অযোধ্যা রায়ের পিছনে সম্ভাব্য পাঁচটি যুক্তি

0
125

নিউজফ্রন্ট, ওয়েবডেস্কঃ

five agreement behind of ayodhya case | newsfront.co
ফাইল চিত্র

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দির হওয়ার নির্দেশ মঞ্জুর হওয়ার পিছনে কয়েকটি ভিত্তি ছিল। খুলে বললে দাঁড়ায়, বিচারকরা যে যে মামলা আর প্রমাণের উপর দাঁড়িয়ে হিন্দুদের নামে সেই বিতর্কিত জমির রায় দিলেন, সেগুলো কতকটা এরকমঃ

অবস্থান স্বীকৃতিকরণ :

মুসলিম গোষ্ঠীর একটি আদি বিশ্বাস হল দখলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা। ভারতীয় আইনে জমির মালিকানা নির্ধারণ দুই ভাবে হয়ে থাকে—প্রতিকূল দখল ও একচেটিয়া দখল। প্রতিকূল দখল একমাত্র সেই সময়েই কার্যকরী হয়, যখন একটি সম্পত্তির উপর দীর্ঘ ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কোনও গোষ্ঠীর মালিকানা থাকে।

মুসলিম আবেদনকারীরা দাবি করেছেন যে তারা ১৫২৮ সাল থেকে মসজিদটি দখল করে রেখেছিল এবং ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত রেখেছিল। এমনটা করা হতো না যদি রামের মূর্তিগুলি মসজিদে অবৈধভাবে স্থাপন করা হতো। ফলস্বরূপ, মুসলিম সমাজ প্রতিকূল দখলের মাধ্যমে মন্দির দখল করে।

আদালত এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে– হিন্দুদের বিতর্কিত জায়গার অংশগুলিতে নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার ছিল। তাই এই একচেটিয়া দখলটি অযোগ্য হিসেবে গণ্য করা হবে। বলা হয়েছে, রামবচূত্র, সীতা রসোই এবং যেখানে ভান্ডার স্থাপিত করা হয়েছিল সেই ধর্মীয় স্থানগুলিতে হিন্দুরা উপাসনা করত।

বাইরের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণটিও ছিল তাদের এক্তিয়ারভুক্ত। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশরা একটি প্রাচীর নির্মাণ করে। এরপর থেকে অভ্যন্তরীণ গম্বুজটির নিকটতম স্থানে রামবচূত্র স্থাপন করা সত্ত্বেও, হিন্দুরা তিন গম্বুজযুক্ত কাঠামোর ভিতরেই উপাসনা করত—এসবই অর্ডার এ বলা রয়েছে।

কোর্ট উল্লেখ করেছে, মন্দিরের ভিতরের প্রাঙ্গণটির দখল নিয়ে ১৮৫৭ সালের আগে সুন্নি বোর্ডের কোনও মামলাও নেই। সুতরাং, বলাই বাহুল্য যে ওই প্রাঙ্গণটি হিন্দুদের দখলেই ছিল।

অপরিহার্য বিভাজন :

বেঞ্চ পরামর্শ দিয়েছিল, মন্দিরের ভিতর ও বাইরের প্রাঙ্গণের মধ্যে বিভাজন না থাকাই ভাল। সমগ্র প্রাঙ্গণটি সামগ্রিক ভাবে দেখাই শ্রেয়। জানা গিয়েছে, আগে যেখানে ‘গর্ভ গৃহ’ ছিল অর্থাৎ যে স্থানে হিন্দুরা প্রার্থনা করত, সেটির অবস্থান ছিল মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজের ঠিক পাশে। হিন্দুদের বিশ্বাস ঠিক সেখানেই ভগবান রামের জন্ম হয়েছিল।

একটি অর্ডার থেকে জানা গিয়েছে, ১৮৫৭ সালে ওউধ ব্রিটিশদের দখলে চলে এলে হিন্দুরা মন্দিরের অন্তর্বর্তী প্রাঙ্গণে উপাসনা করত।

এরপর ১৮৫৬-৫৭ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার জেরে ব্রিটিশরা দুই প্রাঙ্গণের মধ্যে একটি প্রাচীর তৈরি করে, দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গা ঠেকানোর জন্য। ভিতরের প্রাঙ্গণটি ব্যবহার করত মুসলিমরা। বাইরের প্রাঙ্গণটি ছিল হিন্দুদের জন্য। সেখানেই ছিল ‘সীতা রসোই’, ‘রামচবূত্রে’র মতো উপাসনা স্থলগুলি গড়ে উঠেছিল।

ধর্মীয় বিশ্বাস যথেষ্ট নয় :

২০১০ সালে এলাহাবাদ উচ্চ আদালতে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ শীর্ষক মামলার বিশ্বাসের ভিত্তিতে দেওয়া রায়ের বিপরীতে, সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন বিচারকের বেঞ্চ জানিয়েছিল, “আদালত শুধুমাত্র বিশ্বাস বা আস্থার ভিত্তিতে রায় পেশ করার সিদ্ধান্ত নেয় না, প্রমাণের ভিত্তিতে নেয়।”

আদালতের বিধি অনুযায়ী, “সাংবিধানিক শাসনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসাবে এই আদালতের উচিত ধর্মতত্ত্বের মতবাদের বহু সম্ভাব্য ব্যাখ্যার মধ্যে একটি বেছে নেওয়া এবং উপাসকের বিশ্বাস ও আস্থা রক্ষা করার নিরাপদ পথ অনুসরণ করা।”

বেঞ্চ, হিন্দু ও মুসলিম দুই পক্ষের ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা গঠিত যুক্তিগুলির মূল্যায়ণ করে বলেছে, “কোনও বিশ্বাস ন্যায়বিচারযোগ্য কিনা তাও তদন্তের অন্তর্গত এবং ব্যক্তিবিশেষের মতাদর্শগত পার্থক্যের ভিত্তিতে পরিবর্তনশীল।”

সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়ে মামলা চলাকালীন হিন্দু দলগুলি কিছু ঐতিহাসিক প্রমাণ উপস্থাপনা করে এবং সাথে বিতর্কিত স্থানটিকে রামের জন্মস্থান হিসাবে বিশ্বাসী ভক্তদের ‘পরিক্রমা’র মতো হিন্দু রীতিনীতি পালন করার কথাও উদ্ধৃত করে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে।
তবে আদালত শুধুমাত্র বিশ্বাস ও চিরাচরিত ধারণার উপর ভিত্তিতে এই বিষয়ে রায় দেওয়া থেকে বিরত থেকে মত প্রকাশ করে যে, আমাদের সংবিধানে সমস্ত ধর্ম, জাতি, ঐশ্বরিক মতবাদে বিশ্বাসী যে কোনও ধর্মের নাগরিকই আইনের সাপেক্ষে সমান বিচারযোগ্য। যে কোনও প্রকার প্রার্থনা এবং বিশ্বাসের মাধ্যম আইনের চোখে সমান।

রামের জন্মস্থান সংক্রান্ত ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকরা অনুমান সাপেক্ষ কিছু মতামত পেশ করলেও তা কোর্টের কাছে সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট ছিল না এবং বিচারকরা জানান, উপস্থাপিত তথ্যপ্রমাণগুলির যথাথত মূল্যায়ণ এবং সত্যতা বিচার করা প্রয়োজন।

এএসআই এর রিপোর্টের ভিত্তি :

অযোধ্যার বিতর্কিত জমির বিষয়ে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) পুরনো রিপোর্ট অনুযায়ী এই বিষয়টি পরিস্কার নয় যে, অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে কোনও মন্দির ভেঙে মসজিদ আদৌ গড়া হয়েছিল কিনা। তাই শনিবার এই ব্যাপারে রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে আসীন বিচারপতিদের এএসআই এর সেই পুরনো রিপোর্টটি তথ্য দিয়ে খুব সামান্যই সাহায্য করতে পেরেছে।

হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বকারী আইনজীবীরা ২.৭৭ একর জমির উপর তাদের অধিকার দাবি করার জন্য এএসআই এর প্রতিবেদনের উপর অনেক বেশি নির্ভর করেছিলেন এবং যুক্তি দিয়েছিলেন যে, মসজিদটি নির্মাণের জন্য একটি মন্দির ভাঙা হয়েছে। অন্যদিকে মুসলমানরা এই প্রতিবেদনের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। পরবর্তীতে খননকার্য চলাকালীন সেই বিতর্কিত জমিতে ইমারতের যা ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়, তাকে মুসলিমরা ‘ইদগাহ’ বা ‘কানাটি মসজিদে’র কাঠামো বলে দাবি করেছিল।

এলাহাবাদ কোর্টের নির্দেশে জমির খননকার্য শুরু হলে ২২ অগষ্ট ২০০৩ এ আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া একটি রিপোর্ট পেশ করে। প্রতিবাদীপক্ষ সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের ইদ্‌গাহ সম্ভাবনার ভিত্তিকে, শীর্ষ আদালত অন্তর্বর্তী সিদ্ধান্ত রূপে বরখাস্ত করে।

এএসআই এর পূর্ব প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছিল যে, একটি ইসলাম বহির্ভূত কুশলের কাঠামোর অস্তিস্ত্ব মসজিদের ভিত্তি প্রস্তরে রয়েছে। বেঞ্চের রায় অনুযায়ী এই পুরনো রিপোর্টটি কোনও ভাবেই দাবি করে না যে একটি মন্দির ভেঙে একইস্থলে মসজিদের নির্মাণ করা হয়েছিল।

হাইকোর্টের অর্ডারের ভিত্তি :

সুপ্রিম কোর্ট জানায়, ২০১০ সালের এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় হস্তান্তরিত হয়ে তা আদালতের যুক্তিকে অস্বীকার করে এবং আইনের নীতির পরিপন্থী হয়ে অযোধ্যার এই বিতর্কিত স্থানটির মামলাকে তুচ্ছ করে তোলে।
বিচারকরা বলেন, হাই কোর্টের দ্বারা দেশভাগের মামলা দাখিল করা হয়নি। সুতরাং আদালত প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলির মধ্যে জমি ভাগ করে দিতে পারে না।

শীর্ষ আদালত জানায় যে, সুন্নি ওয়াক্ফ বোর্ড এবং রাম লাল্লা বিরাজমান কর্তৃক উচ্চ আদালতকে নির্দিষ্টভাবে এই মামলার সাপেক্ষে প্রশ্ন তোলা এবং রায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। তবে এর জন্য যে পথ অনুসরণ করা হয়েছিল তা এই রায়ের অনুকূলে ছিল না।

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০, বিচারপতি এস ইউ খান, বিচারপতি সুধীর আগরওয়াল এবং বিচারপতি ডিভি শর্মা-কে নিয়ে গঠিত এলাহাবাদ হাইকোর্টের তিন বিচারপতি বেঞ্চ এই রায় জানায় যে, মুসলিম, হিন্দু ও নির্মোহী আখড়া – এই তিনটি দলকে এই বিতর্কিত জমির যৌথ ধারক হিসাবে গণ্য করা হবে এবং তাদের প্রত্যেকের জন্য এই জমির এক তৃতীয়াংশ ভাগ বরাদ্দ করা হবে।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here