অমিতাভ চক্রবর্তী

মহিষাসুরমর্দ্দিনী দুর্গার আবাহন ও আরাধনায় ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতির এক সুদীর্ঘ ইতিহাস লুকোনো আছে । প্রাচীন যুগে বৃক্ষ বা গাছকে পুজো করার প্রচলন ছিল সমাজে আর সেই ধারা আজও অব্যাহত।
বেল, কলা, কচু, হলুদ, অশোক, মান, ধান প্রভৃতি গাছে দেবীর অবস্থান কল্পনা করা হয়। বৃক্ষ পূজার পর যূপ পূজা, স্তূপ পূজা, প্রতীক পূজা, এবং প্রতিমা পূজার প্রচলন হয়। এই প্রতিমা পুজোর সময় প্রতিমার রূপ কল্পনাতেও বৈচিত্র দেখা যায়।
কোথাও সেই প্রতিমার চারটে হাত- চতুর্ভুজা। কোথাও ছ’টা বা আট হাত। দশভুজা তো সবচেয়ে প্রচলিত। এছাড়া অষ্টাদশ ভুজা এমন কি শতভুজা বা সহস্রভুজাও দেখা যায়। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ দুর্গা মূর্তির এত বৈচিত্রের কারণ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ’বর্ণের ও ধ্যান মন্ত্রের মধ্যেও বৈচিত্রতার সৃষ্টি হয় কিন্তু বৈচিত্রের মধ্যেও আছে ঐক্য এবং মিলনের যোগ সূত্র।
ঐক্যকামী ভারতবর্ষের এটিই প্রধান বৈশীষ্ট্য ও ঐক্যদৃষ্টি। তাই একদিকে শ্রীশ্রীদুর্গা ব্রহ্মনী, চন্ডিকা, কাত্যায়নী, রৌদ্রী, গৌরী, ইন্দ্রানী, কৌমারী, নরসিংহী, চামুন্ডা, শিবদূতী, বারাহী, মাহেশ্বরী, জয়ন্তী, সর্বমঙ্গলা, কালী, করালিনী, শাকম্ভরী, অম্বিকা, মহাকালী, ভদ্রকালী, কপালিনী, চন্ডী, উমা, তারা, বিজয়া, কালরাত্রী, শৈল্পুত্রী, মহারাত্রী প্রভৃতি ও চতুঃষষ্টি যোগিনীরূপে পূজিতা এবং অপরদিকে একৈবাহম – অদ্বিতীয়া চৈতন্যরূপিনী।‘

হিন্দু হোক বা বৌদ্ধ উভয় সমাজেই প্রাচীন যুগে তেত্রিশ জন দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য বেদ বর্ণিত দেবতাদের কথা স্বতন্ত্র কেননা সভ্যতার বিকাশের শৈশবকাল বৈদিক তথা ঋগ্বৈদিক যুগ।
বেদে বরুণ, মিত্র বা সূর্য, পুষা, পৃথিবী, অগ্নি, বায়ু, অশ্বিনীভাইদের উপস্থিতি যেমন আছে তেমনি উত্তরকালে ইলা, ইড়া, সরস্বতী, ইন্দ্র ব্রহ্মা, চন্দ্র প্রভৃতি দেবতাদের উত্থানও দেখতে পাওয়া যায়।
ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত দেবতাদের সংখ্যা নির্নয় করতে গিয়ে তাঁর ‘ডায়লেকটিক্স অব হিন্দু রিচুয়ালিজম’ গ্রন্থে প্রশ্ন রেখেছেন – ‘আমাদের ঋগ্বেদে কতজন দেবতাদের উল্লেখ আছে?’ এই প্রশ্নের উত্তর তিনি ঋগ্বেদের প্রসঙ্গ এনে ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে তেত্রিশ জন মাত্র দেবতা ছিলেন ঋগ্বেদের সময়।
পুরাণের যুগে সেই তেত্রিশজন দেবতাদের সংখ্যা হয়েছে ৩৩ কোটি। এই অসংখ্য দেব দেবীর মধ্যে দুর্গা বৈদিক যুগে তো বটেই এমনকি উত্তর বৈদিক যুগে শক্তি রূপে ভারতীয় সমাজে পূজিত হচ্ছেন। অবশ্য বৈদিক যুগে স্ত্রী দেবতাদের তুলনায় পুরুষ দেবতাদের আধিপত্য বেশী ছিলো। কিন্তু অদিতি, উষা, সরস্বতী, প্রভৃতি স্ত্রী দেবতাদের ভূমিকাও গুরুত্ব পেত।
কিন্তু উত্তর বৈদিক কালে স্ত্রী দেবতাদের আধিপত্য ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
শুধু ভারতেই নয়, সিরিয়া, গ্রীস, সাইপ্রাস, এথেন্স, ক্রিট প্রভৃতি প্রাচীন দেশে ও দ্বীপে এবং মধ্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশ গুলিতে মহাশক্তির পুজো হয়ে থেকে ভিন্ন রূপে ও ভিন্ন নামে। স্যাকসানদের ভিতর জার্মানীতে দেবী ইস্তারার উদ্দেশ্যে ইস্টার উৎসব অনুষ্ঠিত হত। দেবী ইস্তারার উৎপত্তি সূর্য বা অগ্নি থেকে। ভারতের দেবী দুর্গাও তাই।
ইস্তারার দুপাশে সিংহ এবং সর্প আছে যেখানে সিংহ সূর্যের প্রতীক এবং সর্প মেঘ বা বিদ্যুতালোকের প্রতীক। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশে এই দেবীর পূজা বিস্তার লাভ করেছিল।
জ্যাগ্রোসে ইস্তার দেবীর একটি মূর্তি আছে। সেখানে তিনি সিংহের ওপর দুটো পা তুলে ডান হাতে সিমোন-অসুরকে দলন করছেন, যেমন দুর্গা দলন করছেন সিংহবাহিনী হয়ে মহিষাসুরকে। প্রকৃত পক্ষে ভারতের শক্তি পূজা বানিজ্যিক ও ধর্ম প্রচারের সূত্রে বিশ্বের অপরাপর দেশ গুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল।

তবে দেবীর যে মূর্তিকে আমারা সাড়ে তিনশো চারশো বছর ধরে পুজো করি তার পিছনেও একটা ক্রমবিকাশের ইতিহাস আছে। মানুষ গোড়ার দিকে স্থুল ও জড় বস্তুকেই ভগবান রূপে মান্যতা দিত।
সূর্য এবং বরুণ দেবতা রূপে একছত্র আধিপত্য করতো। পরে জ্ঞান, বুদ্ধি, ও জাগতিক অভিজ্ঞতার বিকাশের সাথে সাথে মানুষ আর সেই জড় বস্তুর পুজোতেই আবদ্ধ থাকলো না। ঔপনিষদ যুগ তখনই প্রভাব বিস্তার করলো ভারতীয় সমাজের বুকে।
দুর্গা পুজোর ইতিহাসের কথাও তাই। বৃক্ষ, যূপ, স্তুপ, ও স্তম্ভের ভিতর দিয়ে প্রতীক পুজোর বিকাশ ঘটলো যখন ভারতীয় সমাজে তখনই দেখা দিল মূর্তিশিল্পের যুগ। যখন স্তুপকে অনুকরণ করে শিল্পীরা সৃষ্টি করলেন পাথর, মাটি কাঠ দিয়ে বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি।
বৈদিক সাহিত্যে বরুণ, সূর্য অগ্নি ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতাদের পুজোর যেমন কথা আছে তেমনি বৃক্ষ, যূপ, ও স্তম্ভ প্রভৃতির কথাও উল্লেখ আছে।
আকাশের দেবতাদের ছেড়ে মানুষ যখন পার্থিব সামগ্রীকে পুজো করতে শিখলো তখনই তারা বৃক্ষের পুজো আরম্ভ করল। সেই গ্রহন করার মাঝে ছিলো আরো একটি সার্থকতা।
হার্বার্ট স্পেন্সার ও সিগ্মুন্ড ফ্রয়েড টোটেম ও ট্যাবুর কথা এ প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করেছেন। ডঃ ফ্রেজার দুর্গাপুজোর ব্যবহৃত নবপত্রিকাকে বলেছেন টোটেম বৃক্ষ।
রায়বাহাদুর রামপ্রসাদ চন্দ তাকে বলেছেন কুলবৃক্ষ। তাঁর ‘ইন্ডো আরিয়ান রেসেস’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন – ‘The worship of Kula tree may be also regarded as a remnant of primitive totemish, for Kula also denotes family and Kulatree may be translated as totem tree.’

প্রাচীন কালে বৃক্ষকে কল্পনা করা হত সূর্যের আসন রূপে। আকাশের সঙ্গেও বৃক্ষ ছিলো সম্পর্ক যুক্ত। তাকে বলা হ’ত আকাশচুম্বী। যেন বৃক্ষের শির বা মস্তক আকাশ ছুঁয়ে আছে।
তার মানে যে সব গাছ উঁচু ও প্রসারিত ছিলো যেমন বট, অশ্বত্থ, বেল, অশোক, নিম প্রভৃতি, তাদেরকেই সূর্যের আসন বলা হ’ত।
উদাহরণ স্বরূপ যেমন বেল গাছের আরেক নাম জ্যোতির্বৃক্ষ। যজুর্বেদে সূর্যের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট উল্লেখ আছে – “তোমার পিতা মাতা তোমাকে বৃক্ষ শিখরে স্থাপন করেছে”।
এখানে সূর্যকে শিশুরূপে কল্পনা করা হয়েছে এবং আকাশ আর পৃথিবীকে সূর্যের পিতামাতা। পৃথিবীর আরেক নাম ‘অদিতি’। অদিতির গর্ভে সূর্যের উৎপত্তি একথা পুরাণকারেরাও বর্ণনা করেছেন। বৈদিক যুগে মানুষের ধারণা ছিলো সূর্য পৃথিবীর গর্ভ থেকে ওঠে আর সেখানেই অস্ত যায়। তাই পৃথিবীই সূর্যের জননী।
ইন্দো ইউরোপীয় জাতির মধ্যেও বৃক্ষ পুজোর প্রচলন দেখা গিয়েছিল। তারা ওক, আপেল, বা গোলাপ প্রভৃতি গাছ কে সূর্যের প্রতীক বলে পুজো করতো। হিব্রুরা তাই খ্রীষ্টান জগতে গোলাপ ফুল ও আপেলকে কখনো সূর্য আবার কখনো যীশু রূপে চিন্তা করেছে।
বৃক্ষ পুজোর পর এলো যূপ ও স্তুপ পুজো। যূপ ও স্তুপ বৈদিক যুগে যাগযজ্ঞে ব্যবহৃত হত। ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে বৃক্ষকে যেমন ‘সুরতরু’ ও তন্ত্রে ‘কল্পতরু বা কল্পলতিকা প্রভৃতি বলা হয় যূপকেও তেমনি সূর্যের সঙ্গে কল্পনা করে ‘আদিত্য যূপ’ বলা হয়ে থাকে।
ইজিপ্টেও যূপ পুজোর প্রচলন ছিল। সেখানে যূপ কে বলা হত ‘টাউট’। ইজিপ্টবাসীরা টাউট কে কল্পনা করতো ‘ওসাইরিস’ দেবতার শরীর রূপে। ওসাইরিস সূর্য দেবতা। হিব্রুদের যূপের নাম ছিলো ‘আসেরা’। আসেরা বা অ্যাসেরা আসলে একজন দেবী। তিনি ভারতের দেবী দুর্গারই অভিন্নরূপ।

প্রাচীন কালে অশ্বত্থ, নিম বেল গাছ কেই দুর্গা রূপে যে পুজো করা হত তার প্রমান তন্ত্র বা পুরাণসাহিত্যে পাওয়া যায়।
এখনো দুর্গা পুজোয় ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বেল গাছের পুজো হয়। ষোড়শোপচারে পুজোর সময় আমরা মন্ত্র পড়ি – ‘ওঁ বিল্ববৃক্ষায় নমঃ’। ষষ্ঠী তিথিতে বিল্ববরণ ও বৃক্ষের পুজোর পর সপ্তমীর সকালে পুনরায় বৃক্ষের ফল সহ শাখা ছেদের নিয়ম আছে।
ঐ শাখায় নাকি বৃক্ষ রূপে দেবীদুর্গা আরোহণ করে থাকেন। শাঁখ ঘন্টা বাজিয়ে ঐ শাখা দেবীকেই পুজো মন্ডপে আনা হয় ও নবপত্রিকার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়।
শুধু বেল গাছের পুজোর মধ্যে দিয়ে দুর্গা পুজো শেষ হয় না। দেবী যে প্রাচীন কালে সুনিশ্চিত ভাবে বৃক্ষ রূপিনী ছিলেন তার স্মৃতির স্বরূপ নব-পত্রিকা পুজোর বিধি আছে। নবপত্রিকা মানে নটি পবিত্র গাছ বা তার শাখার একত্রিকরণ।
অপরাজিতা লতা দিয়ে এই নটি শাখাকে বাঁধা হয়। এই নটি গাছ হ’ল, “ রম্ভা, কচ্চি হরিদ্রা চ জয়ন্তী বিল্বদাড়িম্বী, অশোকমানকশ্চৈব ধান্যশ্চ নবপ্ত্রিকা।“ ধারনা করা হয় এই নটি গাছে কুলযোগিনীরা বাস করে।
এরা সবাই দুর্গার লীলা সহচরী বা কোথাও দুর্গা নিজে অধিষ্ঠান করেন। বাংলাদেশে পূর্বে সাধারন মানুষ দুর্গাপুজোর পরিবর্তে নবপত্রিকার পুজো করতো এবং এখনো সেই পুজোপদ্ধতি অক্ষুন্ন আছে।

ভারতে নবরাত্রির অনুষ্ঠান হয়। আশ্বিনের শুক্ল প্রতিপদ থেকে নবমীতিথি পর্যন্ত এই নবরাত্র। তাছাড়া নটি গাছের শাখা বা ডাল নবপত্রিকায় বেঁধে দেওয়া হয় কলাবউ এর সাথে। ঐ ‘কলা-বউ’ এর পূজার সঙ্গে নবপত্রিকারও পূজা হয়। তাই এই নবপ্ত্রিকার নাম নব দুর্গাও বটে।

হিন্দু জাতি দেবী দুর্গার পুজোর সময়ে ক্রমবিকাশের প্রায় সকল প্রমান ও চিহ্ন গুলোকে গ্রহন করে ইতিহাসের মান রক্ষা করেছে। বিল্ববৃক্ষ, বিল্বশাখা, নবপত্রিকা, কলাগাছ, জলপূর্ণ ঘট সবগুলো একত্রিত করে দুর্গার আরাধনাকে পরিপূর্ণ করা হয়েছে।
জলপূর্ণ ঘট এখানে যূপ বা স্তুপ পুজোর নিদর্শন ও প্রতীক। ঘটের মুখে নারকেল ফল সূর্য পুজোর সাক্ষ্য। ঘটে সিঁদূরও রক্তবর্ণ সূর্যের প্রকাশক। ঘটের পল্লব বৃক্ষ পুজোর নিদর্শন। দর্পন প্রতীক পুজোর চিহ্ন। ঘটের মধ্যে যে জল তাকে কল্পনা করা হয় ক্ষীরদ সাগর রূপে।
বৈদিক যুগে আকাশকে বরুণ বা ঐ ক্ষীরদ সাগর রূপে কল্পনা করা হত। সূর্য ক্ষীরদ সাগরে উঠে স্নান করে আবার সন্ধ্যায় ক্ষীরদ সাগরে ডুবে যায় এটাই ছিল প্রাচীন ধারনা। আকাশ নীল বর্ণ এবং জলের রঙও নীল তাই আকাশকে সাগর কল্পনা করা স্বাভাবিক ছিল।
আকাশস্থ সূর্য ছিলো ক্ষীরদসাগরশায়ী সূর্য। এই জ্যোতিষ্মান সূর্য থেকেই পুরাণে কল্পিত হয়েছে অনন্ত শয্যাশায়ী নারায়ণের। ‘নার’ অর্থাৎ জল আর ‘আয়ন’ অর্থাৎ শয়ন। জলে যিনি শয়ন করেন তিনিই নারায়ণ। সূর্যেরও আরেক নাম তাই নারায়ণ।
কল্যানসুন্দর শিবও তাই। সূর্যকেও শিব রূপে কল্পনা করা হয় কারন এমন একদিন ছিলো যখন মানুষ বুঝেছিল সূর্য না থাকলে বিশ্বব্রহ্মান্ড বাঁচতে পারে না, সূর্য তেজের অভাবে সব হিমময় হয়ে যাবে। তাই সূর্য ছিলো কল্যান আর জ্যোতির প্রতীক।
এখনও তাই শিব অর্থেই স্বস্তিক বা মঙ্গল। বেদে রুদ্রর আরেক নাম অগ্নি। রুদ্রই পরে শিব নামে পরিচিত। পৌরাণিক যুগেই হিমালয় কন্যা দেবী উমার সঙ্গে শিবের পতি পত্নী সম্বন্ধ পাতানো হয়েছিল।
পৌরাণিক যুগের ধারণা উপনিষদের যুগে ভিন্ন ছিলো কাজেই হিমালয় দুহিতা উমা গৌরী বা দুর্গা হবেন কিনা সেই নিয়ে একটা মতবিরোধ থেকেই যায়।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584