অমিতাভ চক্রবর্তী
১৮৯৩ তে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ লক্ষ্য করলেন বিশ্বের সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডে সেই সময়েই নারীরাও সমান অংশীদার।
শুধু মাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র নয় বিশ্বে এই নারী শক্তি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় থেকেও আদায় করে নিয়েছে সম্মান ও মর্যাদা।
এদিকে ভারতের নারীরা নিগৃহিত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। স্বামীজী জানতেন ভারতের বিকাশ অপূর্ণ থেকে যাবে যদি দেশের মেয়েদের সম্মান মর্যাদা দেওয়া না যায়। বুঝলেন মেয়েদের জাগিয়ে তুলতে হবে। তারা শুধু মাত্র কামনার উপকরণ নয় তাদের মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে জগতের কল্যান।
স্বামীজী ফিরে এলেন ভারতে। এরপর ১৯০১ সালে বেলুড় মঠে সারদা মায়ের অনুমতি নিয়েই প্রাচীন ভারতের শাস্ত্রে যে কুমারী পুজোর বিধান আছে তাকে অনুসরণ করে দুর্গা পুজোর অষ্টমীতে কুমারী পুজোর প্রচলন করেন। সে বছর এক সঙ্গে ন’জন কুমারীকে বেলুড় মঠে পুজো করা হয়েছিল।
রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন, যদি ভগবান কে ‘মা’ হিসেবে দেখতে পাওয়া যায় তবেই সাধনার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছনো সম্ভব।
‘মা’ ধারনাকে দেবী রূপে বা সর্বশক্তিমান সম্ভাবনা রূপে পুজো করা এই ভারতের প্রাচীনতম ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির এক সুশৃঙ্খল অংশ। বাংলায় এই শক্তিরূপিনী দেবী দুর্গার পুজোও আসলে ওই মা ধারনার আরাধনার জনপ্রিয়তম উৎসব।
প্রাচীন যোগিনী তন্ত্র অনুসারে প্রাক বয়ঃসন্ধির কোন অরজঃস্বলা বালিকাকে মাতৃরূপে পুজো করাই কুমারী পুজো। তন্ত্র অনুসারে মাত্র একজন কুমারীকে ভোগ দিলেই নাকি সারা বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সেবা করার সুফল পাওয়া যায়। কুমারী অর্থাৎ অবিবাহিতা।
আরও পড়ুনঃ মহিষাসুরমর্দ্দিনী ও বৈদিক সংস্কৃতি
অনূঢ়া। বিভিন্ন বয়সী এই পূজিতা কুমারীদের নানান নাম। নান তাদের রূপ। এক বছর বয়স থেকে ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত বয়সভিত্তিক সম্বোধন নির্দিষ্ট করা আছে। বয়স ভিত্তিক পর্যায় ক্রমে তাদের নাম সন্ধ্যা, সরস্বতী, ত্রিধামূর্তি, কালিকা, সুভাগা, উমা, মালিনী, কুঞ্জিকা, কাল সন্দর্ভা, অপরাজিতা, রুদ্রানী, ভৈরবী, মহালক্ষ্মী, পঠিনায়িকা, ক্ষেত্রজ্ঞ, এবং অম্বিকা।
মানুষের বিশ্বাসের জগতে সব কিছুই সত্য। এই যে দেবীকে কন্যারূপে বরণ, স্মরণ, অর্চণ এবং বিদায় দেওয়া হচ্ছে এ সবই ভারতীয় সমাজের সমাজ বন্ধনের অনন্য প্রক্রিয়া। শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালির মাতৃপুজোর এক অনন্যরূপ।
এই মাতৃকা শক্তি পুজো মহেঞ্জোদারোর সময়তেও ছিল। ঋগ্বেদের দেবীসুক্তে স্বয়ং ঘোষনা করেছেন ‘অহং রাষ্ট্রী’ – আমি সম্রাজ্ঞী। আমাকেই আগে পুজো করা উচিৎ। আমি পার্থিব অপার্হিব সব সম্পদই দিতে পারি।‘ এই দেবীকেই আমরা নানান নামে নানান রূপে পুজো করে থাকি। অথচ মাটি বা পাথর বা অন্য কোন পদার্থ দিয়ে যে মূর্তি গড়ে পুজো করা হয় বিবেকানন্দের ভাষায় তা একেবারেই ‘অচল’। তিনি সচল অর্থাৎ মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের পুজো করতে বলতেন। কারণ মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের সর্বোত্তম প্রকাশ। কারণ মানুষ চৈতন্যযুক্ত।
যোগিনী তন্ত্রে নিদান আছে কুমারী পুজো করলে নাকি ত্রিলোক জয় করা যায়। কুমারী পুজোর ক্ষেত্রে কোন জাতি ভেদাভেদ নাই। যে কোন জাতি বা ধর্মের কুমারী কন্যাকে দেবী জ্ঞানে পুজো করা যেতে পারে। সেই সূত্র ধরে স্বামীজী কাশ্মীরের এক মুসলমান কন্যাকে দিয়ে কুমারী পুজো করিয়েছিলেন।
পার্বতীর আরেকনাম কুমারী। দক্ষিণ ভারতের ‘কুমারিকা’ অন্তরীপের দেবী প্রতীক। কামরূপের কামাখ্যা মন্দিরেও মহা সমারোহে কুমারী পুজো হয়ে থাকে।
নেপালেও এই কুমারী অর্চণা আনন্দ উৎসবের অঙ্গ।নেপালের কুমারী পুজোর একটা রীতি এবং রেওয়াজ আছে যার সঙ্গে ভারতীয় কুমারী পুজোর রীতি মেলে না। তবুও নেপালীদের কাছে এই কুমারী কন্যা মাতৃস্বরূপা। কাঠমান্ডুর একটা ছোট্ট প্রাসাদ থেকে যাত্রা শুরু হয় প্যাগোডার মত দেখতে একটা রথের। রথের সামনে থাকে রাজ সেনা। আর রথে বসে থাকে এক কুমারী কন্যা। জীবন্ত দেবী।
আরও পড়ুনঃ রামায়ণে অকাল বোধন
নেপালের সাধারণ মানুষ তো বটেই রাজাও এই দেবীর কৃপাপ্রার্থী। কুমারী দেবী রাজার কপালে এঁকে দেয় রক্ত তিলক। মাথায় চাল ছড়িয়ে করে আশির্বাদ। এর অর্থ রাজা আরো এক বছরের জন্য পেলেন রাজ্য শাসনের অনুমোদন। যদিও এই প্রথা, এই উৎসব কাট্মান্ডুর প্রাচীন জনজাতি নেওয়ারদের তবু উচ্চজাতি শাহবাজরাও মেনে নেয় এই প্রথা।
স্থানীয় পন্ডিতদের বক্তব্য রাজা যদি এই তিলক নিতে ব্যর্থ হন তবে যে তিনি শুধু মাত্র রাজসিংহাসন চ্যূতই হবেন এমন টা নয় তাঁর জীবন হানিও হতে পারে। যেমন হারিয়েছিলেন কাটমান্ডুর মাল্লা রাজা সেস ১৭৬৮ সালে।
নেপালের এই কুমারী পুজো শুরু হয় দশম শতাব্দীতে – সেই মাল্লা যুগে। এই কুমারী কন্যা মাল্লা রাজাদের আরাধ্যা দেবী তালেজু ভবানীর প্রতীক। শাক্য গোত্রের পাঁচ থেকে ছয় বছরের মেয়েদের মধ্যে থেকে এই কুমারী কন্যা বাছাই করা হয়ে থেকে।
এবং সেই বাছাইয়ের পদ্ধতিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচিত কন্যার দেখা স্বপ্ন বিশ্লেষণ করা হয়, রাতে ঘন অন্ধকারে মোষের মাথা ছড়ানো ঘরে তাকে একা থাকতে হয় রাত ভোর।
এ হলো কন্যার সাহসের পরীক্ষা আর তাতে উত্তীর্ণ হলে এবং নির্বাচিত হলে সেই কন্যা উঠে আসে প্রাসাদে। যতদিন না কন্যা ঋতুমতী হচ্ছে ততদিন সে কুমারী। ঋতুমতী হলেই হারাতে হবে পদ। কেননা কুমারী দেবী কখনো রক্ত দেখবে না। কুমারী পদ হারানোর পর সেই কন্যা নিতান্তই সাধারণ কন্যায় পরিনত হয়। প্রাসাদের বাইরে তখন তার ঠাঁই।
নেওয়ার সম্প্রদায়ের বিশ্বাস যে এই কুমারীকে যে পুরুষ বিয়ে করবে তার মৃত্যু অনিবার্য এবং সেটা ঘটবে বিয়ের এক বছরের মধ্যে। অবশ্য এই লোকমত শাস্ত্রীয় নয়, তাই এই সংস্কারের বিপক্ষের বিতর্ক থেকেই যায়।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584