মামুদ হাসান চৌধুরী
যেদিন প্রথম ‘ওরা কাজ করে’ কবিতাটি পড়ে ছিলাম তখন ওই কবিতাটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারিনি। তারপর যখন শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সুযোগ পেলাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের এই ‘ওরা কাজ করে’ কবিতাটি, তখন বুঝতে পেরেছিলাম কারা আমাদের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আর আজ দেখলাম তাকে চোখের সামনে।
আমাদের সভ্যতার বাহকরা অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের ঘাটে ঘাটে হেঁটে চলেছে۔ করোনা ভাইরাসের প্রভাবে আমাদের দেখা হয়ে বাস্তব কবিতাটির চলচিত্রায়িত রূপ।
শুধু আমার এই ভারতবর্ষ নয়, সারা বিশ্ব আজ এই মহামারিতে থরহরি কম্পমান যারা তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে সেই সৃষ্টিলগ্ন থেকে পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তাদের করুন কাহিনী আজ আমাদের চোখের সামনে, পৃথিবীতে কত সাম্রাজ্যলোভী শক্তি এল কালের নিয়মে তারা বিলীন হয়ে গেল কিন্তু এদের পথ চলা কোনদিন শেষ হবার নয়। যেদিন শেষ হবে সেদিন মনে হয় সভ্যতার ইতি ঘটবে।
আরও পড়ুনঃ ফের লকডাউনের পথে বেজিংয়ের একাংশ
অথচ তারা কত তুচ্ছ! তাদের কোনো মূল্যই নেই আমাদের কাছে তাদের সামান্য চাহিদাটুকুও আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে কি নির্বিকার ভাবে সবাই তাদেরকে নিয়ে যা খুশি তাই করছে।
যাদের বানানো অট্টালিকাতে আমাদের বাস তারা আজ কুকুরের সঙ্গে রাস্তায় ঘুমাচ্ছে, মাথা গোঁজার জায়গাটুকুও দেয়নি কেউ, যারা পরিশ্রম করে সোনার ফসল ফলায় তারা আজ না খেতে পেয়ে মরা পশুর মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে রাস্তার পশুদের সাথে, অথচ কেউ তাদের দায়িত্ব নিতে রাজী নয়।
দোষারোপের পালা চলছে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে যেখানে তারা শ্রম দেয় তারাও তাদের যথাযথ ভাবে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাটুকুও করেনি। কি মর্মান্তিক দৃশ্য! কেউ ব্রিজের তলায় জায়গা নিয়েছে , কেউ রাস্তার দু’ধারে দিয়ে হেঁটে চলেছে একদিন বাড়ি ফিরবে এই আশায়। অনেকের সেই আশা পূরণ হয়নি। চিরকালের মতো তারা হারিয়ে গেল আমাদের অমানবিক নিষ্ঠুর হৃদয়হীন ব্যবহারে।
আরও পড়ুনঃ মহামারিতে সমাজ কর্মী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ
আচ্ছা তারা কি এর জবাব চাইবে না ? যারা তাদের বিপদের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিলো তাদের দিকে কী আঙুল তুলবে না তারা? প্রতিবাদে তারা তাদের হেঁটে চলাকে থামিয়ে দেবে না ? তারা কি শুধুই ভোটব্যাঙ্ক , ভোটের সময় তাদের প্রতি কত সহানুভূতি ? আর আজ তারা হেঁটেই চলেছে দেশের জনগণ নাকি দেশের সম্পদ ? সেই সম্পদের আজ কতটা দুর্বিষহ অবস্থা সেটা চোখে দেখা যায় না।
কবির কথায়, “চোখ ফেটে এলো জল ? এমনি ক’রে কি মার খাবে দুর্বল ?” এই দুর্বল এর মার খাওয়া বোধহয় শেষ হয় না ? তারা কি একটু সহানুভূতি পেতে পারত না ? তাদের কি সঠিকভাবে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া যেত না , কেন তাদের ওখানেই সঠিকভাবে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা গেল না ?
যারা প্রতিনিয়ত দেশপ্রেমের ধুয়ো তুলে ধরে তারা আজ দেশমাতার সন্তানের জন্য চুপ কেন ? আজ দেখলাম দেশমাতা স্টেশনে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে গেল, আর সন্তান দেশের ভবিষ্যৎ তাকে আঁচল ধরে জাগানোর চেষ্টা করছে ? অনাহারে, অপুষ্টির কারণে হারালাম মাকে, এই দৃশ্য কি আমাদের বিবেককে কাঁদায় না ? কেন আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে যাচ্ছি ? তাদের এই অবস্থার জন্য দায়ী কে?
আরও পড়ুনঃ করোনা পরীক্ষা হবে মঙ্গলকোট ব্লক হাসপাতালে
“ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে” এই বুলি আউড়ে আমরা বোধহয় পাশ ফিরে ঘুমাবো আর দেখবো এক সন্তানসম্ভবা মা রাস্তাতেই তার সন্তানের জন্ম দিচ্ছে আর দেখব এক বন্ধুর কোলে মাথা রেখে আরেক বন্ধু চির বিদায় নিচ্ছে তার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা আমরা করতে পারিনি, রেলওয়ে লাইন ধরে বাড়ি ফিরতে গিয়ে কত প্রাণ চলে গেল। শুধু দেখেই যাব! হে ভগবান আর কত প্রাণের বিনিময়ে আমরা জাগবো ? কবির ভাষায়, ” যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ ? তুমি কি বেসেছ ভালো ?”
তোমার সন্তানদের থাকার জায়গা যারা কেড়ে নিয়েছে, খাবারটুকু পর্যন্ত যারা দেয়নি তাদের তুমি ক্ষমা করো না প্রভু, কখনো ক্ষমা করো না তাদের যারা জল টুকু পর্যন্ত তোমার সন্তানদের মুখ থেকে কেড়ে নিয়েছে খিদের কারণে যে যা তার সন্তানের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে সেই খুনিদের তুমি ক্ষমা করো না কোনদিন যারা ক্ষমতার দম্ভে ভারত মায়ের সন্তানদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে তাদেরই রক্ত-লেখায় যেন দম্ভের অবসান ঘটে মানুষ একদিন রুখে দাঁড়াবেই তার প্রতি হওয়া অত্যাচারের বদলা সে নেবেই শুধু সময়ের অপেক্ষা।
(লেখক পেশায় স্কুল শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584