অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, স্পোর্টস ডেস্কঃ
জয়ের রাস্তায় আসার পরই কঠিন পরীক্ষার মুখে এসসি ইস্টবেঙ্গল। রবিবার লীগ টেবলের সবচেয়ে নীচে থাকা ওডিশা এফসি-কে ৩-১ গোলে হারানোর পর বুধবার মাত্র তিন দিনের মধ্যে লাল-হলুদ বাহিনীকে নেমে পড়তে হচ্ছে লিগের তিন নম্বর দল ও গতবারের লীগ সেরা এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে।
গত ম্যাচে তিন গোল ও জয়ের আত্মবিশ্বাস নিয়ে এই ম্যাচে এসসি ইস্টবেঙ্গল নামবে ঠিকই, কিন্তু এফসি গোয়ার মতো দলের বিরুদ্ধে শুধু এতেই হবে কি? প্রয়োজন দক্ষতাও। দক্ষতার সেই চরম জায়গায় রবি ফাউলার তাঁর দলকে নিয়ে যেতে পেরেছেন কি না, তার পরীক্ষা তিলক ময়দানে এই ম্যাচেই।
কলকাতা ও গোয়ার ফুটবল শত্রুতা বরাবরের। জনপ্রিয়তায় দেশের ফুটবলের সেরা পীঠস্থান যদি হয় গঙ্গাপাড়ের শহর, তা হলে অবশ্যই দ্বিতীয় সেরা আরব সাগরপাড়ের রাজ্য। দেশের সেরা আন্তঃরাজ্য প্রতিযোগিতা সন্তোষ ট্রফিতে সাফল্যের নিরিখে যদিও বাংলা (৩১ বার চ্যাম্পিয়ন) গোয়ার (৫ বার) চেয়ে অনেক এগিয়ে। কিন্তু ফুটবলের জনপ্রিয়তায় একে অপরকে টেক্কা দিতে পারে দুই রাজ্য।
এই ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার কারণেই এবার আইএসএল পুরোপুরি ভাবে গোয়ায় করারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে কলকাতাকেও বঞ্চিত করা হয়নি একেবারে। এই শহরের দুই সেরা ও ঐতিহ্যবাহী ক্লাবকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে দেশের এক নম্বর ফুটবল লীগে। বুধবার সেই চিরপ্রতিদ্বন্দিতারই আর এক দফা দেখা যাবে তিলক ময়দানে।
আরও পড়ুনঃ ব্রিসবেনে খেলবে কি না ভারত তা কয়েক দিনের মধ্যেই জানাবে বিসিসিআই
চলতি হিরো আইএসএলে এই দ্বৈরথ এক দফা দেখা গিয়েছে গত মাসে, যখন এটিকে মোহনবাগানের মুখোমুখি হয়েছিল এফসি গোয়া। ফতোরদা স্টেডিয়ামে সেই ম্যাচে ১-০ গোলে জেতে আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের দল। তাও ৮৫ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে জেতান রয় কৃষ্ণা। ওপেন প্লে থেকে গোল পাননি তাঁরা। সারা ম্যাচে কৌশলী ফুটবল খেলে ও বেশিরভাগ সময়েই রক্ষণ-নির্ভর খেলা খেলে শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জেতে কলকাতার দলটি। এসসি ইস্টবেঙ্গলকেও প্রতিবেশী ক্লাবকে অনুসরণ করে তেমন কিছুই করতে হবে এই ম্যাচে।
এ বারের লীগে এফসি গোয়াকে হারিয়েছে যারা, তাদের সেই সব ম্যাচের পারফরম্যান্স দেখেছেন লাল-হলুদ কোচ রবি ফাউলার। মঙ্গলবার ভার্চুয়াল সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বললেন, “একাধিক দল এ বার এফসি গোয়াকে হারিয়েছে। সেই ম্যাচগুলো আমরা দেখেছি। ওদের (গোয়া) কিছু দুর্বলতাও আমাদের চোখে পড়েছে। তবে ওদের ইতিবাচক দিকই বেশি। আসলে আমরা কেমন খেলব, তার ওপরই নির্ভর করছে সব কিছু। আমরা বল নিয়ে কী করব, বল কতটা দখলে রাখতে পারব, কী কী ভুল করব, সেগুলোই দেখার। ওদের হারানো কোনো বড় ব্যাপার নয়।”
আরও পড়ুনঃ ২০০৫ অ্যাসেজ সিরিজের সঙ্গে এই সিরিজকে তুলনা অজি কোচের
আক্রমণে ক্রমশ উন্নতি করলেও এসসি ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণে তেমন কোনও উন্নতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। ডিফেন্সের দুর্বলতার জন্য এ পর্যন্ত ১৪টি গোল খেয়েছে তারা। গোল হজম করায় ওডিশা এফসি-র সঙ্গে এক নম্বরে রয়েছে রবি ফাউলারের দল। আর এক ডজন গোল করে সবচেয়ে বেশি গোলের মালিকদের তালিকায় মুম্বই সিটি এফসি-র পরেই এফসি গোয়ার স্থান।
তাদের এক নম্বর স্ট্রাইকার ইগর অ্যাঙ্গুলো ৯টি গোল দিয়ে গোল্ডেন বুটের দৌড়ে এখন সবার ওপরে। প্রায় প্রতি ম্যাচেই গোল করে চলেছেন তিনি। প্রচণ্ড ক্ষিপ্র এই স্প্যানিশ স্ট্রাইকারের গোল কনভার্সন রেট ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ এ পর্যন্ত তিনি গোলে শট নিয়েছেন ৩২বার। তার মধ্যে সফল হয়েছেন ন’বার। তাঁকে আটকাতে গেলে যে রকমের আঁটোসাটো রক্ষণ প্রয়োজন, এ পর্যন্ত তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি লাল-হলুদ বাহিনী। এই জায়গাটাতেই সবচেয়ে বেশি চিন্তায় রাখবে ব্রিটিশ কোচ ফাউলারকে।
এফসি গোয়ার একাধিক বিপক্ষ চেষ্টা করেছে অ্যাঙ্গুলোকে কড়া মার্কিংয়ে রেখে তাঁকে আটকে দিতে। কিন্তু মুম্বই সিটি এফসি, চেন্নাইন এফসি ও এটিকে মোহনবাগান ছাড়া আর কোনও দলই তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। ড্যানিয়েল ফক্স, স্কট নেভিলদের কাছে এটা একটা বড় পরীক্ষা। গত ম্যাচেও লাল-হলুদ রক্ষণের দৈন্যদশা চোখে পড়েছে। বুধবারও যদি তাঁরা কোনও উন্নতি করতে না পারেন, তা হলে তার মাশুল দিতে হতে পারে।
নিজেদের এই দুর্বলতা নিয়ে ফাউলার বলেন, “গোল খাওয়া মোটেই ভাল নয়। তবে প্রথম তিন-চারটে ম্যাচে আমাদের ফরোয়ার্ডরা সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। তখন কেউ ডিফেন্সের দুর্বলতার কথা ভাবেনি। এখন হঠাৎ ডিফেন্সের সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। গত ম্যাচে দেওয়ালে প্রায় পিঠ ঠেকে যাওয়া একটা দলের কাছে আমরা ৯৪ মিনিটের মাথায় গোল খেলাম। এতে ওদের কৃতিত্ব দিতেই হবে।
আমাদেরও তো দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু আমরা লড়াই করছি। মানসিক চাপে থাকার কারণে ছেলেরা ভুল করছে। কিন্তু এই ম্যাচে সেটা হওয়ার কথা নয়, কারণ আমরা একটা ভাল জয়ের পর আরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাঠে নামছি। বিপক্ষ গোল দিতেই পারে। কিন্তু ম্যাচের শেষে ফলটা কী হচ্ছে, সেটাই আমার কাছে আসল। গোল খেয়েও যদি জিতি, তা হলে তাতে আমার আপত্তি নেই।”
এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা ভারতের প্রথম ক্লাব এফসি গতবারের দল থেকে ফেরান কোরোমিনাস, হুগো বুমুস, আহমেদ জাহু, মান্দার রাও দেশাই, মোর্তাদা ফল, জ্যাকিচন্দ সিংয়ের মতো নির্ভরযোগ্য ফুটবলারদের ধরে রাখতে না পারলেও তাঁদের বিকল্প হিসেবে বেশ কয়েকজন ভাল বিদেশি ও দেশীয় ফুটবলারদের নিয়ে একটা ভাল মিশ্রণ তৈরি করেছে। আঙ্গুলো ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্ডার জেমস দোনাচি, স্প্যানিশ মিডফিল্ডার এডু বেদিয়া, জর্জ মেন্দোজা ও আলবার্তো নগুয়েরা, স্প্যানিশ ডিফেন্ডার ইভান গঞ্জালেসরা ভাল মানের ফুটবলার বলেই পরিচিত।
গোল পাওয়ার ক্ষেত্রে অ্যাঙ্গুলোর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা অবশ্য গোয়ার দলের একটা বড় দুর্বলতা। অ্যাঙ্গুলোকে বিপক্ষ আটকে দিলে তাদের গোল করার লোকের অভাব হচ্ছে। স্প্যানিশ মিডফিল্ডার জর্জ মেন্দোজা দু’টি ও জম্মু-কাশ্মীর থেকে উঠে আসা ফরোয়ার্ড ইশান পন্ডিতা একটি গোল পেলেও, তাদের গোলের মধ্যে না থাকা ভোগাতে পারে এফসি গোয়াকে। তা ছাড়া তাদের রক্ষণও তেমন শক্তিশালী নয়। যার ফলে এর মধ্যেই দশটি গোল হজম করে নিয়েছে তারা। ন’টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে ক্লিন শিট রাখতে পেরেছে এফসি গোয়া। এটাই তাদের স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দোর চিন্তার বিষয়।
একসময়ে আর্সেনালে আর্সেন ওয়েঙ্গারের কোচিং টিমে ফিটনেস কোচ হিসেবে কাজ করে আসা ৩৯ বছর বয়সি কোচ এ দিন সাংবাদিকদের বলেন, “গত দু’টি ম্যাচেই আমরা শেষ মিনিটে গোল করে জিতেছি। তিন পয়েন্ট পাওয়াটা ভাল। কিন্তু ৯০ মিনিটে ইতিবাচক ফল হওয়াটা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, শেষ কয়েক মিনিটে নয়।”
প্রতিপক্ষকে যথেষ্ট সমীহ করে ফেরান্দো বলেন, “ওদের নতুন তিন খেলোয়াড় আসার পরে দলটা অনেক শক্তিশালী হয়েছে। আগে ওদের আত্মবিশ্বাসের স্তর যে জায়গায় ছিল, এখন তার চেয়ে অনেক ওপরে রয়েছে। ৩-১ জয় সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছে। এখন ওরা আগের চেয়ে অনেক চাপমুক্ত হয়ে খেলতে পারবে। এটা আমাদের সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে। ওরা প্রতি ম্যাচে উন্নতি করছে। তাই ওদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে ম্যাচের রাশ নিজেদের হাতে না নিলে মুশকিল হবে।”
দশ গোল খেলেও গোল দেওয়ার ব্যাপারে এখন এসসি ইস্টবেঙ্গল এগিয়ে। জাক মাঘোমা, অ্যান্থনি পিলকিংটন, ম্যাটি স্টাইনমানরা এত দিন বিপক্ষের রক্ষণকে ব্যস্ত রাখছিলেন। গত চার ম্যাচে আটটি গোল করেছেন তাঁরা। তার ওপর গত ম্যাচে ফাউলার নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার ব্রাইট ইনোবাখারেকে সাফল্যের মধ্যে পেয়ে যাওয়ায় আক্রমণের ব্যাপারে কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হতে পারেন।
লীগ তালিকায় সবার নীচে থাকা দলকে হারানো আর তিন নম্বর দলকে হারানোটা একই রকম হবে না বলে মনে করলেও ফাউলার মনে করেন, “ওডিশা ম্যাচটা মোটেই সহজ ছিল না। কখনও কখনও নীচের দিকের টিমগুলোকে হারানো বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। তবে গোয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটা একেবারে অন্য রকম। খুবই কঠিন। তবে এই ম্যাচে গত ম্যাচ থেকে পাওয়া বাড়তি আত্মবিশ্বাস নিয়ে নামছি আমরা। এর আগেও আমরা বিভিন্ন সময়ে ভাল ফুটবল খেলেছি। পুরোটাই নির্ভর করছে দলের খেলোয়াড়রা কেমন খেলবে, তার ওপর। আমরা (কোচেরা) সব রকম ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেব। সব ম্যাচই জেতার কথা ভেবেই নামি আমরা। এই ম্যাচেও তার ব্যতিক্রম হবে না। এখনও সেরা চারে থাকার কথা ভেবেই খেলছি আমরা। অঙ্কের হিসেবে সেই সম্ভাবনা ফুরিয়ে যায়নি। এ বার ছেলেরা কেমন খেলবে দেখা যাক।”
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584