড পজিটিভ, গৃহবন্দি সুজন চক্রবর্তী
তাছাড়া পুলিশকর্তারা এটাও দাবি করছেন, শহরের রাস্তায় লকডাউনের সময় পুলিশের নজরদারি চলত সর্বক্ষণ। কোনও বৈধ কারণ ছাড়া কেউ যাতে লকডাউনের নিয়ম না ভাঙে সেই কারণে শহরের রাস্তায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। কারও পক্ষে মোটরবাইক চুরি করাও কার্যত সম্ভব হচ্ছিল না কারণ প্রায় কেউই তাদের যানবাহন রাস্তায় রেখে দিচ্ছিল না।
তবে এই চিত্রটাই বদলে যায় লকডাউনের শিথিলতার সময়। করোনা শারীরিক সংস্পর্শের রোগ হওয়ায় ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির মতো অপরাধ সেভাবে না ঘটলে আবার জুন-সেপ্টেম্বরে ধীরে ধীরে ঘটতে শুরু করেছে খুন, পরিচারিকা বা কর্মীর মাধ্যমে চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি।
আরও পড়ুনঃ নদিয়ায় যুবকের আত্মহত্যার চেষ্টা, রুখল কলকাতা পুলিশ
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, মার্চ থেকে মে মাসে যেখানে সারা কলকাতায় চুরি ১৬ থেকে ৫টি তে, ডাকাতি ১১ টি থেকে ১ টি তে নেমে এসেছিল, সেখানে তা আনলক থ্রি এবং ফোর পর্যায়ে কিছুটা হলেও বেড়ে গিয়েছে। তবে সমস্তকিছু ছাড়িয়ে যে অপরাধ সমস্ত কিছুর সীমা ছাড়িয়ে গেছে সেটা হলো সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণা।
মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়লে যে ডিজিটাল দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়বে, সমস্ত লেনদেন থেকে কাজকর্ম আর ডিজিটাল মাধ্যমে হবে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু সাইবার দুনিয়ার সম্পূর্ণ হাল-হকিকত না জানার ফলে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন মানুষকে পড়তে হয়েছে সাইবার ক্রাইম এর মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণা এবং সম্মানহানিতে।
আরও পড়ুনঃ করোনা সন্দেহে প্রতিবেশীদের হেনস্থার শিকার বিমানসেবিকা
লালবাজারের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ ও ২০১৯-এর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত যত সংখ্যক অনলাইন-সাইবার অপরাধের অভিযোগ এসেছিল, এ বছর তার থেকে গড়ে ৩৫ শতাংশ বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। অর্থাৎ করোনা-ত্রাসে লকডাউনের সময় সাধারণ মানুষের ঘরবন্দি অবস্থা অনলাইনে পকেট কাটার সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে প্রতারকরা।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাদের বক্তব্য, এই পর্বে যতগুলি অনলাইন বা সাইবার অপরাধের ঘটনা সামনে এসেছে, তার ৯০-৯৫ শতাংশের পিছনেই রয়েছে সেই জামতাড়া গ্যাং।শুধু লালবাজার নয়, কলকাতা লাগোয়া অন্য তিনটি পুলিশ কমিশনারেট এলাকাতেও এই পর্বে গড়ে অন্তত ১০ শতাংশের মতো বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের অনলাইন প্রতারণা।
প্রসঙ্গত, সাধারণ মানুষের মধ্যে ওয়ার্ক ফ্রম হোম এবং অনলাইন পেমেন্টের প্রবণতা বেড়েছে। ফলে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলার সুযোগও পাচ্ছে প্রতারকরা। এখন মানুষকে কেউ সাহায্যের নামে ফোন করলে তা পাল্টা যাচাই করার সুযোগ অনেক সময় থাকছে না আর সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছে জামতাড়া গ্যাং।
কিন্তু আর্থিক প্রতারণা বাড়লেও পরিবহণ সমস্যার কারণে গত প্রায় ৬ মাসে জামতাড়া গ্যাংয়ের বিশেষ কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। লকডাউন পর্বে পুলিশ বাইরের কাজে বেশি ব্যস্ত থাকায় সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছে প্রতারকরা। তবে মঙ্গলবারই নবান্নে পুলিশ দিবস উদযাপনের সময় রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের সাইবার ক্রাইম শাখাকে বিশেষ জোর দিয়ে শক্তিশালী করার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
তাই এবার ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখার সঙ্গে আরও প্রযুক্তিনির্ভর সাইবার থানা গড়ার প্রচেষ্টা শুরু করেছেন লালবাজারের আধিকারিকরা। গত ছয় মাসে জমে থাকা সমস্ত সাইবার অপরাধ দ্রুত নিষ্পত্তির সঙ্গে সঙ্গে যাতে রাজ্যের সাইবার সুরক্ষা আরো মজবুত করা যায়, আপাতত সেদিকেই চেষ্টা রয়েছে রাজ্যের পুলিশ আধিকারিকদের।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584