শুভদীপ ভট্টাচার্য, বহরমপুরঃ
রাজ্যজুড়েই সিপিএমের দূর্গে একের পর এক ফাটলে যখন বিপর্যস্ত সিপিএম, হারের পরিসংখ্যানের তালিকাও হয়ে উঠছে ক্রমশ লম্বা, ভুলের খেসারত দিতে দিতে যখন নাভিশ্বাস কেন্দ্রীয় কমিটি’র নেতাদেরও, সে সময় আবারও সাংগাঠনিক ধ্বসের মুখোমুখি মুর্শিদাবাদ জেলা সিপিএম। দলীয় তরফে নানা বঞ্চনা, দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক আবহাওয়ার বদলে বুরোক্রেসির গর্জনই প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা ও কোনোরূপই মার্কসীয় লাইনের তোয়াক্কা না করে কেবলই নেতা তোয়াজের ফলে পদ আঁকড়ে সংগঠন প্রক্রিয়ার চুড়ান্ত নৈতিক ক্ষয়ের প্রতিবাদে দল ছাড়লেন মইনুল হাসান। সিপিএমের এককালীন লোকসভার সাংসদ, পরবর্তীতে রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন মাইনুল হাসান। একদা জেলা সংগঠনের অন্যতম মুখও ছিলেন তিনি। দলের চুড়ান্ত সংকটময় পরিস্থিতিতে সামাল দিয়েছেন নানা ঝড় ঝাপটা। সংগঠন বিস্তারে গ্রাম থেকে গ্রামে পৌঁছে করেছেন সংগঠন, মানুষের রায়ে জিতেছেন বিপুল ভোটে। লড়াইয়ের মাধ্যমে মানুষকে চিনতে শিখিয়েছেন ‘নীতির লড়াই’। কে এন কলেজের দাপুটে বিরোধী ছাত্রসংগঠন গুলির বিরুদ্ধতা বা কংগ্রেসের গড় মুর্শিদাবাদ জেলায় দুর্জয় ঘাঁটি গড়তে সক্ষম নেতা মাইনুল হাসান। তার নামেই এলাকার মানুষ চিনত পতাকার রং, পার্টির নাম। বামশাসনের ৩৪ বছরের পতনের পর নানা রদবদল হয় দলে। নেতার, নীতিরও পরিবর্তন হয় বিস্তর। একদা পরাক্রমশালী নেতারা একে একে হতে থাকেন দলবিরোধী, পার্টি ছাড়েন অনেকেই, কেউ বা ভিড়ে যান বিরোধী শিবিরে। ঋতব্রত, রেজ্জাক মোল্লা বা লক্ষণ শেঠ এর মত দলীয় মুখ’রা আজ অন্য দলের মুখ ও হোতা হয়ে দাপাচ্ছেন রাজ্য রাজনীতির ময়দান। এ কৃতিত্ত্ব নিঃসন্দেহে যায় সিপিএমের ঝুলিতে, একদা এরকম দাপুটে সংগঠকদের গড়ে তোলার পেছনে রয়েছে দলের অসংখ্য নেতাকর্মীর ঘাম রক্ত। দিন যত এগিয়েছে বিরুদ্ধতার সুরও চড়েছে ততই কর্মী-সংগঠক-নেতাদের মধ্যে। কখনও কংগ্রেস এর সঙ্গে জোট বা বিজেপি বিরোধীতার রাজনৈতিক লাইন নিয়ে চলেছে দীর্ঘ চাপানউতোরের পর্ব।
এদিন প্রেস কনফারেন্সে রীতিমত সেইসব বিষয়েই ক্ষোভ ঘৃণা উগরে দিলেন মইনুল হাসান। তিনি জানান বিজেপি একটি ফ্যাসিস্ট শক্তি, ফ্যাসিস্ট দল কিনা, এ নিয়েই দ্বন্দ বিভ্রান্তি রয়েছে দলের শীর্ষ নেতাদের। ফলতই সাম্প্রদায়িকতার চোরা বাণ ঢুকছে মানুষের মনে, বাড়ছে হিংসা, ঘটছে দাঙ্গা, কিন্তু সিপিএম রয়ে গেছে সিপিএমেই। রণনীতি নিয়ে চরম বিভ্রান্তি কোনো বাম দলের কাছেই আশা করা যায়না, সিপিএমেরও এই দলীয় বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মইনুল। একই সঙ্গে জানিয়েছেন নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রের দলের রয়েছে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক মনোভাব। যোগ্যতাসম্পন্ন দলিত বা মুসলমানরাও বঞ্চিত হন অনেকাংশেই এমনটাই অভিযোগ মাইনুলের। একদা ঋতব্রত’র মহম্মদ সেলিম কে ‘কোটার নেতা’ সম্মোধনে শোরগোল পড়েছিল বঙ্গ রাজনীতিতে, এইদিনও সেই সুরই শোনা গেল মাইনুলের কন্ঠে। তিনি বলেন, বড় নেতাদের পদলেহনকারী বা স্তাবকরাই পেয়ে থাকেন আগামীর উত্তরসূরীতার দায়ভার, যা নিতান্তই অগণতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্টবিরোধী আচরণ। পাশাপাশি নব্বই দশক পরবর্তীকালীন সময়ে বদলে যাওয়া আর্থসামাজিক পরিবেশ, রাজনীতির ধরণ ধারণ, মানুষের চাহিদা ও মনন এবং সাংস্কৃতিক শূন্যতা ও তার পূরণে অনেকটাই অপারগ বর্তমান সিপিএম নেতৃত্ব। কারণস্বরুপ তিনি বলেছেন নেতাদের পিছিয়ে পড়া মানসিকতা,যুগোপযোগী মার্কসবাদী বিশ্লেষনের বদলে ক্ল্যাসিক্যাল মার্কসবাদের ক্রমাগত মন্ত্রপাঠ। বর্তমান ভারতের নবপ্রজন্মকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের রাজনীতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে গুরুবাদ কায়েমের রাজনীতিকে ভর্ৎসনা করেছেন মইনুল হাসান। দলের অভ্যন্তরে স্বৈরাচার ও সর্বোপরি যুক্তি তর্ক, আলাপ আলোচনার পরিবেশ কার্যতই নেই, বহুবার আর্জি, আবেদন নিবেদনে কোনঠাসা হয়ে ব্যার্থ মনস্কামে দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন মাইনুল হাসান এমনটাই জানিয়েছেন তিনি। দলের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য এবিষয়ে কোনো মন্তব্যই করেননি। বরাবরের ন্যায় নীরবতা জ্ঞাপনে মন্তব্যের দায় তিনি অর্পন করেছেন রাজ্য কমিটির ঘাড়েই।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584