উমার ফারুক,তরুণ সাংবাদিক
নীতীশ কুমার বুধবার বিকেলে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেন,এই ঘটনায় অনেকেই অবাক হয়েছেন।কিন্তু মনে রাখা দরকার যে নীতীশ ১৭ বছর এনডিএ জোটের সঙ্গে থাকার পর জোট থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন তাঁর পক্ষে ২০মাসের মহাজোট থেকে বেরিয়ে আসা কি খুব বিস্ময়ের ব্যাপার।আসলে নীতীশ কুমার ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকতে পছন্দ করেন।আজ যে নীতির প্রসঙ্গে মহাজোট থেকে বেরিয়ে এলেন সেই নীতির প্রসঙ্গেই তিনি এনডিএ জোট ত্যাগ করেছিলেন।নীতীশের এনডিএ জোট ছাড়ার কারণ ছিল বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী।দাঙ্গার মুখ মোদী কে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে পারেননি ধর্মনিরপেক্ষ!নীতীশ কুমার।প্রকৃতপক্ষে মোদীজি তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশজি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী,প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার প্রতিযোগিতায় তিনি নিজেকে দাবিদার মনে করেছিলেন।তাই নরেন্দ্র মোদীকে তিনি মেনে নেননি এনডিএ জোট ছেড়ে ২০১৩ সালের ১৬ই জুন বেরিয়ে গেলেন।তিনি যখন আবার এনডিএ জোটে ফিরে যাচ্ছেন তখন এনডিএ জোটের প্রধানমন্ত্রী সেই নরেন্দ্র মোদী আর বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ।তবে কি নীতীশ কুমারের কথিত দাঙ্গার মুখ নরেন্দ্র মোদী,অমিত শাহ এখন সাফ সুতরা হয়ে গেলেন?প্রশ্ন উঠছে রাজনৈতিক মহলে।এই প্রসঙ্গে সিপিআইএম সাধারণ সম্পাদক তথা রাজ্যসভা সাংসদ সীতারাম ইয়েচুরি ট্যুইট বার্তায় বলেন-‘দেশে যখন দলিত-সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার প্রতিদিনই বাড়ছে তখন এই পদক্ষেপ কার স্বার্থে?”খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কথা।যে তেজস্বী প্রসাদ,লালু প্রসাদের দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ করবেন না বলে তিনি মহাজোটের মুখ্যমন্ত্রী থেকে ইস্তফা দিলেন সেই লালু প্রসাদ কি মহাজোট গঠনের সময় সাফ সুতরা ছিলেন?তবে তিনি কেন দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে লড়াই করলেন মুখ্যমন্ত্রী হলেন।এইসব প্রশ্ন জাতীয় রাজনীতিতে চর্চা হচ্ছে।তবে তিনি যে নীতির কথা বলে বারবার জোট বদল করছেন সেটি প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকার নীতি।আসলে ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে মোদী ঝড়ে খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়ে বিহারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছিলেন নীতীশ।বিহারের ৪০ লোকসভা আসনের মধ্যে নীতীশের ক্ষমতাসীন জেডিইউ পায় মাত্র ২টি আসন।লালুর আরজেডি পায় ৪টি আসন আর বিজেপি ২২টি আসন।নীতীশ কুমার নির্বাচনে দলের ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে তখন মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিলেন।তারপর তারই একান্ত অনুগত জিতেনরাম মাঝিকে তিনি পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী করেন(যদিও এই মাঝিই বিজেপির সমর্থন নিয়ে নীতীশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন)।তিনি যে মুহূর্তে ইস্তফা দিলেন তখন বিহারে বিধানসভা ভোটের মাত্র দেড় বছর বাকি।এই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি জনগণের সহানুভূতি আদায় করতে চায়লেন।পরবর্তী ৫বছর রাজ করার জন্য নীতীশের মতো দুঁদে রাজনীতিবিদের এটি ছিল কৌশল মাত্র।তিনি পাঁচ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দেড় বছর কে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হলেন।
তারপর বিহারে অপ্রাসঙ্গিক নীতীশ প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেতে লালু প্রসাদ যাদব ও কংগ্রেসের সঙ্গে মহাজোট করে ২০১৫ বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই করলেন।নির্বাচনে মোট ২৪৩টি আসনের মধ্যে মহাজোট ১৭৮টি আসন নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলো।লালুর আরজেডি ৮০টি আসন নিয়ে বৃহৎদল,নীতীশের জেডিইউ ৭১টি আসন ও কংগ্রেস ২৭টি আসন পেল।আর মোদী ঝড় বিহারে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল বিজেপির প্রাপ্তি মাত্র ৫৩টি আসন।লালুর আরজেডি সর্ববৃহৎ দল হওয়া সত্বেও নীতীশ কুমার কেই মুখ্যমন্ত্রী করে লালু নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে জোট ধর্ম পালন করলেন।কিন্তু ২০ মাস শাসন করার পরে যখন নীতীশ বুঝতে পারলেন জাতীয় রাজনীতি তে কংগ্রেসের থেকে বিজেপির ক্ষমতা বেশি তখন তিনি দুর্নীতির বাহনা দিয়ে মহাজোট থেকে বেরিয়ে এলেন।নীতীশ বিরোধী জোটে থাকতে পারলেন না।মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি উপমুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করতে বা তাকে বরখাস্ত করতে পারতেন।তিনি সে পথে গেলেন না, মহাজোটে কোন আলোচনা ও রাখলেন না।হঠাৎ করে নিজেই মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে বসলেন।আর তারপরেই ১৫ ঘন্টার মধ্যে বিজেপির সমর্থন নিয়ে বৃহস্পতিবার বেলা ১০টায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন।মহাজোটের সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে নীতীশ বিজেপির সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখেছিলেন।তাই তিনি আগ বাড়িয়ে রাষ্ট্রপতি পদে এনডিএ প্রার্থী রামনাথ কোবিন্দ কে সমর্থন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে নৈশভোজে অংশ নেন।নীতীশ বিজেপির সঙ্গে বোঝাপড়া করে আগেই চিত্রনাট্য তৈরি করে রেখেছিলেন।তিনি শুধুমাত্র মঞ্চস্থ করার অপেক্ষায় ছিলেন। তাই পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক বিহারের দায়িত্ব প্রাপ্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরী নাথ ত্রিপাঠী পাটনায় বুধবার রাজভবনে উপস্থিত ছিলেন।রাজ্যপাল বৃহত্তম দল আরজেডি কে সময় সুযোগ না দিয়েই বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার পরিবর্তে সকাল দশটায় তড়িঘড়ি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান করলেন।নীতীশ কুমার ২০১৯ লোকসভায় বিজেপির হাত ধরে জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেতে চায়ছেন।তাছাড়া কেন্দ্রে বন্ধু সরকার থাকলে রাজ্যে তার কাজ করতে সুবিধা হবে।তাই তিনি লালু ,কংগ্রেসের মহাজোটে না থেকে কেন্দ্রের শাসক এনডিএ জোটে যাওয়া কে তার ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ মনে করে তাতে সামিল হলেন।কিন্তু তিনি বিহারের বিধানসভা ভোটের (বিজেপি বিরোধী) জনমত কে যে অসম্মান করলেন তাতে কোন সংশয় নেই।জনগণ নির্বাচনে বিজেপি কে আটকানোর জন্যে মহাজোট কে ভোট দিয়েছিলেন।তাহলে তিনি কোন নৈতিকতার প্রশ্নে বিজেপির সমর্থন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিলেন।তিনি আবার জনমত যাচাই করলেন না কেন?প্রশ্ন উঠছে বিজেপির নৈতিকতা নিয়েও তারা কেন পিছন দিক থেকে মাত্র ৫৩টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় ভাগ বসালেন।বিহার বিধাসভা নির্বাচনের পূর্বে মোদী মহাজোটকে ‘থ্রি ইডিয়ট’এর জোট বলেছিলেন।আর বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেছিলেন-‘নাতিযে পাটনা মে নিকলেগি তো পাটাখা পাকিস্তান মে ফুটেগি’।বিজেপি বিহারের ক্ষমতায় আসার জন্য সেই ‘থ্রি ইডিয়ট’এর অন্যতম ইডিয়ট এরই হাত ধরল।এবার পাটনার পট পরিবর্তনে কোথায় ‘পাটাখা’ফাটবে তার কথা কিন্তু অমিত শাহ বললেন না।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র আজ এই সব ক্ষমতালোভী নীতি আদর্শ হীন দল বা নেতার দ্বারা কলুষিত হচ্ছে।জনমানসে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে রাজনৈতিক দল বা নেতারা।জনগণ যাদের ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করছেন তারা যদি ক্ষমতার জন্য জনগণের সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করেন তবে মানুষ কী করে গণতন্ত্রের উপর আস্থা রাখবেন।রাজনীতিতে নীতি আদর্শ বলে কি আর কিছুই থাকলো না?এই প্রবণতা গণতন্ত্রের জন্য খুবই মারাত্মক।আগামীদিনে যা ভয়ংকর রূপধারন করবে।ভারতীয় রাজনীতিতে সবকিছুই ক্ষমতা কেন্দ্রিক,জনহিতের থেকে ব্যক্তিহিত ই প্রাধান্য পাচ্ছে এখানে। রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু বা চিরস্থায়ী মিত্র বলে কিছু হয়না এই আপ্ত বাক্যটি নীতীশ কুমার জোট সঙ্গী বদল করে আবার প্রমাণ করলেন।বিহারে নীতীশ কুমার প্রসঙ্গে একটি কথা প্রচলিত আছে সেটা হল ‘আইসা কোই সাগা নাহি জিসকো নীতীশ ঠগা নাহি’ অর্থাৎ এমন কোন বন্ধু বা আত্মীয় নেই যাকে নীতীশ ঠকায় নি।লালু প্রসাদ যাদব নীতীশ কুমার প্রসঙ্গে এই কথা টির পুনরাবৃত্তি করলেন।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584