অমিতাভ চক্রবর্তী
দুর্গা পুজো বাঙালির সব চেয়ে বড় জাতীয় উৎসব, শারদীয়া। পুরাণে বলা আছে আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত দেবতাদের নিদ্রাকাল আর এই সময়ে দেবীর বোধন তাই এর নাম অকাল বোধন।
দুর্গার পূজা পদ্ধতি ভারতীয় সমাজে গৃহিত হয়েছিলো সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী তে বাল্মিকীর রামায়ণ রচনার পর থেকেই। পুরাণ অনুযায়ী রাম – রাবনের যুদ্ধের সময় রামের প্রতি দেবীর অনুগ্রহ আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে ব্রহ্মা দেবীর বোধন করেছিলেন। সেই পুজোকে অনুসরণ করেই ভারতে এই পুজোর রীতি পদ্ধতি চালু হয়েছে।
কিন্তু এই পুজোর রীতি আদোপেই বাল্মিকীর লেখা সংস্কৃত রামায়নে বর্ণিত পদ্ধতির অনুরূপ নয়। বরং চৈতণ্য পূর্ব যুগে কবি কৃত্তিবাস রচিত বাংলা রামায়ণে বর্ণিত এই দুর্গা পূজাকে অনুকরণ করে, যেখানে রাম নিজেই যুদ্ধের পূর্বে দেবীর বোধন করেন।
বাল্মীকির রামায়ণ রচনার পর ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্ম এবং তার বহুকাল পরে বৈষ্ণব ধর্মের উল্লেখযোগ্য অভ্যুত্থান ঘটেছিল। এরপর হিন্দুদের সঙ্গে বৌদ্ধ এবং বৈষ্ণবরা নিজেদের ধর্মীয় আদর্শের দিক থেকে রামায়ণ কাহিনীকে ভারতে এবং ভারতের বাইরের প্রচার করে বিভিন্ন জনমানসকে প্রভাবিত করেছিল।
অতএব প্রাচীন কাল থেকেই বাল্মীকির রামায়নের যে আদি রূপ তা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা পায়নি। আশুতোষ ভট্টাচার্য তার “বাল্মীকির রামায়ণ ও বাঙালীর রামায়ণে” এই মতকেই সমর্থন করেছেন –‘ বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রভাবিত রূপটিও নানা ভাবে বাল্মীকির রচনার মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করে তার যে একটি মিশ্র রূপ প্রকাশ করেছিল, সেটিই দেশ বিদেশে জনসাধারনের মধ্যে প্রচার লাভ করেছে।
যদি তা না হ’ত, তবে কেবল মাত্র প্রাক – বৌদ্ধ যুগের বাল্মীকির এই রচনার প্রতি পরবর্তী যুগের জনসাধারন কোন আগ্রহ কিংবা কৌতুহল প্রকাশ করতে পারতো না।‘
আরও পড়ুনঃ ঝাড়গ্রাম শহরে আলো ট্রাস্টের শারদ সম্মান
সঠিক দিন ক্ষণ না বলা গেলেও অনুমান করা যায় বাংলাদেশে রামায়ণের কাহিনী বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রচারের পরেই এসেছিল। এখনো পর্যন্ত বাংলার ইতিহাসে যে সব নির্ভর যোগ্য তথ্য পাওয়া যায় তা থেকেই জানা যায় খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের আমলে সংস্কৃত ভাষা বাংলা দেশে প্রথম প্রবেশ করলেও খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত পাল রাজত্বের পূর্বে এদেশে সংস্কৃত ভাষার চর্চা তেমন ব্যাপকতা পায় নি।
পাল রাজারা ধর্মে বৌদ্ধ হলেও যে কারনেই হোক বৌদ্ধ ধর্মীয় পালি ভাষার পরিবর্তে দেবভাষা সংস্কৃতকেই রাজসভা বা রাজকার্য পরিচালনায় সরকারী ভাষা হিসেবে গ্রহন করেছিলেন। তারা যে সব তাম্রলিপি এবং অনুশাসন প্রচার করেছিলেন তার কোনটাই পালিভাষায় লেখা নয়।
পাল রাজাদের রাজত্ব কালে বাংলাদেসের বহু স্থানে হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় এবং বহু ব্রাহ্মণকে নিষ্কর জমি দান করা হয় বাসস্থানের জন্য। প্রকৃতপক্ষে তখনই দেশে সংস্কৃত চর্চার সূচনা হয় আর তা প্রভাব বিস্তার করে অচিরেই।
অনুমেয় এই সময়েই রামায়ণ কাহিনী বাংলা দেশে প্রবেশ করে এবং জনসধারনের মধ্যে প্রচারিত হয়।
খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে কৃত্তিবাসের জন্মের আগেই রামায়ণের জাতীয়করণ শুরু হয়ে যায়। কৃত্তিবাস রামায়ণের খন্ড বিচ্ছিন্ন উপকরণগুলোকে এক সূত্রে সুসংবদ্ধ করেছেন মাত্র।
আরও পড়ুনঃ মাতৃরূপেণ সংস্থিতা
কৃত্তিবাসের মধ্যে একটা উদার সংস্কারমুক্ত মন ছিল, তা না হয়ে যদি তিনি রক্ষণশীল হতেন তবে তার রামায়ণ বাঙালীর রামায়ণ হয়ে উঠতো না। এমনিতেই যে উপকরণগুলো কৃত্তিবাসি রামায়ণে পাওয়া যায় তা ততদিনে বাঙালী জনমানসে ধীরে ধীরে সঞ্চিত হতে আরম্ভ করেছিল ফলে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় সেই সব উপকরণ কৃত্তিবাসের নিজস্ব উদ্ভাবন বা স্বাধীন চিন্তার ফসল নয়।
আর তা যদি না হত তিনি কখনোই রাময়ণ রচয়িতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন না। সামাজিক ঐতিহাসিকেরা বলেন জাতীয় উপাদান ব্যাক্তি বিশেষ উদ্ভাবন করে না, জাতীর মানস ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সঞ্চিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, এই কাব্যে “প্রাচীন বাঙালি সমাজই আপনাকে ব্যক্ত করিয়াছে।”
মহাঋষি বাল্মীকি তাঁর সংস্কৃত রামায়ণে অকাল বোধন সমর্থন করেননি। অথচ বেশিরভাগ পুরানেতিহাস, পুরাণ সাহিত্য, শ্রীমদ্ভাগবত, স্মৃতিশাস্ত্র, দেবীর এই অকাল বোধন সমর্থন করে।
বাল্মীকি তাঁর কাব্যে সূর্য ও অন্যান্য দেবতার পুজোর কথা বললেও কবি কৃত্তিবাস বাংলা রামায়ণে শরৎকালে রামচন্দ্রের দেবী পুজোকে বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন পুরাণকে অনুসরণ করে।
আর এ সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন স্মার্ত রঘুনন্দন ও তাঁর পূর্ব সূরীগন। কবি কৃত্তিবাস আনুমানিক ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন। এবং ঐ পনেরো শতকের মাঝামাঝি গৌড়েশ্বর রাজা গনেশের অনুরোধে এই রামায়ন রচনায় হাত দেন।
বাংলা রামায়ণে লঙ্কাকান্ডে কৃত্তিবাস শ্রীরামচন্দ্রের দেবী পুজো সম্বন্ধে বলেছেন –
বিধাতা কহেন প্রভু এক কর্ম কর বিভু
তবে হবে রাবণ সংহার।
অকাল্বোধন করি পূজ দেবী মহেশ্বরী
তরিবে হে ঐ দুঃখ পাথার।।
কৃত্তিবাসের মৃত্যু আনুমানিক ১৪৬১ খ্রীষ্টাব্দ আর বাংলায় চৈতন্যদেবের জন্ম ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দ, তৎসত্ত্বেও কৃত্তিবাসের সময়েই বৈষ্ণব ভাবনা বেশ কয়েকটি ক্ষূদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ ছিল।
স্বাভাবিক ভাবেই সারা বাংলা দেশ ব্যাপী প্রচারিত হয়ে তখনো বাঙালীর জাতীয় জীবনের অঙ্গীভূত হয়ে উঠতে পারেনি।
কিন্তু আজকে প্রচলিত কৃত্তিবাসী রামায়ণে বৈষ্ণব ধর্মের যে এত ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তার কারণ কৃত্তিবাস বাল্মীকির রামায়ণ অবলম্বন করে যে কাব্য রচনা করেছিলেন তাতে সম সাময়িক বাঙালির ধ্যান ধারণা প্রকাশ পেয়েছিল।
ফলে তাঁর কাব্যে রাম বিষ্ণুর অবতার হলেন আর লঙ্কাবাসীরা সবাই হ’ল কৃষ্ণ ভক্ত। এমনকি রাবনকেও মৃত্যুর পূর্বে অবতার রামের আশির্বাদ নিতে দেখা যায়।
তরণীসেন বধের মত ভক্তিমূলক কাহিনী তার মধ্যে যুক্ত হলো। অবশ্য একথা খুব সহজেই বলা যায় কৃত্তিবাসের মূল রামায়ণে এতো ব্যাপক বৈষ্ণব প্রভাব ছিলনা যা পরে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে।
আশুতোষ ভট্টাচার্য লোক সাহিত্যের ইতিহাসে বলেছেন –‘ কৃত্তিবাসের পরবর্তীকালে যে সকল রামায়ণ অনুবাদকারীর আবির্ভাব হয়েছিল, তাদের কেউই কৃত্তিবাসকে আদর্শ বলে গ্রহন করেননি। বরং যিনি যে যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি সেই যুগের চিন্তাধারাকে আদর্শ করেছিলেন।‘
কৃত্তিবাসী রামায়ণে অনুসৃত দুর্গার এই অকাল বোধন সম্পর্কে মতভেদ আছে এবং সেই মতভেদ শাস্ত্র ও যুক্তি সম্মত। বাল্মীকি রচিত রামায়ণে আছে রামচন্দ্র সূর্য বংশজাত পরম ক্ষোত্রিয় বলে দশাননকে পরাভূত করার জন্য সূর্যের পূজা করেছিলেন এবং বর লাভ করেছিলেন।
কিন্তু ফুলিয়ার কবি কৃত্তিবাস ওঝা সেই ঘটনাকেই ভিন্নভাবে উল্লেখ করে লিখলেন রাম দেবী মহামায়ার পুজো করেছিলেন অকালে আশ্বিন মাসে রাবনকে যুদ্ধে বধ করে জয় লাভ করার জন্য।
ঐতিহাসিকরা বলেছেন কৃত্তিবাসের এই বর্ণনা ঠিক নয়, তবুও আশ্চর্যজনক ভাবে ভারতীয় সমাজ ও বিশেষ করে বাংলাদেশের সামাজিক মানুষজন কবি কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণের কথা ও ঘটনাকে অনুসরণ করে অকালে আশ্বিন মাসেতে দূর্গা পুজোর অনুষ্ঠান করে চলেছে।
কৃত্তিবাসের কাব্য বর্ণনায় রামচন্দ্রের আরাধনায় দেবী প্রথমে আবির্ভূতা হননি। তিনি ১০৮টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করে মায়ের চরণে অঞ্জলি প্রদানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু দেবী ছলনা করে একটি পদ্ম সরিয়ে রাখলেন। একটি পদ্ম কম রয়েছে দেখে রামচন্দ্র ধ্নুর্বান দিয়ে নিজের নীল চোখ উৎপাটন করে মাতৃচরণে অঞ্জলি দিতে উদ্যত হলে দেবী আবির্ভূতা হয়ে তাকে নিবৃত্ত করেন।
এরপর দেবী পুজো সমাপ্ত হল। রাম দশাননকে বধ করলেন। আশ্চর্যের বিষয় বাংলা দেশের পুরাণকারেরাও কবি কৃত্তিবাসের বর্ণনাকে সমর্থন করে অকাল-বোধন ও অকালে দেবী পূজাকে শাস্ত্র সম্মত বলে বর্ণনা করেছেন এবং বাংলার সমাজ বঙ্গদেশীয় কবিকে সম্মান ও সমাদর দিয়ে তাঁর বর্ণিত ঘটনা ও নির্দেশ অনুযায়ী আজও অকালে আশ্বিন মাসে মহাশক্তির পূজা করে চলেছে।
পরবর্তীতে শাস্ত্রীয় নিয়ম মেনে বসন্ত কালে আদত দুর্গা পূজাকে বাসন্তী পূজা নামে সমাদর দিলেও কৃত্তিবাসের কথাকে গ্রহণ করে বাংলার মানুষ বাঙালি সমাজকে মহিমান্বিত করেছে বলা যায়।
তবে একথাও অনস্বীকার্য বাংলাদেশ একদিকে যেমন কবি কৃত্তিবাসের ব্যাখ্যাকে অক্ষুন্ন রেখেছে তেমনি ভারতীয় সমাজে গুপ্ত যুগে রচিত চন্ডীর মহিমা ও মাহাত্মকেও সমাদর দিয়েছে।
শ্রীশ্রী চন্ডীতে দেবী কাত্যায়ণী ও দেবী দুর্গা একযোগে পুজিতা ও সমাদৃতা। হিমালয় পর্বত নন্দিনী দেবী পার্বতিই দুর্গারূপে অষ্টাদশ হস্তে কৈলাসে মহিষাসুরকে শূলে বিদ্ধ করে নিধন করে দেবতা ও বিশ্ববাসী সকল মানুষকে রক্ষা করেছিলেন।
শরৎকালে এই দুর্গা পুজো রামচন্দ্রের অকাল বোধনকে অনুসরণ করে। তবে মতভেদ বলে সুরথ রাজা বসন্তকালে দেবীর আরাধনা করেছিলেন রামচন্দ্রেরও হাজার বছর পূর্বে। ইতিহাস বলে রামচন্দ্রের সময় থেকেই বৈশাখ মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হয়।
সুরথ রাজার সময় বছরের প্রথম মাস ছিল অঘ্রান মাস। এবং তখন সূর্য অবস্থিত ছিল কন্যারাশি ও তুলারাশির সংযোগ স্থলে চিত্র নক্ষত্রে। সুতরাং বাসন্তী পুজোর প্রচলনের বহু বহু বছর পরে এই শারদোৎসবের সূচনা।
বর্তমানে চৈত্র মাসে বসন্ত ঋতুতে বাসন্তী দুর্গা ও আশ্বিন-কার্তিক মাসে শরৎ ঋতুতে শারদীয়া দুর্গা এই উভয় পুজো হিন্দু সমাজে অনুষ্ঠিত হয়।
এই শারদীয়া পুজো শরৎকালে কেন হয় এবং প্রাচীন কাল থেকে কেন এই পুজো শরৎকালে হয়ে আসছে তার সম্বন্ধে অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ ‘দেবী-দুর্গা’ প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন,’ দুর্গা পূজাই পবিত্র উৎসব – শারদোৎসব। বৈদিক যুগ থেকে এই উৎসব চলে আসছে।
বৈদিক যুগে ঋষিরা ‘ইষ’ বলতে আশ্বিন মাসকেই বোঝাতো আর ‘উর্জ’ অর্থে কার্তিক মাসকে। কাজেই শরৎঋতুতে দুর্গার পুজো করার অর্থই দেবী অম্বিকার পূজা করা। এই জন্য শরৎকাল শারদীয়া দুর্গা পূজার প্রশস্ত কাল’।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584