প্রত্যয় চৌধুরী, ওয়েব ডেস্কঃ
অসামান্য হাস্যরস বোধ, সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কে সূক্ষ বিচার যাঁর, মিছরির ছুরির মতো প্রশ্ন ছুঁড়ে জনতাকে ভাবনার মুখে ফেলে দিতে পারেন যিনি, তিনি রবিশ কুমার। লেখক, সাংবাদিক এবং মিডিয়া পার্সোনালিটির বাইরেও তাঁর আরেকটা পরিচয় অনেকেই জানেন না।
তিনি একজন সৎ, নির্ভীক মানুষ, যেরকম মানুষের উপস্থিতি আজকের পৃথিবীতে খুবই বিরল। একজন স্বাধীন, দায়িত্ববান নাগরিক হিসাবে রবিশ কিছু প্রশ্ন সবসময় রাষ্ট্রের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন।
একই সাথে জনতাকে বুঝিয়েছেন- আমি যদি এই প্রশ্নগুলো করতে পারি, তাহলে আপনারাও পারবেন। এভাবেই পাশে থাকেন তিনি। তিনি অসাধারণ, কিন্তু নিজেকে উপস্থাপনা করেন অতীব সাধারণ হিসেবে, যাতে জনগণের সাথে একই সারিতে দাঁড়াতে পারেন তিনি।
১৯ অক্টোবর ‘প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট’ আয়োজিত ‘ষষ্ঠ ঋতুপর্ন ঘোষ মেমোরিয়াল লেকচার’-এ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ম্যাগসেসে পুরস্কার জয়ী রবিশ কুমারকে। প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন।
তাঁর মৃত্যুর পর উক্ত সংস্থা প্রতি বছর ঋতুপর্ণর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি করে মেমোরিয়াল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। নাটক মঞ্চস্থ থেকে ফিল্ম স্ক্রিনিং ও হয়ে থাকে সেখানে। ২০১৬ সালে সাংবাদিক পালাগুম্মি সাইনাথ কে এনেছিল প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট। এবার এসেছিলেন রবিশ কুমার।
শনিবার রাতে বসুশ্রী হল-এ ভিড় হয়েছিল ভালই। শুধু শহরের না, ব্যাঙ্গালোর, মুম্বই থেকেও এসেছিলেন অনেকে। মাইক হাতে নিয়েই রবিশ মজা করে বললেন, “মঞ্চের ওপাশে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বক্তব্য রাখলে মনে হয় ওপাশে কেউ নেই আর ভরসা কমে যায়।”
অনুষ্ঠানের আয়োজক কমিটি ও উপস্থিত দর্শকদের ধন্যবাদ দিয়ে রবিশ বললেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি বৈচিত্র্যতাতে বিশ্বাস করতেন।
বাঙলায় আছে সেই বৈচিত্র্য। এই কারণেই বাংলার প্রতি সবার এত টান আর এখানকার মানুষদের থেকে সবার এত আশা। যেখানে বৈচিত্র্য আছে, সেখানে আছে সৃজনশীলতা। আর এই সৃজনশীলতার মধ্যে দিয়েই পরস্পরের প্রতি ভরসা আর বিশ্বাস গড়ে ওঠে। বৈচিত্র্যের বুনিয়াদ বজায় থাকে।
বর্তমানে রাষ্ট্র এনআরসি’র নামে যে হোমোজিনাস প্রোপাগান্ডা বা সমশ্রেণীভুক্তকরণে উঠে পড়ে লেগেছে তা আসলে এই বৈচিত্র্যের সংস্কৃতি ও সৃষ্টির ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেওয়ার জন্য।
আর যখন সৃজনশীলতার ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে, তখন একে অপরের থেকে ভরসা উঠতেও আরম্ভ করবে। এই সহজ বিষয়টা সহজ ভাবে উপলব্ধি করাতে হাততালিতে ফেটে পড়ল প্রেক্ষাগৃহ।
তবে দর্শকেরা আরও মজা পাচ্ছিলেন রবিশের মিষ্টি মিষ্টি কটাক্ষগুলোয়। যা একপ্রকার অপ্রিয় সত্য চোখের সামনে তুলে ধরে কিন্তু তীব্রভাবে অপমান করে না কাউকেই।
“আমি ভাবলাম আমার এখানে আসার আগে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে বালাকোটের মতো সার্জিকাল স্ট্রাইকের অবস্থা হবে…… এখনও হয়নি সেটা একটা পজিটিভ ব্যাপার… প্রেসিডেন্সীর ইমারত এখনও টিকে আছে এটাও একটা পজিটিভ ব্যাপার।”
বক্তব্য রাখতে গিয়ে মাঝে মাইক্রফোনে সাউন্ডের সমস্যা হওয়ায় রবিশ বললেন, “আরেকটা মাইক দিন, একটায় শোনা না গেলে আরেকটা চলতে থাকবে, ঠিক যেমন অর্থনীতি ফেল হয়ে গেলেও রাজনীতি বহাল তবিয়তে বজায় থাকে।”
নানান তথ্য, ইমেজারি, ঘটনা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট টেনে বক্তব্য রেখে মজা করে, সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সমাজের টানাপোড়েনের কথা। বাংলার আকালের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট টেনে সতর্ক করলেন আসন্ন এনআরসি সংক্রান্ত ভয়াবহতার কথা।
বললেন, শুধু রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে, রবীন্দ্র নাট্য পরিবেশন করে সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। পথে নামতে হবে। রবীন্দ্রনাথ নেহরুকে বলেছিলেন মুসলমানদের বাদ দিয়ে কিন্তু আমার দেশের পরিচয় কখনওই সম্পূর্ণ হতে পারে না।
আর আজ সেখানে ১৫ কোটি মুসলিম ভাই বোনের অবস্থা অন্ধকারে। রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্ব যদি এই প্রশ্ন তুলতে পারেন, তাহলে আমরা কেন নয়? আমাদের সংস্কৃতি কি শুধুই দুর্গাপূজার প্যান্ডেলে রবীন্দ্র সংগীত বাজিয়ে বেঁচে থাকবে? আলোর রোশনাই এ থাকে হাজার রকম রঙ, অর্থাৎ বৈচিত্র্য।
অন্ধকারের কিন্তু একটাই রঙ। আর সেই রঙ বেছে নেওয়া যাবে না। বারবার আমাদের শিকড় থেকে উপড়ে ফেলে একরূপতার মধ্যে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তা হয়ে গেলে ভয়ঙ্কর বিবেকের আকাল নামবে। ‘হিউজ মাস আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’-এর শিকার হবে জনগন। শেষ হবে জাতির গৌরব, পরিচিতি, অস্তিত্ব।
পরিশেষে তিনি বলেন, আমাদের চিন্তা করতে হবে যাদবপুর, প্রেসিডেন্সীর মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মান যাতে বজায় থাকে।
একই ভাবে বাঁকুড়া, মোতিহারপুর, মজফফরপুর, সুরাট এর মতো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজন, যেখানে শিক্ষার্থীরা সঠিক বই না পেয়ে গাইড বুক থেকে পড়াশুনা করে বেড়ে উঠছে। আর এই গাইড বুকের ভাষা ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির’ ভাষা থেকে আলাদা কিছু না।
বক্তব্য শেষে হল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে সাধারণ জনগনের সাথে গল্প করলেন রবিশ কুমার। অনুরাগীদের সঙ্গে শেয়ার করলেন মতাদর্শ, তুললেন নিজস্বীও।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584