শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতাঃ
২ দিন আগে ফুলবাগানে পর পর ২ টি খুন এবং খুনীর নিজের আত্মহত্যার ঘটনার পরেও আরও বেশ কিছু তথ্যের সন্ধানে এখনও তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তবে পুলিশের সামনে বারবারই উঠে আসছে, দীর্ঘদিন ধরে রীতিমত পরিকল্পনা করে তবেই এই পর পর দুটি খুনের ঘটনা ঘটিয়ে তারপর আত্মঘাতী হয়েছেন অমিত।
ইতিমধ্যেই তার ফোনের পাসওয়ার্ড খুলে আনলক করতে পেরেছে পুলিশ। এতে প্রচুর তথ্য জানা সম্ভব হবে বলে আশা গোয়েন্দাদের। একই সঙ্গে কখনও সুপারি কিলার, আবার কখনও সাপের বিষ দিয়ে স্ত্রী-সহ শ্বশুরবাড়ির সকলকে খুনের পরিকল্পনাও সামনে এসেছে ৬৭ পাতার সুইসাইড নোট। পুলিশ জানিয়েছে, অমিতের মোবাইল নম্বরের ‘সিডিআর অ্যানালিসিস’-র কাজ শুরু হয়েছে। এদিকে এর আগে অমিতের কাছে থাকা সাত এমএম পিস্তলের ম্যাগজিন যেমন ভর্তি ছিল, তেমনই গুলি ভর্তি আরেকটি ম্যাগাজিনও সঙ্গে নিয়ে এসেছিল অমিত।
যদিও শ্বশুর পালিয়ে যাওয়ায় শেষমেশ তার পরিকল্পনা পুরোপুরি সফল হয়নি। এদিন দক্ষতার সঙ্গে অমিতের ফোনটি আনলক করতে সমর্থ হন তদন্তকারী অফিসাররা। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়েই অমিতের স্যামসাং ফোনটি আলনক করে পুলিস। ফোনের পাসওয়ার্ড ছিল ‘০০০০’। বার তিনেকের চেষ্টায় ফোনটি আনলক করে পুলিস। উল্লেখ্য, আর ২ বার চেষ্টা করলেই ফোনের সব রেকর্ড মুছে যেত। ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন ফরেনসিক দলের সদস্যরাও।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, ১৭ বছর ধরে প্রেম এবং ১৪ বছর আগে বিয়ে করে অমিত-শিল্পী। বিয়ের ৪ বছর পরে তাঁদের সন্তান হয়। স্ত্রীকে দমিয়ে রাখা স্বভাবের অমিত কখনই মেয়েদের স্বাধীনতার বিশ্বাস করত না। নিজের স্ত্রী শিল্পীকে চাকরি করতে দিত না। সব সময় ঘরের কাজেই ব্যস্ত রাখতে পছন্দ করত। যদিও শিল্পী ঠিক উল্টোটা চাইতেন। তিনি স্বনির্ভর হতে চেয়েছিলেন ৷ চাকরি করতে চেয়েছিলেন। এই বিষয় নিয়েই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ চলছিল। যাতে ইন্ধন জোগানোর অভিযোগ শ্বশুর বাড়ির লোকদের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুনঃ বাংলায় লকডাউন ৩১ জুলাই পর্যন্ত, ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর
দুই বিপরীত চিন্তাধারার মানুষ একসঙ্গে না থাকতে পেরে অমিত বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা দায়ের করে। যদিও বিচ্ছেদ চায়নি শিল্পী। বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করার পর ছেলে কার কাছে থাকবে তা নিয়েও গোলমাল ছিল। অমিত ছেলেকে তার কাছে রাখতে দিতে চাইছিল। স্ত্রী শিল্পী ও তার পরিবার তাতে রাজি ছিল না। তাতেও স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের উপর রাগ জন্মায় অমিতের। সব মিলিয়ে তাই শুধু স্ত্রী নয় গোটা শ্বশুরবাড়ির লোকদের উপর রাগ জন্মেছিল অমিতের। সে কারণেই শ্বশুরবাড়িতে সবাইকে খুন করে নিজে আত্মঘাতী হওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।
আরও পড়ুনঃ মধ্যরাতে রেড রোডে বেসামাল মদ্যপ যুবতী! অর্ধনগ্ন হয়ে নৃত্য, পুলিশকে চড়
পুলিস সূত্রে জানা গিয়েছে, স্ত্রী শিল্পী আগরওয়ালকে প্রথমে সাপের বিষ দিয়ে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল অমিত। আর সেই জন্যই সে সাপুড়েরও খোঁজ করছিল। এছাড়াও তদন্তকারীরা একপ্রকার নিশ্চিত যে, ফুলবাগানের দত্তাবাদ এলাকা থেকে বন্দুক সংগ্রহ করেছিল অমিত। অস্ত্র একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা ছিল। ক্যাব থেকে নেমে শ্বশুরবাড়ি ঢোকার আগে ওই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বন্দুক সংগ্রহ করে নেয় অমিত। সরাসরি অস্ত্র সরবরাহকারীর সঙ্গে অমিতের দেখা হয়নি।
প্রসঙ্গত, ক্যাব থেকে নেমে ৪ মিনিট হেঁটে শ্বশুরবাড়ি যায় অমিত। চাইলেই সোজা ক্যাবে করে শ্বশুরবাড়ি যেতে পারত। কিন্তু তা না করে বন্দুক সংগ্রহের জন্যই আগে ক্যাব থেকে নেমে পড়েছিল অমিত। তদন্তকারীদের ধারণা, ওই সময়েই সে বন্দুক সংগ্রহ করেছিল। তবে সে বিমানে করে বা অন্য কোনও মাধ্যমে অস্ত্র নিয়ে এসেছিল কি না, তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
এছাড়াও সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে পুলিশের অনুমান, সুপারি কিলার দিয়ে স্ত্রী এবং তাঁর বাপের বাড়ির লোকজনকে খুনের পরিকল্পনা করে অমিত। আসার আগে এক বন্ধুর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে তার কথা হয়। সোমবার বিকেলের উড়ানে বেঙ্গালুরু থেকে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় ফেরে অমিত। সন্তানকে বেলঘড়িয়ায় দাদার বাড়ি রেখে আসার দায়িত্ব ওই বন্ধুকে দেয় অমিত। সেই মতো বন্ধুও অমিতের সন্তানকে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেন। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে প্রি পেইড ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সিতে চড়ে অমিত। তারপর সোজা চলে যায় রামকৃষ্ণ সমাধি রোডে শ্বশুরবাড়িতে। পুলিশের দাবি, শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পথে একটি ল্যাপটপ ব্যাগে করে আগ্নেয়াস্ত্র নেয় সে।
সুপারি কিলার দিয়েই স্ত্রী এবং তার বাপের বাড়ির লোকজনকে খুন করতে চেয়েছিল সে। সুপারি কিলারের খোঁজে কখনও বিহার আবার কখনও তামিলনাড়ুও পাড়ি দিয়েছিল। তবে মাঝে লকডাউনের জন্য তার খুনের পরিকল্পনা বাধা পায়। তাই ঠিক করেছিল নিজেই শিল্পীকে শেষ করে দেবে। সে কারণে ইদানীং ইন্টারনেট ঘেঁটে কীভাবে খুন করা যায়, সে সম্পর্কে পড়াশোনাও করছিল অমিত। তারপরই স্ত্রীকে খুন করে সে। এই সমস্ত তথ্যই তার সুইসাইড নোটে পাওয়া গিয়েছে।
শিল্পীর ভাইয়ের দাবি, সন্তান জন্মানোর পর কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন শিল্পী। সেই থেকেই অমিতের সঙ্গে অশান্তির সূত্রপাত। স্ত্রীকে হাত খরচের টাকাও দিত না অমিত। এমনকী ২০১৬ সালের দিওয়ালির পর আর কোনও শাড়ি এবং জুতো কিনে দেয়নি সে। মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখার পর কফি খেলেও স্ত্রীকে সকলের সামনে অপমান করতে ছাড়ত না। অন্ততপক্ষে দু’বার বিদেশে চাকরির সুযোগ পায় মেধাবি অমিত। তবে ভারত ছেড়ে যেতে তাকে স্ত্রী শিল্পী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন বাধা দেয়। সে কারণে মনোমালিন্য থেকেই শিল্পী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584