শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতাঃ
ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে গরু পাচারের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। কিন্তু এতদিন ধরেও রাজ্যে গরু পাচার আটকানো যাচ্ছে না কেন, তার তদন্তে খোদ বিএসএফ কর্তাদের যুক্ত থাকার চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে সিবিআই গোয়েন্দাদের হাতে।
আর সেখান থেকেই গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, সীমান্তের এপারে এনামূল হক এবং ওপারে হাজি মস্তান ওরফে হুণ্ডি বা আবু তালেবের যুগলবন্দিতে দু’পারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে রমরমিয়ে চলছে গরু পাচার। শুধু গরু পাচার নয়, সোনা থেকে আরম্ভ করে মানুষ পাচারেরও একাধিক কর্মকান্ডের মূলে এরা দু’জনই।
এই চাঞ্চল্যকর তথ্য সিবিআই পায় প্রথমে বিএসএফ কমান্ড্যান্ট সতীশ কুমারের বাড়ি তল্লাশি চালানোর পর। জানা গিয়েছে, বিএসএফ কমান্ড্যান্ট সতীশ কুমার ২০১৭-১৮ সাল নাগাদ মালদহের বৈষ্ণবনগরের ৩৬ নম্বর ব্যাটেলিয়ানে কমান্ড্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন।
এই ৩৬ ব্যাটেলিয়ান মালদহ জেলার বৈষ্ণবনগর থানার সবদালপুর থেকে মুর্শিদাবাদ জেলা লালগোলা থানার খাণ্ডোয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা কাঁটাতার হীন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত, যে এলাকা দিয়ে বিপুল পরিমাণে গরু পাচার হত।
আরও পড়ুনঃ মুর্শিদাবাদের গরু পাচারের ‘বাদশা’ এনামুলের বাড়িতে হানা সিবিআইয়ের
উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, বিহার ও ঝাড়খন্ড থেকে মূলত গরু নিয়ে আসা হয় বীরভূম জেলার ইলামবাজারে। সেখানে ছোট ছোট গাড়ি করে গরুগুলি মুর্শিদাবাদের নিমতিতার মহলদার পাড়া, ও মালদহের বৈষ্ণবনগর থানার চালাক পাড়া এলাকায় জমা করা হয়। সেখানে গরু গুলির গায়ে বিভিন্ন দালালদের কোড নম্বর বসানো হয়।
মালদহের শোভাপুর, পারদেনাপুর, মুর্শিদাবাদ জেলার নিমতিতা, চাঁদনী চক, খান্ডুয়া দিয়েও ওই সময়ে একই ভাবে গরু বাংলাদেশে পাচার হত। ভরা বর্ষার সময় রাতের অন্ধকারে গঙ্গা নদী পার করে এই গরুগুলি বাংলাদেশের বাখের আলী, জহরপুর, জহুর টেক এই সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে যেত।
আরও পড়ুনঃ পাকিস্তানের গৌরব সন্ত্রাসবাদ, রাষ্ট্রসংঘে জানাল ভারত
কিছুদিন আগে বিএসএফের বহরমপুর সেক্টরে কর্মরত জিবিইউ ম্যাথু নামে এক কমান্ড্যান্টকে কয়েক কোটি টাকা সহ দক্ষিণ ভারতের এর্নাকুলাম থেকে গ্রেফতার করে সিবিআই।
সেখানে জেরা করে উঠে আসে প্রথম কুখ্যাত হাওয়ালা ট্রেডার গরু পাচারকারী এনামুল হকের নাম। ২০১৮ সালের ৬ মার্চ ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয় গরু পাচার চক্রের মূল পাণ্ডা এনামুল হক। পরে সে জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়।
প্রাথমিক ভাবে সিবিআই জানতে পেরেছে, মুর্শিদাবাদ জেলায় বেশ কয়েকটি কারখানা রয়েছে। কলকাতায় প্রচুর সম্পত্তি রয়েছে। মুর্শিদাবাদের বাড়ি ছাড়াও কলকাতার বেনিয়াপুকুরে, দিল্লিতে বাড়ি রয়েছে অভিযুক্ত এনামুল হকের।
এমনকি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে এনামুলের সম্পত্তি। দুবাই, বাংলাদেশ, নেপালে বাড়ি আছে এনামুলের। এনামূলের তিন ভাগ্নে বিদেশ থেকে হাওয়ালার প্রচুর টাকা তার হাতে এনে দেয়, এমন তথ্যও এসেছে সিবিআই গোয়েন্দাদের হাতে।
সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে এনামুলের আরেক সহযোগী হাজি মস্তান এই কারবারের অন্যতম। জানা গিয়েছে, তার পুরো নাম হাজি আবু তালেব ওরফে হুন্ডি হাজি। তার নিয়ন্ত্রণে চলে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে গরু, অস্ত্র, মাদক এবং সোনার বার পাচার।
এনামূলের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই চলে এই কারবার। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্তে বিশেষ করে চাঁপাই নবাবগঞ্জ সীমান্তে প্রশাসনের নাকের ডগায় চালাচ্ছে এই পাচারের ব্যবসা। ভারত বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জের চারটি সীমান্ত দিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে রসিদ ছাড়াই হাতিয়ে নেওয়া গরু পাচার করে ভারতে এনামূলদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের ৪টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি গরু আসছে। এই জেলার সীমান্ত পথে গত ২ মাসে প্রায় ৪০ হাজার গরু এসেছে ভারত থেকে। চাঁপাই নবাবগঞ্জের ওয়াহেদপুর, ফতেপুর, জোহরপুর,টেক পয়েন্ট দিয়ে, সন্ধ্যার পরই সীমান্ত অতিক্রম করে নির্বিঘ্নে দৈনিক ১০০০ এর বেশি গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আর এই পাচার চক্র থেকে ভাগ-বাটোয়ারার সমস্ত টাকাটাই ভাগ করে নেয় এনামূল এবং হাজি মস্তান।
২০১৯ সালে হারুদাঙ্গা এলাকায় পাচারের সময় গরুর গলায় সকেট বোমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তবে বিএসএফ-এর নজরে পড়ে যায় সেই বোমা। বোমা উদ্ধার করতে সক্ষম হন বিএসএফ জওয়ানরা। এখন তদন্তে নেমে সিবিআই মনে করছে, সেটার পিছনেও এনামুলের হাত ছিল।
বহু প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে এনামুলের। একইভাবে বাংলাদেশেও বহু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে ওঠাবসা রয়েছে হাজি মস্তানের। সেই কারণেই বিএসএফকে চোখের সামনে রেখেই রমরমিয়ে চলছিল গরু পাচার ব্যবসা। তবে এবার এই যৌথ পাচার চক্রের পর্দাফাঁস করতে বদ্ধপরিকর সিবিআই গোয়েন্দারা।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584