নিজস্ব সংবাদদাতা, ওয়েব ডেস্কঃ
সালটা ১৯৮০। সিএনএন নামে এক সংবাদ চ্যানেল এনেছিলেন মিডিয়া ধনকুবের টেড টার্নার। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই টিভি সংবাদ এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। অথচ আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে সংবাদ ভিত্তিক টিভি চ্যানেলের কোন অস্তিত্বই ছিল না। বড় কোন ঘটনার খবর টিভিতে দেখতে হলে খবর প্রচারের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো গতি ছিল না।

আর অনেক সময়ই সেই অপেক্ষা ছিল বহু ঘন্টার। তবে সংবাদ প্রচারের দুনিয়াকে আমূল বদলে দিয়েছিল আমেরিকার চব্বিশ ঘন্টার সংবাদ চ্যানেল সিএনএন বা কেবল নিউজ নেটওয়ার্ক।
অনেকে বলেন সিএনএন সেই সময় রাজনীতির জগতকেও বদলে দিয়েছিল চিরকালের মত। মি. টার্নার বলেছিলেন ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, মানবিকতা ও শান্তির লক্ষ্যে পথচলার উদ্দেশ্যে নিয়েই তিনি ২৪ঘন্টার সংবাদ চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করছিলেন।
বিবিসি বাংলা সূত্রে খবর, ১৯৮০ সালের পয়লা জুন আমেরিকার পূর্বাঞ্চলীয় সময় বিকেল পাঁচটায় স্বামী-স্ত্রী জুটি ডেভিড ওয়াকার আর লোয়েস হার্ট সিএনএন-য়ের প্রথম সংবাদ সম্প্রচার শুরু করেন। রিক ডেভিস সেদিন ছিলেন সম্প্রচারের দ্বিতীয় ঘন্টায় খেলার খবরের প্রযোজক।
আরও পড়ুনঃ করোনা নিয়ে প্রতিবেদন, মহিলা সাংবাদিককে কারাদন্ড চিনের
তিনি বলেন, “সম্প্রচার শুরু হবার আগের এক ঘন্টা নার্ভাস ছিলাম, উদ্বেগ ছিল। কিন্তু শো যখন শুরু হল, তখন মাথার মধ্যে শুধু একটা জিনিসই কাজ করছিল- প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা সেকেন্ড – অনুষ্ঠান যেভাবে সাজিয়েছি – তা যেন পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে।”
সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে রিক ডেভিস আরও বলেন যে, “গ্রাফিক্স চিত্র ঠিক সময়ে পর্দায় যেন দেখা যায়, টেপ যেন ঠিক সময়ে চালু হয়! আমার মনে আছে উত্তেজনায় তখন চেঁচাচ্ছি- টেপ কই- এখনি টেপ বাজাতে হবে- হ্যাঁ সে এক মহা চাপের মুহূর্ত ছিল!”
আরও পড়ুনঃ ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রভূত ক্ষতি করেছেন মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলিরঃ জো বিডেন
খবরের লাইভ সম্প্রচার এবং ২৪ ঘন্টা লাগাতার সংবাদ প্রচারই যে সংবাদ টিভি চ্যানেলের প্রধান চ্যালেঞ্জ সেট তারা বুঝেছিলেন যেদিন সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানের প্রাণনাশের চেষ্টার খবর তারা কভার করলেন। ১৯৮১ সালে মি. রেগান ওয়াশিংটন হিলটন হোটেলে ভাষণ দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় তার ওপর আততায়ীর গুলি চালানোর সেই ঘটনা ছিল বিরাট খবর।
ঘটনা ঘটার পর সব টিভি চ্যানেল ব্রেকিং নিউজে খবরটা দেয়। কিন্তু অন্য টিভি চ্যানেলগুলো খবরটা দিয়েই অন্যান্য স্থানীয় খবর প্রচারে চলে যায়। সিএনএন সেটা করেনি। চব্বিশ ঘন্টার রোলিং নিউজ চ্যানেল হিসাবে সিএনএন রোনাল্ড রেগানের প্রাণনাশ সংক্রান্ত খবরের বিস্তারিত খুঁটিনাটি প্রচার করতে থাকে। প্রতি মুহূর্তে যা জানা যাচ্ছে তা দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে শুরু করে। দর্শক প্রথম বুঝতে পারে লাইভ সংবাদ চ্যানেলের ক্ষমতা, দায়িত্ব, চ্যালেঞ্জ ঠিক কাকে বলে।
সেই সময়টা মোবাইল ফোনেরও যুগ নয়। সাংবাদিকদের হাতে ল্যাপটপও থাকত না। ছিল না কোন ইন্টারনেট ব্যবস্থাও। কাজেই ব্রেকিং খবর ঘটনাস্থল থেকে কীভাবে দেবেন সংবাদদাতারা? মি. ডেভিস বলছিলেন সেটা ছিল বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ। ভিডিও ছবি পাঠানো একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল।
আরও পড়ুনঃ কারাদণ্ডে দণ্ডিত সৌদি আরবের নারী অধিকার কর্মী
এমনকি আমেরিকার ভেতরে বিভিন্ন জায়গা থেকেও ভিডিও পাঠাতে সাংবাদিকদের ঘাম ছুটে যেত। আর বিদেশ থেকে ভিডিও ছবি পাঠানো ছিল রীতিমত কঠিন। বিশেষ করে মাঠে ঘাটে যারা খবর কভার করছেন, তাদের সাথে যোগাযোগ করাও একেবারেই অসম্ভব ছিল। সাংবাদিকদের যখন খবর প্রচারের সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে হচ্ছে, তখন খবরের ভিডিও পাঠাতে প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হত, অহেতুক অনেক সময়ও নষ্ট হত, বলেন মি. ডেভিস।
সমালোচকরা বললেন এধরনের সংবাদ চ্যানেলের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর কৌশল জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে এবং যুদ্ধের ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। তৈরি হল উদ্বেগ। অনেকে এর নাম দিল ‘সিএনএন এফেক্ট’ । মি. ডেভিস বলছেন “নেতিবাচক এসব সমালোচনা চ্যানেলের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিলেও, এর ইতিবাচক দিকটা ছিল- কী হচ্ছে সেটা মানুষের সামনে তুলে ধরার সুযোগ। মানুষ নিজের চোখে দেখেছে কী ঘটছে। মানবিকতার দায়িত্ব কতটা পালন করা হচ্ছে, তার আসল রূপ খোদ ঘটনার মধ্যে দিয়ে মানুষকে আমরা দেখিয়েছি। আমরা মতে ‘সিএনএন এফেক্ট’ বা সিএনএন-এর আসল প্রভাবটা ছিল সেখানেই।”
রিক ডেভিস এখনও বিশ্বাস করেন লোকে যেটাকে ‘সিএনএন এফেক্ট’ বলে সমালোচনা করেছিল, তার ভূমিকা আসলে ছিল খুবই শক্তিশালী, এবং রাজনীতির জগতেও একটা বড় পরিবর্তন আনতে তা সাহায্য করেছিল। যুদ্ধ, নাগরিক আন্দোলন, অভ্যুত্থান এধরনের স্পর্শকাতর ও বিতর্কিত বিষয়গুলো টিভির পর্দায় উঠে আসাটা তাদের জন্য একটা জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি করেছিল।
মি. ডেভিস বেশ জোর দিয়েই বলেন, খবর প্রচার এবং খবরের বিশ্লেষণকে সিএনএন দায়বদ্ধ সাংবাদিকতার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসাবেই গোড়া থেকে বিবেচনা করেছে। ১৯৯০ সালে আরও অনেক ২৪ ঘন্টার টিভি সংবাদ চ্যানেল বাজারে আসে। ইন্টারনেট পরিষেবাও বিস্তৃতি পায়।
সিএনএন তাদের চ্যানেল চালু করার ৪০ বছর পর এখন সংবাদ মাধ্যমের চেহারা চরিত্র আমূল পাল্টে গিয়েছে। আগের চেয়ে সংবাদ মাধ্যম অনেক বেশি বিতর্কিতও হয়েছে। এর মধ্যে সব চ্যানেল যে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার করছে এমন দাবি করা যাবে না। তবে সিএনএন-এর নির্বাহী কর্মকর্তা রিক ডেভিস মনে করেন একটা সংবাদ চ্যানেলের সাফল্য নির্ভর করে তারা কতটা বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষভাবে খবর দিচ্ছে তার ওপর।
রিক ডেভিস বলেন, ”মানুষকে বোকা বানানো এখন সহজ নয়।মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগ করে দিয়েছে সংবাদ মাধ্যম। পাশাপাশি ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল খবর ও তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতেও সংবাদ মাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা যারা মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের সাথে যুক্ত আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে অন্যায় ও অসত্যকে তুলে ধরা, সেটা প্রচারের জন্য ক্ষমতাসীনরা থাকুক বা তাদের সহযোগী সুযোগসন্ধানী কেউ থাকুক, আসল সাংবাদিকতা হল অসত্যের মুখোশ খুলে দেওয়া।” তিনি বলেন, সিএনএন-এ সেই দায়িত্বকে এখনও তারা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথেই নিয়ে থাকেন।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584