করোনার জেরে থমকে শিশুদের টিকাকরণ, বাড়ছে অন্য রোগে আক্রান্তের ভয়

0
72

শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতাঃ

করোনা সংক্রমণের ভয়ে বয়স্কদের মত মারাত্মক বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে শিশুরাও। জন্মের পর থেকেই যে নিয়মিত টিকাকরণ কর্মসূচি চলতে থাকে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের আতঙ্কে বিশ্বের একাধিক দেশ-সহ এ দেশেও তা থমকে গেছে। ব্যতিক্রম নয় এ রাজ্যের শিশুরাও। এতে করোনা আক্রান্ত না হলেও হাম বা মিজলসের মতো বড় সংক্রামক রোগের স্বীকার হতে পারে শিশুরা, এমন আশঙ্কা করছেন অনেক চিকিৎসকরাই।

vaccination | newsfront.co
প্রতীকী চিত্র

সারা বিশ্ব প্রায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণে জর্জরিত। ইউরোপ, আমেরিকায় চলছে মৃত্যু মিছিল। এই পরিস্থিতিতে সকলের অগোচরেই উঁকি দিতে শুরু করেছে শিশুদের এই নতুন বিপদ। করোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে বন্ধ রাখতে হয়েছে টিকাকরণ কর্মসূচি। আর চিকিৎসকরা বলছেন, আপাতত বিপদ না হলেও দ্রুত টিকাকরণ শুরু না হলে বড় বিপদের মুখে পড়তে হবে শিশুদের।

আরও পড়ুনঃ করোনা প্রতিরোধে আরও আগ্রাসী প্রশাসন, কলকাতার ১১২ রাস্তা ‘কনটেনমেন্ট’ চিহ্নিত

হাম, পোলিয়ো, হুপিং কাশির মতো সংক্রামক রোগ ফিরে এসে বহু শিশুকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারে, আশঙ্কা ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স (আইএপি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু)। করোনার সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে গত ২৪ মার্চ পোলিও টিকাকরণ কর্মসূচি জুন পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় হু-এর গ্লোবাল পোলিও ইরাডিকেশন ইনিশিয়েটিভ (জিপিইআই)।

প্রসঙ্গত, প্রতি বছর ৪০-৪৫ কোটি শিশুকে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে পোলিওর প্রতিষেধক দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, গোটা বিশ্বের সমস্ত দেশকে গণ টিকাকরণ বন্ধ করার পরামর্শও দেওয়া হয় হু-এর তরফে। বিপদের কথা হল, শুধু গণ টিকাকরণই নয়, গোটা দেশে অনিয়মিত হয়ে পড়েছে সুসংহত টিকাকরণ কর্মসূচিও।

সম্প্রতি বিজ্ঞানপত্রিকা সায়েন্স-এ প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যেই ১.৩৫ কোটি শিশু হাম, পোলিয়ো, কলেরা, এইচপিভি, মেনিঞ্জাইটিস, পীতজ্বরের প্রতিষেধক থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আইএপি প্রকাশিত নির্দেশিকায় তুলে ধরা তথ্য-পরিসংখ্যান বলছে, লকডাউন শুরুর পর প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত টিকাকরণ থেকে এ দেশে বঞ্চিত হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ শিশু। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের এই সর্বভারতীয় সংগঠনের অনুমান, গোটা লকডাউন পর্যায়ে শুধু ভারতেই ৩২ লক্ষেরও বেশি শিশু আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে বঞ্চিত হবে টিকাকরণ থেকে। আর বিপদটা লুকিয়ে সেখানেই।

ঘটনা হল, জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বিসিজি, হেপাটাইটিস-বি এবং পোলিয়োর জিরো ডোজ প্রতিষেধক পায় সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে জন্মানো সদ্যোজাতরা। একরত্তিরা এখন শুধুমাত্র সেই টিকাগুলিই পাচ্ছে। বাদবাকি প্রায় সব টিকা থেকেই তারা বঞ্চিত। যেমন, জন্মের ছ’সপ্তাহের মাথায় পোলিয়ো ইঞ্জেকশন, ডিপিটি (ডিপথেরিয়া-হুপিং কাশি-টিটেনাস), নিউমোনিয়া, কলেরা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগের প্রথম টিকা পায় শিশুরা। সেগুলি তারা কিছুই পাচ্ছে না।

আটলান্টার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) বলছে, ভারত-সহ ২৩টি দেশের ৭.৯০ কোটি শিশু নির্দিষ্ট সময়ে হামের টিকাকরণ থেকে বঞ্চিত হবে লকডাউন দীর্ঘায়িত হওয়ার ফলে। ২০১৮ সালে হু-র দেওয়া পরিসংখ্যান বলছে, গোটা পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি শিশু আক্রান্ত হয় হামে। মৃত্যু হয় দেড় লক্ষের।ভারতে আক্রান্তের সংখ্যাটা প্রায় ৪-৫ লক্ষ।

বিশেষজ্ঞদের অনুমান, সঠিক সময়ে হামের টিকা না পাওয়ায় করোনা প্রকোপ মিটতেই অতিসংক্রামক হামের প্রকোপ দেখা দিতে পারে, যা কেড়ে নেবে হয়তো অনেক প্রাণ। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, পোলিওর মতো রোগের প্রকোপও ফিরে আসতে পারে যা হয়তো পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে পরবর্তী প্রজন্মকে।

স্বাস্থ্য দপ্তরের হিসেব বলছে, ফি বছর রাজ্যের প্রায় ১৫ লক্ষ শিশু টিকাকরণ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোর সঙ্গেই জেলা হাসপাতালগুলির পোস্ট-পার্টাম ইউনিটে নিয়মিত টিকাকরণের ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু সন্তানকে নিয়ে সেখানে পৌঁছেই উঠতে পারছেন না বাবা-মায়েরা। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সুব্রত চক্রবর্তীর কথায়, ‘লকডাউনে শিশুদের নিয়ে বাইরে বেরোলে করোনা সংক্রমণের ভয়। আবার টিকা না দিয়ে বাড়িতে বসে থাকলে অন্য বিপদের আশঙ্কাও চরমে।’

ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক অরুণালোক ভট্টাচার্যের কথায়, জরুরি পরিস্থিতি টিকাকরণ এক থেকে ২ মাস পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তার বেশি দেরি হলে বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধিতে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। শিশুদের সাধারণ ভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা কম থাকে। জন্মের পর সাধারণ আবহাওয়া বদলের কারণেও জ্বর, সর্দি, কাশিতে ভুগতে শুরু করে। তাই হাম, মিজলসে বা মাম্পসে আক্রান্ত হতেই পারে শিশুরা। ফের থাবা বসাতে পারে পোলিও, হেপাটাইটিসের মতো রোগগুলিও।

প্রসঙ্গত, ইউনিসেফের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ২৪টি দেশের শিশুরা হামে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে। একমাত্র টিকাকরণ কর্মসূচি পিছিয়ে দেওয়ার জন্যই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ, কঙ্গো, ব্রাজিল, দক্ষিণ সুদান, নাইজেরিয়া, ইউক্রেন, কাজাখস্তানের শিশুরা হাম বা মিজলসে ভীষণভাবে আক্রান্ত হয়েছে। শুধুমাত্র কঙ্গোতেই হাম বা মিজলসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৬০০০ শিশুর। কাজেই এদেশেও এমনকি রাজ্যেও বিপদসীমার মুখেই দাঁড়িয়ে রয়েছে শিশুরা।

আরেক নামী শিশু চিকিৎসক উমাশঙ্কর সরকারের কথায়, লকডাউনের দিন পিছোতে থাকলে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের এই নিয়ে সুস্পষ্ট নীতি নেওয়া উচিত। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চেরও এই নিয়ে হস্তক্ষেপ করা উচিত। নতুবা লকডাউন চলাকালীন সমস্যা তো বাড়বেই, এমনকি তুলে দেওয়া হলেও এদের ভিড়েই উপচে পড়বে রাজ্যের হাসপাতালগুলি। তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মত অবস্থা থাকবে না রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের কাছে। যাতে অন্তত ব্লক কিংবা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্তর পর্যন্ত টিকাগুলো পৌঁছে দেওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করতেই হবে স্বাস্থ্য দফতরকে।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here