সাভারকর লিখিত বইয়ে ‘ধর্ষণ’ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে উল্লিখিত

0
111

নিউজফ্রন্ট, ওয়েবডেস্কঃ

২০০২ সালে গুজরাট এবং ২০১৩ সালে মুজফফরনগর দাঙ্গার সময় নারীর উপর যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের প্র্যাকটিশের অনেক যুগ আগেই হিন্দু প্রবক্তা বীর সাভারকর ধর্ষণকে একটি বৈধ রাজনৈতিক টুল হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন।

Vinayak Damodar Savarkar explain rape | newsfront.co
সংবাদ চিত্র

১৯৬৬ সালে তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর আগে মারাঠি ভাষায় লেখা তাঁর বই ‘সিক্স গ্লোরিয়াস ইপোকস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’তে তিনি হিন্দু সমাজে ধর্ষণের ‘পুণ্য’ নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন।

সাভারকরের বইতে প্রাচীনকাল থেকে ভারত আক্রমণে হিন্দু প্রতিরোধের ঘটনাগুলি ছয়টি গৌরবময় যুগ জুড়ে বিশদে বিবৃত করা রয়েছে।

যদিও এই ঐতিহাসিক রেকর্ডের বেশিরভাগ তথ্যই সন্দেহজনক, বিদেশি ভ্রমণকারীদের অতিরঞ্জিত বিবরণ এবং ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদদের লেখার উপর ভিত্তি করে। সাভারকারের নিজস্ব সুদূরপ্রসারী কল্পনা ও অন্যান্য তথ্যের সমন্বয়ে লেখা সম্মিলিত নিবন্ধটি হিন্দুত্ববাদের প্রতি তাঁর যাবতীয় ক্রোধ ও বিদ্বেষকে ফুটিয়ে তুলেছে।

আরও পড়ুনঃ অবৈধভাবে মাটি চুরির অভিযোগ, প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন

তাঁর মতে “ভারচুস অ্যান্ড ভাইসেস” এই ফ্রেসটি সম্পূর্ণ ভাবেই আপেক্ষিক। ‘পাপ’ এবং ‘পুণ্য’ এই শব্দ দুটি ব্যাখ্যা করার আগে জানা উচিত তা আমাদের সামাজিক পরিমণ্ডলকে(বিশেষত হিন্দু সমাজে) এই শব্দ দুটি কতটা, কিভাবে স্বার্থের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

মূল বিষয়, পরিস্থিতি বদলানোর সাথে সাথে সমাজেও সামগ্রিক একটা বদল আসতে থাকে। সেই অর্থে বলা যেতেই পারে, অতীতে যা পুণ্য ছিল, বর্তমান সমাজে তা পাপ (পড়ুন কদর্য) হিসাবে পরিগণিত হতেই পারে।

উদাহরণস্বরূপ, সাভারকর বলেছিলেন, হিন্দু সমাজের জাতিবাদ, পবিত্রতা ও দূষণ সংক্রান্ত বিস্তারিত নিয়মাবলী সমাজকে আরও স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছিল। তবে এগুলির মধ্যে কিছু বিধি অকার্যকর হয়ে পড়েছিল যা হিন্দু সমাজকে শেকলে আবদ্ধ করে রেখেছিল।

আরও পড়ুনঃ জল অপচয় রোধে ম্যারাথন

সাভারকারের মতে এই শেকলগুলি ছিল অস্পৃশ্যতা, আন্তঃজাতির মানুষদের সাথে বসে খাবার খাওয়া, বিবাহ করা, সমুদ্র ভ্রমণে যাওয়া ইত্যাদি। পাশাপাশি যাদেরকে জোর করে খ্রিস্টান বা ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল তাদের অবলীলাক্রমে হিন্দু ধর্মে স্থান দেওয়া-এও ওই আবদ্ধ শেকলগুলির মধ্যে একটি, সাভারকরের মতে।

সাভারকর একটি জায়াগায় লিখেছিলেন, এই শেকলগুলি মুসলিমদের কাছে সুবিধাজনক প্রমাণিত হয়েছিল, কারণ তাদের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বর্ণবাদ প্রযোজ্য ছিল না। মুসলিম বিজয়ীরা পরাজিত হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তরিত করেছিল।

তাদেরকে খাবার ও জল দিয়ে সাহায্য করত। পাশাপাশি মহিলাদের রক্ষিতা বা স্ত্রী হিসাবে স্বীকার করেছিল। তারা নিশ্চিত ছিল যে একবার মুসলিম ধর্মাবলম্বী হয়ে যাওয়ার পরে তারা আবার হিন্দু ধর্মে ফিরে যেতে পারবে না। এই বিষয়টিকে সাভারকর “মানুষের শয়তানে বদল এবং ভগবানের ‘সেটান’ এ রূপান্তরণ” হিসাবে দেখেছেন।

ধর্ষণের ধারণাকে, সাভারকর, একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ধর্ষণকে তিনি একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইচ্ছা হিসেবেও ব্যক্ত করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি একটি প্রশ্ন রাখেন– হিন্দু রাজারা যখন মুসলিম সাম্রাজ্যগুলিকে পরাজিত করার সময় কি সেই অঞ্চলের মহিলাদের ধর্ষণ করতেন? তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, প্রত্যেক মুসলমানের ধর্মীয় দায়িত্ব ছিল অমুসলিম মহিলাদের অপহরণ করা এবং ধর্মান্তরিত করতে বাধ্য করা।

আরও পড়ুনঃ বাঁকুড়ায় বামেদের লং-মার্চ

তিনি আরও যোগ করেন, এই ধর্মান্ধতা শুধু মুসলিম উন্মাদনা থেকে উদ্ভুত নয়; এর আলাদা উদ্দেশ্য ছিল। প্রকৃতির অনিবার্য আইন অনুসারেই মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলত। প্রাণীজগতের টিকে থাকার সহজাত লড়াই থেকেই এই উদ্মদনার সৃষ্টি।

সাভারকর তাঁর বইতে অন্য একটি অনুচ্ছেদে লিখেছেন, একটি গবাদি পশুর দলে যদি গরুর থেকে ষাঁড়ের সংখ্যা বেড়ে যায়, তাহলে সেই দলের পশুর সংখ্যার ক্রবর্ধমান উন্নতি থেমে যাবে। কিন্তু অপরদিকে যদি গরুর সংখ্যা বেড়ে যায়, ক্ষেত্রে দলের মোট পশুর সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটতে থাকবে।

মানব সমাজের ক্ষেত্রেও তিনি এর উদাহণস্বরূপ বলেছেন, আফ্রিকার একটি আদিম উপজাতি, তাদের শত্রুপক্ষের পুরুষদের হত্যা করে কিন্তু মহিলাদের প্রাণে না মেরে বিক্রি করে দেয় নিজেদের উপজাতির মধ্যেই।

কারণ তারা মনে করে, এই মহিলাদের বংশবৃদ্ধির, জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা তাদের কর্তব্য। আবার ভারতের একটি নাগা উপজাতি তাদের শত্রুপক্ষের মহিলাদেরই হত্যা করে। কারণ তাদের বিশ্বাস, মহিলাদের হত্যা করলে তাদের শত্রুপক্ষের সংখ্যা হ্রাস পেতে পারে।

আরও পড়ুনঃ খড়িবাড়িতে জেলা স্তরের ৩৭তম বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা

সুতরাং এই কথার সূত্র ধরে এটা বলা যেতেই পারে নারী সভ্যতার ধারক ও বাহক, প্রয়োজন অনুসারে পুরুষতন্ত্র সেই ‘আইডিয়া’কে নিজেদের কর্ষণের কাজে লাগিয়েছে, আবার ধ্বংস করে ফেলেছে নিজেকে রক্ষা করতে। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রেই নারীর ইচ্ছা, স্বাধীনতা কখনওই প্রাধান্য পায়নি।

সাভারকর বলেন, আফ্রিকার মুসলিম বিজয়ীরাও পরে এই নীতি অনুসরণ করেছিল। তিনি রামায়ণের প্রসঙ্গে বলেন, রাবণের শুভাকাঙ্খীরা তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিল, সীতাকে তাঁর স্বামী রামের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।

তাদের মতে রাবণের এই কাজটি যথেষ্ট অধার্মিকতার পরিচয়। একথা রাবণকে জানানোর পর রাবণ তার প্রতিবাদ করে বলেন, শত্রুপক্ষের রমণীকে অপহরণ এবং ধর্ষণ করা মোটেই অধার্মিক পদক্ষেপ নয়; বরং এটিই মহৎ কাজ— পরমধর্ম।

তবে সভারকার এক জায়গায় লিখেছেন, রাবণের এই ‘নির্লজ্জ ধর্মীয় ধর্মান্ধতা’কে অনুসরণ করেই সুলতান থেকে সৈন্য পর্যন্ত মুসলমানরা হিন্দু মহিলাদের, এমনকি হিন্দু রাজপরিবারের বিবাহিত মহিলাদেরও ধর্ষণ করত মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়িয়ে ভারত জয় করার উদ্দেশ্যে।

আরও পড়ুনঃ পুলিশি অভিযানে ফাঁস বেআইনি মদের কারবার, আটক ৬

সাভারকর দাবি করেন, মুসলিম সমাজের উচ্চ বা নিম্ন কোনও স্তরের মহিলারাই কোনওদিন তাদের পুরুষদের অত্যাচারের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়নি। বরং পুরুষদের এহেন আচরণ তাদের গর্বের বিষয় ছিল।

এমনকি মুসলিম রমণীরা হিন্দু নারীদের প্রলুব্ধ করত গৃহবন্দী রাখা এবং মসজিদে তাদের পৌঁছে দেওয়ার জন্য। সাভারকরের মতে, মুসলিম নারীরা এই নৃশংসতায় প্রশ্রয় দিতে পারত কারণ তাদের মধ্যে হিন্দু পুরুষদের প্রতিহিংসামূলক বিকৃত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সম্পর্কিত কোনও ভয় ছিল না। কারণ মুসলিম প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করার পর হিন্দুরা শুধু তাদের পুরুষদেরই শাস্তি দিত, নারীদের নয়।

হিন্দুত্ববাদের প্রকট ইমেজারিকে এস্টাব্লিসড করতে সাভারকর রাবণকে ‘অসুর’ এবং রামকে ‘মহান’ দেখিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি বলে যে, হিন্দুত্ববাদীদের রামায়ণের মাহাত্ম্যকে ‘গ্লোরিফাই’ করা শুধুই ক্ষমতা এবং ধর্মীয় মৌলবাদকে অতিরঞ্জনের খাতিরে।

আরও পড়ুনঃ আনাজ মান্ডিতে কারখানার আগুনে নিহত ৪৩, আহত ৫৬

অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি তাই রাবণকে অসুর হিসাবে না দেখে একজন গুণী ব্যক্তি হিসাবেই দেখে, যার দশটি মাথার উপস্থিতি ছয়টি উপনিষদ ও চারটি বেদের সমন্বয়কেই প্রতিফলিত করে।

অন্যদিকে, বনবাসের পরে সীতার অযোধ্যা ফেরার পর গৃহবধূকে অগ্নিপরীক্ষার সামিল করা রামচন্দ্রকে পুরুষতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব হিসাবেই তুলে ধরে। যদিও এগুলিকে প্যারাডক্স হিসাবেই গ্রাহ্য করা হয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, তবুও একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here