শরীয়তুল্লাহ সোহন, ওয়েব ডেস্কঃ
এ যেন ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রতিচ্ছবি। জনি বেয়ারস্টো যখন জিমি নিশামের অসাধারণ ক্যাচটি নিলেন কিন্তু বাউন্ডারি লাইন টাচ করায় ছয় বলে আম্পায়ার সিগন্যাল দিলেন তখন হয়ত কিউইয়িদের মনে পড়ছিল বোল্টের ক্যাচের কথা। কারণ লর্ডসে এমন দূর্দান্ত ক্যাচ নেওয়ার পরই বাউন্ডারি লাইন স্পর্শ করায় শেষ হয়ে গিয়েছিল কিউইয়িদের শিরোপা জয়ের স্বপ্ন। যেমনটা আবু ধাবিতে গত রাত্রের ম্যাচে হয়েছে। স্বাক্ষী থেকেছে গ্যালারির কয়েক হাজার দর্শক সহ ক্রিকেট বিশ্বের বহু মানুষ।
গতকালের ম্যাচে কিউইয়ি অধিনায়ক টসে জিতে প্রথমে বল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ইংল্যান্ড আগে ব্যাট করতে এসে মঈন আলীর নিয়ন্ত্রিত ব্যাটিংয়ে এবং ডেভিড মালানের ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে ভর দিয়ে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৪ উইকেটের বিনিময়ে ১৬৬ রান সংগ্রহ করেন। যেখানে মঈনের অবদান ৩৭ বলে ৫৩ রান এবং মালানের অবদান ৩০ বলে ৪১ রান। আবু ধাবির পিচ কন্ডিশনে এই রান লড়াই জন্য যথেষ্ট ছিল বলে ধারণা ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ মহলের। সেই মতো মরগ্যানের দল লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৫ পনেরো ওভার পর্যন্ত ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল ইংল্যান্ড দল। এক পর্যায়ে নিউজিল্যান্ড এর কাছে ম্যাচটা নাগালের বাইরেই চলে গিয়েছিল। ১৫ ওভার শেষে ৪ উইকেটে ১০৭। ইংল্যান্ডের ১৬৬ রানের সংগ্রহটাকে দূরেরই মনে হচ্ছিল তখন।
উইকেটে তখনো ছিলেন ড্যারিল মিচেল। জিমি নিশাম এলেন! পরিস্থিতি পরখ করলেন। তারপরই ব্যাটিং ঝড় তুললেন। সেই ঝড়েই ঘুরে দাঁড়াল নিউজিল্যান্ড। দূর দিগন্তে থাকা লক্ষ্যমাত্রাটা কাছে টেনে এনেই দারুণ এক জয় তুলে নিল কিউইরা। ৫ উইকেটে জিতে ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর প্রথমবারের মতো টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল পৌঁছে গেল নিউজিল্যান্ড।
মার্টিন গাপটিল ফিরে গিয়েছিলেন দ্রুতই। প্রথম ওভারের তৃতীয় বলে, স্কোরবোর্ডে নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ তখন মাত্র ৪। ফর্মে থাকা গাপটিলকে হারানোটা ছিল দলের জন্য বড় ধাক্কাই। কেইন উইলিয়ামসনও দলীয় ১৩ রানের মাথায় আউট। দুটি আঘাতই আসে পেসার ক্রিস ওকসের বল থেকে। ইংলিশরা তখন আকাশেই উড়ছিল। প্রথমে ব্যাটিং করে স্কোরবোর্ড তোলা ১৬৬ রানটাকে তখন নিউজিল্যান্ডের জন্য অনেক দূরের বিষয়ই হয়তো মনে করছিলেন অধিনায়ক এউইন মরগান। ক্রিস ওকসকে টানা ব্যবহার করলেন, সঙ্গে মার্ক উডকে। কিন্তু নিউজিল্যান্ড তখন স্বপ্ন দেখছে ঘুরে দাঁড়ানোর, সেটি গাপটিলের সঙ্গী ড্যারিল মিচেলের কল্যাণেই। উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান ডেভন কনওয়েও তখন সঙ্গী তাঁর। এ দুজন, মাথা ঠান্ডা করে স্কোরবোর্ডটাকে রাখলেন সচল।
ইংল্যান্ডের মাথায় তখন বোলারদের ঠিকমতো ব্যবহার করা নিয়ে ভাবনা। ৬৭ বলে ৮২ রান তুলে এ জুটি যখন চোখ রাঙাচ্ছে, ঠিক তখনই মরগান তাসের দান ছাড়লেন লিয়াম লিভিংস্টোনকে আক্রমণে এনে। লিভিংস্টোন এসেই বাজিমাত করলেন। ফেরালেন কনওয়েকে, ৩৮ বলে ৪৬ রান করে তিনি যখন ফিরছেন, তখন তাঁর চেহারায় দলকে আরও কিছু দূর এগিয়ে দিয়ে আসতে না পারার আক্ষেপ। কিন্তু লিভিংস্টোন এখানেই থেমে গেলেন না। আউট করলেন গ্লেন ফিলিপসকেও। তাঁর বলে স্যাম বিলিংস যখন ফিলিপসের ক্যাচ নিলেন, তখন ম্যাচ আবারও ঘুরে গেল ইংল্যান্ডের দিকে। ১৫ ওভারে ৪ উইকেটে ১০৭- ইংলিশরা জয়ের আশা সে সময় করতে শুরু করেছিল।
কিন্তু ইংল্যান্ড খুব সম্ভবত ভুলে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড দলে জিমি নিশাম নামে একজন আছেন, তিনি খুব জোরে মারতে পারেন। মিচেলও তো একপ্রান্ত ধরে রেখেছিলেন। নিশাম উইকেটে এসেই শুরু করলেন তাণ্ডব—মাঠের চারদিকে তুলে তুলে মারতে লাগলেন তিনি। ১৭তম ওভারটি করতে এলেন ক্রিস জর্ডান। কিন্তু ওভারটা হলো বাজে- ইংলিশ দৃষ্টিকোণ থেকেই। ওয়াইড করলেন, বাজে জায়গায় বল ফেললেন। মিচেল আর নিশাম এ ওভার থেকে তুলে নিলেন ২৩ রান। স্বপ্নের মতো এক জয় তুলে নেওয়ার পথে তখন অনেক দূরই এগিয়ে গেছে নিউজিল্যান্ড। নিশাম মাত্র ১১ বলে খেললেন ২৭ রানের ইনিংস। সেটিতে ছিল একটি বাউন্ডারি, আর তিনটি বিশাল ছক্কা।
নিশামকে ইংল্যান্ড ফেরাল ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে কিছুটা দেরিই হয়তো হয়ে গেছে। ১৮তম ওভারে নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ তখন ৫ উইকেটে ১৪৭। বাকি কাজটা সমাধা করতে হতো সেট ব্যাটসম্যান মিচেলকেই। সেটি তিনি দারুণভাবেই করলেন। শেষ পর্যন্ত ৪টি চার ও ৪টি ছক্কায় মিচেল করলেন ৪৭ বলে ৭২ -একেবারে ম্যাচজয়ী ইনিংস। স্ট্রাইকরেট ছিল ১৫৩.১৯। এই অসাধারণ ইনিংসে তাকে এনে দিয়েছে ম্যাচ সেরার পুরস্কার। তার সাথে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়া নায়ক নিশামের স্ট্রাইকরেটের কথা না বললে খুব অন্যায় করা হবে- ২৪৫.৪৫!
আরও পড়ুনঃ বাংলার নবতম গ্র্যান্ডমাস্টার মিত্রাভ
এই প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল নিউজিল্যান্ড। তবে ক্রিকেটের বিশ্ব আসরে এ নিয়ে টানা তৃতীয় ফাইনাল তাদের। ২০১৫ ও ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর এবারের টি-টোয়েন্টি ফাইনাল। দুই বছর আগে লর্ডসের হৃদয় বিদীর্ণ করা হার দেখেছিল তারা এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই। গত রাতে ইংল্যান্ডকে হারিয়েই সে ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিল তারা। তবে টানা তৃতীয় ফাইনালে এসে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপটা খুব করেই পেতে চাইবে তারা। কিউইদের এই দলটার জন্য সেই গৌরবটা যে প্রাপ্যই। টেস্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা এবার সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও কি পারবে একটা গৌরব ঘরে নিতে? সেই প্রশ্নই ঘুরছে সবার মনের কোণে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584