প্রীতম সরকার
“দাদা, এটা হলো মুকুল বাড়ি’ (মুকুলের বাড়ি)”- গাইড বিজয় অগ্রবাল হিন্দি টানে বাংলাভাষায় আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন একটি ছাদ হীন ভাঙ্গা বাড়িকে। এই বাড়িটিকে জাতিস্মর মুকুলের বাড়ি হিসাবে দেখিয়ে ফেলুদার সোনার কেল্লা ছবির শুটিং করেছিলেন সত্যজিৎ রায়।
থর মরুভুমির বিশাল বালিয়াড়ির মাঝে সোনালি হলুদ পাথরের তৈরি কেল্লা এখন রাজস্থানের আকর্ষনের অন্যতম। যার ওপর রোদ পড়লে যেন মনে হয়,হলুদ মরুভূমির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে সোনায় মোড়া কেল্লাটি।যার আসল নাম ‘জয়সলমীর ফোর্ট’। যাকে বাংলা কেন, সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত করেছেন সত্যজিৎ রায়। ‘সোনার কেল্লা’ নামে। সোনার কেল্লা এখন ভ্রমন পিপাসুদের কাছে এক বিস্ময়।
ইতিহাস অনুযায়ী ১১৫৬ সালে যাদব বংশীয় ভাট্টি রাজপুত রাওয়াল জয়সওয়াল তার পুরানো দূর্গ ছেড়ে ত্রিকুট পাহাড়ের উপর গড়ে তুলেছিলেন তার রাজধানী।গোয়েন্দা ফেলুদা-র রহস্য কাহিনীর পটভূমিতে তৈরি সিনেমায় জয়সলমীর ফোর্ট’ হয়ে উঠেছে ‘সোনার কেল্লা’। নামটি দিয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির লোকেশন দেখতে গিয়ে এবং ছবির একটি অংশের শুটিং করার সময় এই কেল্লাটিকে নিয়ে ফেলুদার গল্প এবং পরে ছবি করার চিন্তাভাবনা মাথায় আসে সত্যজিতের।জাতিস্মর মুকুলকে নিয়ে তৈরি ফেলুদার ছবি সোনার কেল্লা মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর। এরপরেই সোনার কেল্লা সিনেমা দেখতে দর্শকের আকর্ষন যেমন বেড়েছে, তেমনই পাল্লা দিয়ে ভ্রমন পিপাসুদের ভিড় বেড়েছে জয়সলমীরে।
কার্যত, পাকিস্তান সীমান্ত প্রায় লাগোয়া জয়সলমীরের স্থানীয় বাসিন্দারা স্বীকার করতে বাধ্য হন, সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা সিনেমা বদলে দিয়েছে মরু শহর জয়সলমীরের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো।সত্যজিৎ রায়ের দেওয়া নামেই এখন বিখ্যাত ‘সোনার কেল্লা’।
অনেকেরই জানা নেই, পরিচালক সত্যজিৎ রায় সোনার কেল্লা ছবিতে তাঁর প্রিয় ফটোগ্রাফার নিমাই ঘোষকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন। ছবির প্রায় শুরুতে ‘জাতিস্মর মুকুল’ যখন সাংবাদিককে তাঁর পূর্বজন্মের কথা বলছিল, সেসময় যে ফটোগ্রাফার ‘মুকুলের’ ছবি তুলেছিলেন, সেই ফটোগ্রাফারটি ছিলেন স্বয়ং নিমাই ঘোষ। যে ছবি দেখেই ‘নকল হাজরা’ মুকুলকে কিডন্যাপের ছক করেছিল।
সোনার বালি পাথরের তৈরি ৮০ মিটার উচু কেল্লাটি ৯৯টি বুরুজের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে কেল্লার আনাচে কানাচে আজও ‘গাইডের’ উচ্চারিত বাংলা ভাষার কিছু শব্দ কানে এসে পৌঁছয়। ‘জটায়ু’, ‘তোপসে’, ‘ডক্টর হাজরা’, ‘ফেলুদা’, ‘মুকুল বাড়ি’ নামগুলি। সত্যজিৎ রায়ের গল্পে জাতিস্মর মুকুলকে সোনার কেল্লার গুপ্তধনের লোভে কিডন্যাপ করেন নকল ডক্টর হাজরা এবং মন্দার বোস। রাজস্থানে মুকুলের বিপদ ঘটতে পারে আশঙ্কায় গোয়েন্দা ফেলুদাকে রাজস্থানে পাঠান মুকুলের বাবা। এই গল্পেই রাজস্থানে যোধপুর আসার পথে ফেলুদাদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলীর।
সিনেমায় ফেলুদাদের যোধপুর থেকে বিকানির পর্যন্ত মোটরে পৌঁছে ‘ভিলেন’ মন্দার বোসের চক্রান্তে অনেক কসরত করে উটে চেপে তারপর আবার ট্রেনে চেপে পৌঁছতে হয়েছিল জয়সলমীরে, সতো সকলেরই জানা। সিনেমাতে এই পথের দৃশ্য, মরুভূমি বা জটায়ুর উটে চাপার অভিজ্ঞতার দৃশ্য এমনভাবে সত্যজিৎ রায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যে আজও এই উট যাত্রার ছবি জয়সলমীরের অলিখিত ‘লোগো’।
জয়সলমীরের হোটেল ব্যবসায়ী থেকে অটোচালক সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন, সত্যজিৎ রায় যদি তাঁর সোনার কেল্লা সিনেমায় জয়সলমীরকে এভাবে না দেখাতেন, তবে এই মরু শহর এত বিখ্যাত হত না। এখানে ঘুরতে আসা টুরিস্টদের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশই বাঙালী। শহরের প্রায় প্রতিটি দোকানে ঝুলছে সত্যজিৎ রায় এর ফটো।
সোনার কেল্লা সিনেমায় দূর্গটিকে যেমন ফাঁকা ফাঁকা দেখানো হয়েছিল,বাস্তবে কিন্তু আদৌ তা নয়।কার্যত, জয়সলমীর শহরের একটা বড় অংশই রয়েছে দূর্গের ভিতরে। দূর্গের ভিতরেই বসবাস করেন কয়েক হাজার মানুষ।হোটেল, বাড়ি, দোকানপাট, রেস্তোরা সবই রয়েছে কেল্লার ভিতরে। কেল্লার ভিতরে এমনই একটি দোকান চালান কলকাতার ভবানীপুরের এক সময়ের বাসিন্দা কিশোর গাঙ্গুলী।
জয়সলমীরে যিনি ‘কিশোরদা’ নামেই বিখ্যাত। এক বিচিত্র গল্প শুনিয়েছেন তিনি। বছর পঞ্চাশের কিশোরদা জানালেন,৭০-এর দশকে সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা সিনেমা দেখে উদ্ভুদ্ধ হয়ে সেই যে কলকাতার বাড়ি ছেড়ে সোনার কেল্লায় এসেছেন,তারপর থেকে গিয়েছেন সেখানেই।
বছরে একবার কলকাতার বাড়িতে অবশ্য যান।সোনার কেল্লার ভিতরে তাঁর দোকানে টাঙিয়ে রেখেছেন সত্যজিৎ রায়ের ছবি।দোকানে মূলতঃ বিক্রি করেন বেলে পাথরের তৈরি থালা, গ্লাস, বাটি সহ নানা সামগ্রী। সোনার কেল্লা সিনেমায় যোধপুরের দোকানে ফেলুদা যেসব হলুদ পাথরের তৈরি গ্লাস, বাটি-কে দেখে সন্দেহ হওয়ায় জানতে পেরেছিলো, জয়সলমীরে এই ধরনের পাথর পাওয়া যায়। তারপরেই ছুটে গিয়েছিল জয়সশলমীরে। রহস্য উদ্ঘাটন হয়েছিল ‘ভবানন্দ-মন্দার’-এর। সত্যি, হলুদ বেলে পাথরের দূর্গের সার্থক নামকরন করেছিলেন সত্যজিৎ রায় –‘সোনার কেল্লা’।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584