শুভময় সেন
আজ যেহেতু আমরা মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্ম বার্ষিকী পালন করছি তাই হঠাৎ এক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা মাথায় আসলো গান্ধীজি বেঁচে থাকলে আধুনিক ভারতকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি কিভাবে দেখতেন।
রাজনৈতিক বিপ্লবের আগে যেহেতু তিনি সাংবাদিক ছিলেন তাই ভারতীয় গণমাধ্যম সম্বন্ধে বর্তমানে তাঁর মত কি হতো সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি।
সাংবাদিক হিসাবে গান্ধীজি
গান্ধীজি সাংবাদিক হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন দ্য ভেজিটেরিয়ান নামক এক ইংল্যান্ডের পত্রিকায়। তারপরেই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় শুরু করেন ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। তারপর দেশে ফিরে তিনি নবজীবন, ইয়াং ইন্ডিয়া এবং হরিজন’- এর প্রকাশনা শুরু করেন। যেগুলো স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বসে সত্যাগ্ৰহ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে তিনি ভারতীয় গণমাধ্যমের সমালোচনা মূলক ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে একটি সংগ্ৰাম যেটা মূলত নির্ভর করছে আভ্যন্তরীণ শক্তির উপর সেটা কখনোই সম্ভব নয় একটা সংবাদপত্র ছাড়া।
আমার এটাও অভিজ্ঞতা হয়েছে যে সারা বিশ্বের ভারতীয় ও স্থানীয় ভারতীয় সমাজকে আমাদের সংগ্ৰাম সম্বন্ধে, দক্ষিণ আফ্রিকায় কি ঘটছে তা সম্বন্ধে অবগত করাতে পারতাম না ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ পত্রিকা ছাড়া।’
সাংবাদিকতার অসীম ক্ষমতায় বিশ্বাসী গান্ধীজি আঞ্চলিক গণমাধ্যমেরও অত্যন্ত সমর্থক ছিলেন। তিনি ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ান’ চারটি ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন- ইংরেজি, গুজরাটি, হিন্দি ও তামিল।
আরও পড়ুনঃ স্টেশন পরিস্কার করে গান্ধী জন্ম জয়ন্তী উদযাপন খড়্গপুর ডিভিশনে
এছাড়াও তিনি অন্যান্য সাংবাদিকদের আঞ্চলিক ভাষায় লেখার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে ভারতবর্ষে আঞ্চলিক গণমাধ্যমের উত্থানে তিনি অবশ্যই খুশি হতেন।
তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, ‘ সংবাদমাধ্যমের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যই হল নির্ভীক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি গুলোকে তুলে ধরা’। তাই সত্য প্রকাশে নির্ভীক থাকা, দায়িত্ববান হওয়া ও স্বচ্ছতা গণমাধ্যমের আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
কিন্তু তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তিনি দেখতে পেতেন গণমাধ্যম কিভাবে একজন প্রধানমন্ত্রী যিনি কোনোদিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের সম্মুখীন হননা, তাঁকে নিরবে সম্মতি দিয়ে যাচ্ছে।
তিনি অবশ্যই ধমক দিতেন এটা দেখে যে কিভাবে প্রথম সারির গণমাধ্যম গুলো ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে নিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নই করতে পারল না।
Periodic Labour Force এর সার্ভে যখন দেশে রেকর্ড সংখ্যক বেকারত্বের কথা প্রকাশ করল এবং মোদী সরকার সেটাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করল তখন গণমাধ্যম অদ্ভুত ভাবে চুপ থাকলো।
ভোটের পরে যখন সেই তথ্যকে সরকার মান্যতা দিল তখনো গণমাধ্যম গুলো এত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে চুপ থেকে গেল। তাহলে কি ভারতীয় গণমাধ্যম হেরে গেল বা তাহলে কি ‘Prestitute’ বা সত্যিকারের ‘anti-national’ বিশেষণ গুলো ভারতীয় গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? না ব্যবসায় ঘাটা পড়ার ভয়ে সরকারের রোষানলে পড়তে চাইছে না মিডিয়া হাউসের মালিকেরা?
ইতিমধ্যেই মোদী সরকার বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমকে সরকারি বিজ্ঞপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছে। গান্ধীজির কিন্তু এই ব্যপারে কোন সমস্যা ছিলনা এবং তিনি বিজ্ঞাপণের উপর ভরসা করাটাকেও নিন্দা করতেন।
দ্যা প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স এর সমীক্ষায় ভারতীয় গণমাধ্যম বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪০তম স্থান দখল করেছে। সেই রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে কিভাবে সংবাদিকদের মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হয়েছে। ২০১৮ সালে অন্তত ৬ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক গৌরি লঙ্কেশের হত্যার অ্যানিভার্সারী সেই হাড় হিম করা সত্যকেই আবার স্মরণ করিয়ে দেয়। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সমালোচক গৌরি লঙ্কেশ যিনি নিজের নিজস্বতা বজায় রেখে মূলত কন্নড় ভাষায় লিখতেন এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির জন্য তার লেখায় কোন জায়গা দেননি, তাঁকে নিয়ে গান্ধীজি অবশ্যই গর্ব অনুভব করতেন।
গান্ধীজি সাংবাদিকতার জন্য এমনকি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেতেও রাজি ছিলেন। বর্তমান সময়েও ব্রিটিশ আমলের ধাঁচে সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের উপর যে অত্যাচার নেমে আসছে তা দেখে গান্ধীজি অবশ্যই স্তম্ভিত হতেন।
ফেক নিউজের যুগেঃ
গান্ধীজি বলেছিলেন, ” মিথ্যা খবর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ…. সত্যটাই যদি জরাজীর্ণ পর্যবসিত হয় তাহলে নতুন ভারতবর্ষও রোগগ্রস্ত হয়ে পড়বে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতাদের নীচু দেখানোর জন্য ভিডিও গুলোকে বিকৃত করা হয়েছিল জানলে গান্ধীজি অবশ্যই স্তম্ভিত হতেন। তাদের নিয়ে টেলিভিশনে অনবরত অপপ্রচার চালানো হয় তাদের বিরুদ্ধে জনগণকে খেপিয়ে তোলার জন্য।
টেলিভিশনের প্রাইম টাইমের বিতর্ক গুলোতে যে হিংসা, বিদ্বেষ, মেরুকরণ, যুদ্ধকে উস্কানি দেওয়া হয় সেগুলো দেখলেও গান্ধীজি অবশ্যই বিরক্তি প্রকাশ করতেন।
তবে একটা ব্যপারে গান্ধীজি অবশ্যই উচ্ছসিত হতেন- সেটা হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উত্থান।সেখানে মানুষ নিজেই নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারছে। অনেক ক্ষেত্রে হলুদ সাংবাদিকতার মুখোশ খুলে দিতে পারছে।
তবে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে মিথ্যা খবর ছড়াচ্ছে তাতে হতাশ হতেন। তবে তিনি এটা বিশ্বাসই করতে পারতেন না যে হোয়াটসঅ্যাপের গুজবেই ভিড় হত্যা হতে পারে। খবর ছড়ানোর ক্ষমতা জাহির করার জন্য অবশ্যই তিনি বিজেপি প্রেসিডেন্ট অমিত শাহকে ঘৃণা করতেন। তবে সত্য অনুসন্ধানকারী ওয়েবসাইট গুলোর উত্থানে অবশ্যই অনেকটা আশ্বস্ত হতেন।
তিনি অবশ্যই তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতেন আমাদের জম্মু কাশ্মীরের সহ দেশবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার এবং তাদের সঙ্গে অ্যাকচুয়ালি কি ঘটছে সে সত্য প্রকাশের ঢাকনা অবশ্যই খুলতেন।
গান্ধীজি বলতেন, ” গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এতটিই মূল্যবান যে কোন দেশই তা পরিহার করতে পারে না।” অন্য এক সময়ে তিনি বলেছিলেন,” এটা আমার দৃঢ় প্রত্যয় যে কোন মানুষই যেন তার স্বাধীনতা না হারায় শুধুমাত্র তার নিজের দুর্বলতার মাধ্যমে ছাড়া।” একজন শুধুমাত্র আশা করতে পারে যে গণমাধ্যম তার দৃঢ়তায় মন দেয় এবং পুণরায় উদ্ধার করতে পারে তার শক্তি ও স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584