মোহনা বিশ্বাস
দিনটা ছিল ৮ জুলাই, ২০২১। বৃহস্পতিবার। তৃণমূল তৃতীয়বারের জন্য মসনদে বসার পর ২ জুলাই থেকে শুরু হয় বিধানসভা অধিবেশন। বৃহস্পতিবারও তেমনই একটি দিন ছিল। বিধানসভায় ছিল বিধায়কদের ভিড়। এদিন দুপুরে বিধানসভা অধিবেশন শেষ হওয়ার পর মূল গেট দিয়ে বাইরে বের হচ্ছিলেন বিধায়করা। ঠিক সেই সময় তার একটু পাশেই হঠাৎ সিলিং থেকে খসে পড়ে চাঙড়। আওয়াজ শুনে প্রথমে ভয়ে পেয়ে গেছিলেন বিধায়করা।
তবে নিরাপত্তারক্ষীরা সতর্ক থাকায় এদিন বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন বিধায়করা। ওই চাঙড় কারও মাথায় পড়েনি বলে জানা গেছে। এর আগেও একদিন দুর্ঘটনা ঘটেছিল বিধানসভায়। ওই দিন অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বে বিধান পরিষদের প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক চলছিল। সেই সময় বিধানসভায় মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের ঘরে এসি থেকে আগুনের ফুলকি বের হতে দেখা যায়। যার কারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল বিধানসভা চত্বরে। তবে তখনও তৎপরতার সঙ্গে সবাইকে নিরাপদে উদ্ধার করেছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। সম্প্রতি বিধানসভায় ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনাই সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছে।
বিধানসভায় বিধায়কদের বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে নিরাপত্তারক্ষীরা সদা জাগ্রত। কিন্তু আমরা যদি সুন্দরবনের চিত্রটা দেখি, তাহলে বোঝা যাবে যে সেখনকার সাধারণ মানুষ ঠিক কতটা অসহায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিন কাটাতে হয় তাঁদের। সেখানে নেই কোনো নিরাপত্তারক্ষী। নেই কোনো মজবুত বাঁধ। বিধানসভার চাঙর নজরে এলেও সুন্দরবনের বাঁধ ভাঙার দৃশ্য কারোর নজরেই পড়ে না।
জানিয়ে রাখা ভালো, গত ১৯ জুন প্রয়াত হয়েছেন গোসাবার তিনবারের তৃণমূল বিধায়ক জয়ন্ত নস্কর। কোভিড পরবর্তী সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন জয়ন্তবাবু। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। তিন বারের বিধায়ক হিসাবে সারা জীবন তিনি সাধারণ মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন। তাই জয়ন্ত নস্করের প্রয়াণে স্বাভাবিকভাবেই ওই বিধানসভাকেন্দ্রে বিরাট শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছে।
২০০৯-এর ২৬ মে থেকে ২০২১-এর ২৬ মে। ঠিক ১২টা বছর, একটা যুগ। ঘূর্ণিঝড় আয়লার যুগান্তরে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। আর এই ইয়াসই আরেকবার আয়লার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন লাগোয়া বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের। কোটালের ওপর ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসে মুহুর্মুহু ভাঙল বাঁধ। ফের লোনা জলে প্লাবিত হল কৃষিজমি। এখন প্রশ্ন, তাহলে ১২ বছরে হলটা কী?
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আশঙ্কায় আগে থেকেই নিরাপদ জায়গায় সরানো হয়েছিল নীচু এলাকার বাসিন্দাদের। তাতে প্রাণহানি এড়ানো গেলেও বাঁধ ভেঙে জল ঢুকলোই। ফলে অনেকের আর ফেরার জায়গা রইল না। অনেকের ফসল গেল লোনা জলের তলায়। জমিতে আবার কবে চাষ করা যাবে, তা জানেন না চাষিরাও। অনেক জায়গায় বুক দিয়ে বাঁধ আগলাতে দেখা গেল যুবকদের। মাথার উপরের ছাদ হারিয়ে, পথে বসতে হয়েছে বহু মানুষকে। ভবিষ্যৎ জীবন ও জীবিকা নিয়ে ভয়ংকর অনিশ্চয়তার মুখে সুন্দরবনের মানুষ।
গত কয়েক বছরে সুন্দরবনের বিপদ ঘনিয়ে এসেছে মূলত তিনটি দিক থেকে ৷ প্রাকৃতিক, বাস্তুতান্ত্রিক ও মানুষের অর্থনীতি। অবস্থানগত কারণেই প্রাকৃতিক বিপদের সম্মুখে রয়েছে সুন্দরবন৷ সুন্দরবন মূলত বদ্বীপ অঞ্চল৷ এর একটা অংশ সমুদ্রের একেবারে সামনে রয়েছে, যা মূলত সাগরের জলের সৃষ্ট বদ্বীপ ৷ আর ভেতরের দিকে যে জায়গাগুলি রয়েছে সেগুলি নদীর জোয়ারভাঁটা ও সমুদ্রের জলের মিশ্রণে তৈরি দ্বীপ। সুন্দরবনের ১০২টি দ্বীপের মধ্যে জনবসতি রয়েছে প্রায় ৫০টি দ্বীপে৷ দ্বীপগুলিতে এখনও ভাঙা-গড়া চলছে। ফলে বিপদের ঝুঁকিও সবসময়েই বেশি।
আরও পড়ুনঃ ভোট পরবর্তী হিংসা মামলায় সিবিআই সুপারিশ জানাল মানবাধিকার কমিশন
আমপানের জন্য যে জায়গায় বাঁধ মেরামতের প্রয়োজন ছিল ও গাছ লাগানোর পরিকল্পনা ছিল, তাও সম্পূর্ণ করতে দেয়নি ঘূর্ণিঝড় ইয়াস৷ ফলে বাঁধ অরক্ষিতই থেকে গেছে৷ স্বাভাবিকভাবে পাথরপ্রতিমা, নামখানা, সাগর, মথুরাপুর, হিঙ্গলগঞ্জ, কুলতলি, সন্দেশখালি-সহ বিভিন্ন অঞ্চলে আবারও ইয়াসের প্রভাবে ভেঙেছে বাঁধ৷ জল ঢুকে প্লাবিত করেছে আশপাশের এলাকা৷ প্রায় ৮ থেকে ১০টি ব্লকের জীবন জীবিকা এখন অথৈ জলে৷
আয়লার পর ১২টা বছর কেটে গেছে। তার মধ্যে ১০ বছর রাজ্যের ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল। এখন প্রশ্ন, এতদিনে সুন্দরবনের নদীবাঁধের হাল ফিরল না কেন? এখনও পর্যন্ত কেন তৈরি হল না মজবুত বাঁধ? কেন ঘূর্ণিঝড় এলেই এখনো বাস্তু ও জীবিকাচ্যূত হতে হবে দুর্গম এলাকার মানুষগুলোকে? কেন ঝড় চলে যাওয়ার পর বাঁধ মেরামতির কথা মনে পড়ল মুখ্যমন্ত্রীর? এইসব প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরাই রয়ে গেছে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584