নবনীতা দত্তগুপ্ত, বিনোদন ডেস্কঃ
‘অদ্ভুত আঁধার এক’ এসেছে এ পৃথিবীতে আজ। বিশ্বাসের ঝুলি শূন্য প্রায়। প্রতিদিন নিক্তি মেপে বেড়ে চলেছে হিংসা চক্রবৃদ্ধি সুদে, সঙ্গে বেড়ে চলেছে তার অমোঘ পরিণতি – শোষণ। এক নতুন দশকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি সীমাহীন অনিশ্চয়তা, অহং আর দম্ভের আস্ফালন। বিগত দিনে আমরা বারবার দেখে এসেছি সমাজের চোখরাঙানি, ধর্মের অবিসম্বাদিত রূপ এবং আশ্রয় খুঁজেছি বিজ্ঞানের কাছে। কিন্তু আজ যখন অহংবোধ গ্রাস করছে আমাদের মনন, বিজ্ঞান তার সৃজনশীল ও চিরনতুন তকমা ছুঁড়ে ফেলে হয়ে উঠতে চাইছে প্রশ্নাতীত তখন কোথায় দাঁড়াবো আমরা?
প্রশ্ন তোলা জরুরি, প্রশ্ন তুলতে হবে বারবার এই সমাজের প্রতিটি ঘোষিত বা অঘোষিত নীতির বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের প্রতিটি কৌশলের ব্যাখ্যা চাইতে হবে এবং সর্বোপরি প্রশ্ন তুলতে হবে সভ্যতার সকল ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে – মানবতার সামনে কিছুই প্রশ্নাতীত হতে পারে না।
আরও পড়ুনঃ ১০ জুন থেকে শিশুশিল্পী ছাড়া টলিউডে শুরু হতে চলছে শুটিং
তাই প্রতিবারের মতো এবারও বেঙ্গল রেপার্টরি থিয়েটার গ্রুপ মঞ্চ থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে সভ্য সমাজের প্রতি, ঠিক যেমন তারা প্রশ্ন তুলেছিল স্বাধীনচেতা সাংবাদিক ও লেখকদের বিরুদ্ধে নেমে আসা রাষ্ট্রের নির্মম আঘাতের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের মঞ্চসফল প্রযোজনা ‘অশ্বথামা- দ্য ওয়ার মেশিন’ নাটকে। এবারও একইভাবে প্রশ্ন তুলেছে ঋক অমৃত-র কলম। তাদের নবতম প্রযোজনা ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ নাটকটির মধ্য দিয়ে। সম্প্রতি কলকাতার যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমিতে হয়ে গেল নাটকটির প্রথম অভিনয়।
জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতার অভিঘাতে অরিন্দম সাহা সর্দারের রচনা অবলম্বনে ঋক অমৃত সাজিয়ে ফেলেছে আস্ত একটি নাটক, ‘অদ্ভুত আঁধার এক’। আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ মিনিটের একটি প্রযোজনা যার চলনের প্রতি পদক্ষেপে উঠে আসে নতুন প্রশ্ন। অভিনেতাদের শরীর প্রশ্ন ছোঁড়ে এই অবক্ষয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে সমাজে নারীর অবস্থান, তার সুরক্ষা- শারীরিক ও মানসিক দুই নিয়েই। পাশাপাশি আয়না মেলে ধরে সময়ের। যে কালের ঘূর্ণাবর্তে আমরা এগিয়ে চলেছি অজানিতের পথে, সেই যাত্রার প্রতি পরতে ধ্বনিত হয় লাঞ্ছনার-অবমাননার ইতিহাস। মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে নারীকণ্ঠ প্রশ্ন তোলে উচ্চৈঃস্বরে, পরক্ষণেই সে নিজেও অধঃপাতিত হয় সেই কালগর্ভে।
আরও পড়ুনঃ ওয়াঘার পথে জালিওয়ানাবাগে কিছুক্ষন
তবে এই নারী-পুরুষ বিভেদের বাইরে ও যে আর একটি প্রশ্ন থেকে যায় তা হল সুন্দর আর অসুন্দরের। যা কিছু নির্মল তাই কলুষিত হয় বারবার। এই গ্রহে নারী-পুরুষ কেউ নিরাপদ নয়। পুরুষ নিরাপদ নয় নারীর জন্য, আবার নারীও নারীর জন্য নিরাপদ নয়। একইভাবে তা প্রযোজ্য পুরুষের ক্ষেত্রেও এবং সেই সত্যটি বা ধারণাটির কথা নির্দেশক আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে সুকৌশলে।
কবিতা লেখা কঠিন, কিন্তু মঞ্চে একটি জীবন্ত কাব্যকে প্রতিভাত করা বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে আর সেজন্যই ঋক অমৃত-র পিঠ চাপড়ে দিতে হয়। তাঁকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছে তাঁর সেনাপতি সৌমিক মণ্ডল। নাট্যের প্রথম মুহূর্ত থেকে সৌমিকের দৃশ্যকাব্য দর্শককে ওই অন্ধকারের কথাটি বিশ্বাস করায়। নাট্যটির আবহ যথাযথ, কখনোই তা মূল বিষয়কে ছাপিয়ে যায়নি। ঋতুশ্রী চৌধুরীর অভিজ্ঞ হাত অভিনেতাদের শরীরকে বেঁধেছে নিপুন ছন্দে। কিন্তু অভিনয়ের কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
এক ঝাঁক নতুন স্বপ্ন নিয়ে খেলতে নেমেছিল বেঙ্গল রেপার্টরি। অভিনেতাদের কেউ কেউ প্রথমবার অভিনয় করলো পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে, আবার কারো কারো ঝুলিতে এর আগে অল্প কয়েকবারের অভিজ্ঞতা; আর সেই পুঁজিকে সম্বল করে তারা দেখিয়ে দিল “Theatre is a collective art”। কোনও অভিনেতার কথা আলাদাভাবে বলছি না। তা হলে তাঁদের এই প্রয়াসকেই লঘু করা হবে। একে একে মঞ্চে দাপিয়ে বেড়ায় অন্বেষা, ছন্দবাণী, আহেলি, অঙ্কুর, উর্বি, হৃদয়, সৌরভ এবং সুলক্ষণা। আশা রাখি দিনে দিনে এই আগুন আরও দানা বাঁধবে এবং ছড়িয়ে পড়বে দিকে দিকে।
অন্যান্য সকল প্রযোজনার মতই এই প্রযোজনারও কিছু ত্রুটি থেকে যায় এবং তা থিয়েটারের জীবন্ত থাকার প্রামাণ্য দলিল। সেই নিয়ে নিশ্চয়ই থিয়েটারের প্রাজ্ঞ মানুষেরা তাঁদের মতামত জানিয়েছেন বা জানাবেন এবং বেঙ্গল রেপার্টরির শিল্পীদের অনুশীলনও চলবে জোর কদমে। কিন্তু সেই অনুশীলনের ধার তাদের প্রাণশক্তিকে যেন ভোঁতা করতে না পারে কোনওদিন। তাদের অনুসন্ধিৎসু হৃদয় যেন কখনও শকুন ও শেয়ালের খাদ্য না হয়।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584