রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসক নিয়োগে স্বচ্ছতা প্রশ্নের সম্মুখীন, লাগাতার আন্দোলনে চাকরীপ্রার্থীরা

0
705

নিজস্ব সংবাদদাতা,কলকাতাঃ

Questions arise recruitment process of wbcs exam
নিজস্ব চিত্র

অকাল বর্ষণে নাজেহাল যখন রাজ্যবাসী তখন সেই দুর্যোগকে উপেক্ষা করে খোদ কলকাতার বুকে সেই সময় শীর্ণজীর্ণ চেহারার একটি নিরীহ যুবক রাস্তায় বসে পড়েছে।পুলিশের লাঠির আঘাতে তার কপাল ফেটে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে।তাকে ঘিরে রয়েছে আরও হাজার খানেক পঁচিশ তিরিশ বছরের যুবক যুবতী।কেউ তোয়াক্কা করছে না ঝড় জলের।সকলের চোখে রাগ ক্ষোভ ঘৃণা।মুখে প্রতারণার ছাপ স্পষ্ট।জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে,পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সামনে।একগুঁয়ে ছেলেমেয়েগুলো অটল।কোনও পুলিশ কর্মী একবিন্দু টলাতে পারছেনা তাদের।
শুরু হল লাঠিচার্জ।লুটিয়ে পড়ল ছেলেটি। বাঙ্গুরে নিয়ে গেলে জানা যায় তার এক পা ভেঙ্গে দিয়েছে পুলিশ।সুদূর নদীয়াতে তার বাড়ি।পকেটে নামমাত্র টাকা।বাকি সহযোদ্ধাদের তৎপরতায় তাকে পাঠানো হয় বাড়ি।বর্তমানে সে অন্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।প্রশ্ন,কি এমন হল যে এরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে এতগুলো প্রাণোচ্ছল ছেলে মেয়ে কলকাতার রাস্তার উপর এসে একযোগে দাঁড়ালো? কিসের বিরুদ্ধে এই সাহসী পদক্ষেপ তাদের?যেখানে কলকাতার লোকজনই ঘর থেকে বেরোতে পারছেনা তুমুল বৃষ্টিতে,সেখানে এই ছাত্রছাত্রীরা কেউ সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে তো কেউ পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান থেকে এসে একজোট হয়েছে!পশ্চিমবঙ্গের একটা জেলাও বাদ যায়নি যোগ দেওয়া থেকে।

Questions arise recruitment process of wbcs exam
নিজস্ব চিত্র

বলা বাহুল্য,এক ভয়ানক দূর্নীতি এক ছাতার তলায় এনে দিল বাংলার অধিকাংশ “ইউথ ” কে।
পশ্চিমবঙ্গ লোক সেবা আয়োগ দপ্তর বা পাবলিক সার্ভিস কমিশন যাবতীয় সরকারি চাকরির পরীক্ষা আয়োজন করে থাকে।নিয়োগনীতিও তাদের হাতে।কিন্তু বছরের পর বছর সেই নিয়োগে কিছু না কিছু গাফিলতি ধরা পড়ছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে,বরাবর কোনও আই এ এস অফিসার ছিলেন চেয়ারম্যান পদে।পরবর্তীতে একজন প্রোমোটেড আই এ এস অফিসার চেয়ারম্যান হন কিন্তু ২০১৭ র জুলাইয়ের পর চিত্রে কিছু অদল বদল আসে। হঠাৎ করেই আই এ এস দের ত্যাগ করে চেয়ারম্যান করা হয় টিটাগড় ওয়াগন লিমিটেড এর অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার শ্রী দীপঙ্কর দাসগুপ্ত মহাশয়কে, যিনি ২০১২ তে প্রথম মেম্বার হিসাবে পিএসসিতে যোগদান করেন। তার যোগ্যতা নিয়ে অনেক গুঞ্জন উঠলেও সে সামান্য অনুযোগ ধোপে টেঁকেনি। এরপর আসতে আসতে পি এস সি তার পূর্বের সুঠাম কাঠামো হারায়।২০১৪ সাল থেকে ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নের ধারা পাল্টে আনা হয়েছিল এম সি কিউ প্যাটার্ন অর্থাৎ একটা প্রশ্ন,চারটে অপশন।পরীক্ষার্থী সঠিক উত্তর এ গোল করবেন প্রদত্ত ও এম আর সিটে।এরকম ব্যবস্থাপনায় দূর্নীতির পথ সহজতর হতে থাকে।২০১৭ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রশান্ত বর্মণ নামে এক পরীক্ষার্থীর সব পেপারেই নম্বর আকাশকুসুম বাড়তে থাকে। সরকারি কাজে কোনও ভুল হলে করিজেন্ডাম নোটিশ বার করে ভুল শোধরানো হয়।প্রত্যেক ক্ষেত্রে একটি ফাইলে বাকি নথির সঙ্গে করিজেন্ডামের কারণ দর্শানো নথি থাকে। তবে বর্মণের ক্ষেত্রে কোনও করিজেন্ডাম এর কারণ ইস্যু না হয়েই সোজা সাইটে নোটিশ দেওয়া হয় তার প্রিলির নম্বর পরিবর্তনের।তার বিরুদ্ধে কোর্টে কেস চলাকালীন তাকে গ্রুপ ‘এ’ এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে ফাইনাল লিস্টে প্রথম স্থানেও দেখা যায়।এরপর ২০১৭ গ্রুপ সি রেজাল্ট বেরোনোর পূর্বে আরও কিছু বড়সড় দূর্নীতি সামনে এসে যায় যেমন পাঁচজন পরীক্ষার্থীর মেন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যায়।একজন পরীক্ষার্থী ইন্টারভিউ দিতে না আসা সত্ত্বেও তার নাম ফাইনাল লিস্টে আসে।এই সকল অসঙ্গতি দূর করতে রেজাল্ট প্রকাশ আরও কিছুদিন পিছিয়ে দেওয়া হয় বটে,তবে রেজাল্ট বেরোনোর পরেও দেখা যায় চার পূর্ব পরিচিত বন্ধু যাদের রোল নম্বর ও পর পর,তারা চারজনই গ্রুপ সি তে চাকরি পেয়েছে কাকতালীয় ভাবে।
বাকি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে এই নিয়েও সন্দেহ তুঙ্গে ওঠে।

Questions arise recruitment process  of wbcs  exam
নিজস্ব চিত্র

ইতিমধ্যে একটি অফিসিয়াল মিটিং মিনিটস এর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায় যেখানে স্পষ্ট লেখা ছিল পাঁচজন ডাব্লিউবিসিএস পরীক্ষার্থীর মেন পরীক্ষার নম্বর কিভাবে অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গিয়েছে।ছাত্রদের অবস্থা অগ্নিগর্ভ হয়ে যায় তা দেখে। তাদের প্রশ্ন,কিভাবে এতগুলো ছেলেমেয়ের নম্বর অলৌকিক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে?আজ ব্যাপারটা প্রকাশ পেয়েছে, অনেক ছাত্রের আশঙ্কা, “হয়তো ২০১৪ থেকেই এই দু’নম্বরি চলছে! ” তাই ছাত্রদের দাবী ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সব পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়ন হোক।কাট অফ ডিক্লেয়ার করা হোক এবং অবশ্যই অফিসিয়াল উত্তরপত্র প্রকাশ করা হোক।এরকম পরিস্থিতিতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত এক কর্মচারীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।আমাদের কাছে আসা প্রমাণ অনুযায়ী, ট্যাবুলেশন সিট যা ২০১৭ তে প্রথমবারের জন্য ওয়েবেল সংস্থা বানালো, তা পরীক্ষার্থীদের নম্বর সহ দুজন ব্যক্তির কাছে ছিল কনফিডেন্সিয়ালি।তারা হলেন osd and ex officio joint secretary শিবপ্রসাদ মিশ্র এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হারাধন মুখার্জী।অন্যদিকে ক্লার্ক কৌশিক ভট্টাচার্যকে নিয়ম বহির্ভূত ভাবে শো কজ না করেই সোজা সাসপেন্ড করার পিছনেও কিছু বিশেষ ঘটনা লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা কিনা সে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।উক্ত ক্লার্ককে সাসপেন্ড করার পিছনে পিএসসির দাবী,তারা যেহেতু খতিয়ে দেখবে পুরো বিষয়টা, তাই কৌশিকবাবুর দায়িত্ব বর্তমানে মুলতুবি রাখা হোক কিন্তু তাঁকে সাসপেন্ডের দশদিন অতিবাহিত,তবু তার বিরুদ্ধে এখনও চার্জশিট পেশ হল না কেন?এর উত্তর এখনও কেউ দেয়নি।পিএসসির তরফ থেকে তবে ইতিমধ্যে সাতজনকে শো কজ করা হয়েছে। পরিবর্তে আনা হয়েছে কৌশিক ব্রম্ভ নামে অন্য আরেক ক্লার্ককে কিন্তু এই শোকজ আর সাসপেন্ডের বাতাবরণে আখেরে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গছে সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য নাওয়া খাওয়া ভুলে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েগুলোর। তার ফল স্বরূপ আমরা দেখতে পাই কিভাবে তারা সুবিচারের আশায় ২৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১ টা থেকে সন্ধ্যে ৬ টা পর্যন্ত ধর্নায় সামিল হয় একজোটে।তবে কোনও একজনের দিকে আঙুল তুলে বাকি কালপিটেরা আড়ালে চলে যাবে না তো?নাকি ‘ঠগ বাছতে গিয়ে গাঁ উজার হবে?’ জমায়েতে জল্পনাকল্পনা তুঙ্গে।ঠিক সেই মুহুর্তে আন্দোলনকারীদের সামনে এসে চেয়ারম্যান জানান “কোনও কোরাপশন হয়নি।তাই তোমাদের দাবি মানা হবে না “।চেয়ারম্যানের এরূপ মন্তব্যে ক্ষোভের পারদ মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।ঝড় বৃষ্টি মেঘের গর্জনকে তুচ্ছ করে হুংকার ওঠে “গলি গলি মে শোর হ্যায়, পি এস সি চোর হ্যায়! ”
তারা দাবি জানায়,কম্পিউটার বেসড পরীক্ষার। সেরকম হলে তারা ফর্মফিল আপের জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতেও রাজি।প্রবল আন্দোলনের মুখে পড়ে দাসগুপ্ত মহাশয় ৩০ দিনের সময় চান পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য।কিন্তু শুধুমাত্র মৌখিক আশ্বাস দিয়েই তিনি বাড়ির পথ ধরেন।পিছনে পড়ে থাকে সারাদিন খালি পেটে স্লোগান দেওয়া হাজার খানেক ছেলেমেয়ে।এই সামান্য মৌখিক প্রতিশ্রুতি কতটা মজবুত সেই নিয়ে সন্দেহ সকলের।তাই আগামী দিনে প্রয়োজন হলে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা তাদের।
ওদিকে ফায়ার অপারেটর থেকে ফুড সাপ্লাই, সব পরীক্ষাতেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ছাত্রছাত্রীদের কিন্তু পুনর্বার এসব পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ পিএসসি দেখায়নি।তাছাড়া জয়েন্ট সেক্রেটারি,ডেপুটি সেক্রেটারি, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি,সেকশন অফিসার,হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং বিশেষত ডাব্লিউবিসিএস গ্রুপ সি এর পার্সোনালিটি টেস্টের জন্য আলাদা ডিলিং অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং গ্রুপ সি রেজাল্টের জন্য আলাদা ডিলিং অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকা সত্ত্বেও কিভাবে এতজনের চোখ এড়িয়ে একজন গ্রুপ এ এবং বি এর ডিলিং অ্যাসিস্ট্যান্ট এই দূর্নীতি করে তা প্রশ্নের সম্মুখীন।ফেসবুকে স্বপ্নপূরণ গ্রুপে কৌশিক ভট্টাচার্য বিশেষ সহায়তা করতেন ছেলেমেয়েদের বলে জানা গেছে।উনি রেজাল্ট এর ডেট বা পরীক্ষার ডেট সবই আগে থেকে গ্রুপে জানিয়ে দিতেন অ্যাডমিন হিসাবে।যা অফিসিয়াল ফর্ম্যাটের বিরোধী।তবে তার জন্য তিনি গ্রুপ থেকে কোনও তোষণ নিতেন কিনা তা আপাতত প্রমাণিত হয়নি তবে তা খতিয়ে দেখা হবে এবং ২০১৭ পরীক্ষায় তিনি তাঁর বোনের নম্বর বাড়িয়ে তাকে মেধাতালিকায় জায়গা করে দেন বলে পিএসসির সন্দেহ।এমনকি তার বোন পরীক্ষা দিচ্ছে সেটাও তিনি গোপন করেন।

তাহলে এত বড় বড় পদের অফিসার,দপ্তরে থেকে লাভ কি যদি বজ্র আঁটুনি ফসকা গেড়ো হয়?তবে কি সর্ষের মধ্যে আরও ভূত বেরোনোর অপেক্ষায় আছে? হঠাৎ বাকি অফিসার ও ক্লার্কদের শো কজ করা হল কেন?কি লুকাচ্ছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন?এস পি মুখার্জী রোডের যে নীল সাদা বিল্ডিং আজ নব্য প্রজন্মের কাছে আশার আলো ছিল, সেখানেই কাল হাহাকার শোনা গেল।আগামী দিনের সিভিল সার্ভেন্ট, যারা কিনা
পশ্চিমবঙ্গকে সর্বতোভাবে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠা করবে, আজ তারাই ব্যারিকেড ঘেরা ফুটপাতে বসে সঠিক বিচারের আশায় দিন গুনছে!

আরও পড়ুনঃ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নামছে পুরুষ কমিশন

মেধাবী বেকারের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে রাজ্যে। পাশাপাশি বেড়ে চলেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ! এ কোন দিন আসতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে!খালি পেটে কতদিনই বা বিপ্লব সম্ভব?তাই এখন এই আন্দোলনে,অন্যান্য ছত্রের মানুষেরাও প্রতারিত প্রবঞ্চিত বেকার ছেলেমেয়েদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন আগামী দিনে।সবাই চাইছে, যত সত্ত্বর সম্ভব কিছু একটা সদুত্তর দিক পিএসসি।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here