নিউজফ্রন্ট, ওয়েবডেস্কঃ
সম্প্রতি ভারতবর্ষকে অনেকেই ‘হিন্দু পাকিস্তান’ বলে সম্বোধন করছে। এর মধ্যে যেমন রয়েছে দেশের জনতা, সেরকমই রয়েছে দেশের বাইরের অধিবাসী।
বিদেশি গণমাধ্যম ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ এর একটি প্রতিবেদনে ‘হিন্দু পাকিস্তান’-এর মন্তব্যটিকে ছোটবেলার ব্যকরণ বইয়ে থাকা ‘ওরিয়েন্টালিজম’ এর সাথে তুলনা করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে ভারতবর্ষের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে একই সাথে বিভিন্ন ধরনের সত্যের সহাবস্থান—এই সহজ সত্যটা উপলব্ধি না করে, এর সহজাত অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করলে, একে এক বিকৃত লেন্স থেকে পরিমাপ করা হয়, যা অযৌক্তিক এবং কদর্য।
সম্প্রতি লোকসভায় বিতর্কমূলক নাগরিকত্ব বিলের পাশ হওয়া এটাই প্রমাণ করে যে ভারতবর্ষ তাঁর স্বজাতিপ্রীতিতে এক বিশাল বড় আঘাত হানল। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে মহঃ আলি জিন্নাহ্ যে ‘টু নেশন থিয়োরি’(হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য পৃথক দুটি রাষ্ট্র)তে বিশ্বাস করতেন, ভারতের ক্ষেত্রেও মোদি সরকার পরোক্ষ ভাবে সেই চেষ্টার দিকেই এগোচ্ছেন।
নাগরিকত্ব বিল দাবি করে, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তানে বসবাসকারী সংখ্যা লঘু ধর্মাবলম্বীদের ছয় বছরের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকত্ব দানের কথা।
আরও পড়ুনঃ ক্যাবের প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ ত্রিপুরা, বন্ধ মোবাইল পরিষেবা-সহ ইন্টারনেট
তবে মুসলিম বাদে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অভিবাসীরাই শুধুমাত্র এই বিলটিতে ঠাঁই পাবে। নতুন আইন অনুসারে, হিন্দু, পার্সী, খ্রিস্টান, শিখ বা বৌদ্ধরা বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই এই তিনটি দেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করলেও তাদের জেল বা নির্বাসন দেওয়া হবে না এবং তারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ভারতে অনুপ্রবেশকারী অভিবাসীদের পৃথক করতে এই জাতীয় নাগরিক নিবন্ধ(এনআরসি) তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ এই প্রথম ভারতে বসবাসকারী নাগরিকদের ধর্মের সাথে তাদের নাগরিকত্বকে যুক্ত করা হচ্ছে।
এনআরসি ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী, যা ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য সমতার প্রতিশ্রুতি দেয়। এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভিত্তিগত পার্থক্যকেও ভেঙে দেয়।
আরও পড়ুনঃ রাজ্যপালকে তৃণমূলের ‘গো-ব্যাক’ স্লোগান, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ বিধানসভা
পাকিস্তান এমন একটি রাষ্ট্র যা ধর্মতন্ত্রে বিশ্বাস করে। অন্যদিকে ভারত এমন একটি রাষ্ট্র যা ধর্মনিরপেক্ষতার আধারে প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশরা দেশ থেকে যাওয়ার সময় দেশের মূল ভিত্তিগত আধারে রেখা টেনেছিল ঠিকই, তবে তারা কখনও ধর্মকে জাতিসত্তার ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেনি।
ক্যাব পাশের সময় প্রধানমন্ত্রী এ কথা স্বীকার করেছিলেন যে বিতর্কিত নতুন আইনটি হয়তো দেশভাগের জ্বালা একটু মনে করিয়ে দেবে, কিন্তু পাশাপাশি দেশভাগের সময় ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অসংখ্য ‘মা ভারতীর সন্তানদের’ ঘরে ফিরিয়ে আনবে।
তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে কি পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশে গিয়ে ঠাঁই নেওয়া মুসলিম জনগণরা ‘মা ভারতীর সন্তান’ নয়। যদি না হয় তাহলে ভারতও পাকিস্তানের হেঁটে যাওয়া পথেই পা মেলাচ্ছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদকের কথায়, দেশভাগের সময় কয়েক মিলিয়ন মানুষের মধ্যে আমার বাবার পরিবারও ছিল যারা সব কিছু থেকে নিজেদের উপড়ে ফেলে মাথার ছাদ ছাড়াই ভারতে পৌঁছেছিল।
আরও পড়ুনঃ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরোধিতায় সরব হাজার বিজ্ঞানী ও স্কলার
দিল্লির একটি শরণার্থী পাড়া বাড়িতে বেড়ে ওঠা, আমিও অনেকের মতোই দেশভাগের ভয়াবহ কাহিনী এবং তার আকস্মিকতা সম্পর্কে জেনে বড় হয়েছি। এই ক্ষতগুলি নিরাময় করা থেকে দূরে, অভিবাসীদের শ্রেণীবদ্ধকরণ, অন্যায়, মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কেবল দ্বেষের রেখা আরও বাড়িয়ে তুলবে।
ভারত সরকারের প্রকল্পের সাবটেক্সট পরিষ্কার। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি যা বলছে তা হল নিগৃহীত মুসলমানদের মুসলিম দেশগুলির আশ্রয় নেওয়া উচিত এবং তাদের ভারতের দরজায় কড়া নাড়ানোর প্রয়োজন নেই। কার্যকরভাবে এর অর্থ হল, নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে, বহিষ্কৃত অভিবাসীরা শিবির এবং আটক কেন্দ্রগুলিতে বন্দী হয়ে থাকবে।
তবে এতে অবশ্যই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে দরিদ্র মুসলমানদের, যাদের এনআরসি-র তৎপরতার জন্য ভারতে থাকতে হলে পুরনো কাগজপত্র সন্ধান করতে হবে। কয়েক দশক ধরে এদেশে বসবাসরত মুসলমানদের সম্ভাব্য বঞ্চিতকরণের ফলে, ভারত তাই অতল গহ্বরে ডুবছে, আর অধিকাংশ দেশবাসী তা আঁচ করতেও পারছে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন যে নতুন মুসলিম আইন দ্বারা ভারতীয় মুসলমানরা নির্বিঘ্নে থাকতেই পারেন। তবে কেন মায়ানমারের রোহিঙ্গা বা পাকিস্তানের শিয়া, বেলুচি এবং আহমাদীরা নির্যাতিত সংখ্যালঘু হিসাবে যোগ্যতা অর্জন করে না, তার পক্ষে কোনও ভালো ব্যাখ্যা নেই।
আরও পড়ুনঃ চলন্ত বাসের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা গৃহবধূর
যদি এটি আমাদের একীভূতকরণের ইতিহাসকে সমর্থন করে এবং উদার প্রতিবেশী হওয়ার দাবি করে, তবে কেন এই বিলটি শুধুমাত্র তিনটি মুসলিম জাতির ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য প্রযোজ্য? কেন শ্রীলঙ্কার তামিল হিন্দুরা নয় – যাদের মধ্যে প্রায় ৬০,০০০ জনগণ বিচ্ছিন্ন ভাবে তামিলনাড়ুর দক্ষিণপ্রান্তের বিভিন্ন রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পে থাকে।
যদি বিলটি সংসদের উচ্চকক্ষেও পাশ হয়ে যায়, এবং এই বিলের স্বপক্ষে সংখ্যা গরিষ্ঠতা বিজেপির পক্ষে সজ্জিত হয় – তবে একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের উপর ভার পড়বে ভারতবর্ষের ভিত্তিগত সাংবিধানিক মৌলিকতাকে রক্ষা করার। সময় বলবে ভারতবর্ষ একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কি না।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584