মৃত্যু উপত্যকার লাশের মিছিলে এক মুঠো আশার আভা ছড়াচ্ছে ফুটবল

0
66

চিরঞ্জিৎ সাহা

মনের রিসাইক্লিং-এ আজ হঠাৎ উঁকিঝুঁকি মারছে  ১৯১১-এর ২৯ শে জুলাইয়ের ঐতিহাসিক এক সোনালি দুপুর । বাইশটা খালি পায়ের স্পর্ধা সেদিন স্তব্ধ করেছিল ব্রিটিশবুটের দম্ভকে ।

football tournament | newsfront.co
চিত্র সৌজন্যঃ দিস ফুটবল টাইমস

প্রতিভা আর পরিকাঠামোর কয়েক যোজন ব্যবধানকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছিল এগারো বাঙালির ইচ্ছেশক্তি । শিবদাস ভাদুড়ি , অভিলাষ ঘোষদের এই কালজয়ী কীর্তি শুধুই সবুজ ফুটবল ময়দানের জয় ছিল না ; ছিল প্রবল পরাক্রমশালী ইংরেজদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত, পরাধীন ভারতবাসীর প্রাণপণে রুখে দাঁড়ানোর লড়াই , স্বদেশি অন্দোলনে উদ্দীপ্ততার মন্ত্রপূত জলপ্রদায়ী এক সাহসী জয়গাঁথা ।

অবহেলা , অন্যায় , অপমান , তাচ্ছিল্যের প্রতিবাদ সেদিন টর্নেডো হয়ে আছড়ে পড়েছিল গোলাকার বলটার ওপর , শোষিত ভারতবাসীকে জুগিয়েছিল শাসকের চোখে চোখ রেখে জবাব দেওয়ার শৌর্য । তাই তো উনিশশো এগারো সালের পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট ক্লাবকে হারিয়ে মোহনবাগানের শিল্ড জয় আজও বিবেচিত হয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে যা প্রত্যেক বাঙালি বিপ্লবীর শিরায় শিরায় সঞ্চারিত করেছিল আত্মবিশ্বাসের দামাল স্রোত ।

এরপর আবারও ১৯৪৭ । একটা কাঁটাতাঁর এক লহমায় পড়শিকে করল বিদেশি আর স্বদেশকে পরদেশ ! ভিটেমাটিহারা লাখ লাখ হিন্দু বাঙালি তখন  সদ্যগঠিত পাকিস্তান ছেড়ে ভারতমুখী । এ তাদের বেঁচে থাকার লড়াই , সম্বলহীন উদবাস্তুর খড়কুটো আঁকড়ে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম ।

football tournament | newsfront.co
চিত্র সৌজন্যঃ ইন্ডিয়া টু ডে

নেতাদের আভ্যন্তরীণ চুক্তিপর্বে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেলেও ঢাকা,ময়মনসিংহ, যশোহর কিংবা ফরিদপুরের গলে এল রাডক্লিফ বর্ডারের কণ্টকমাল্য । রবি ঠাকুরের ‘ সোনার বাংলা’ -র একাংশ দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল ধর্মের ভিত্তিতে ।

কট্টরপন্থী মুসলিমদের অত্যাচারের আতিশয্যে এপার বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গের অচিন ঠিকানায় পাড়ি জমাল ওপার বাংলার বহু হিন্দু পরিবার । জনবিস্ফোরণের নতুন সংজ্ঞা রচনা করল পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা ট্রেনগুলি । দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের নীচে, রেললাইনের পাশে কিংবা লোকের বাড়ির বারান্দায় —- চোখ রাখলেই নজরে পড়ত সহায়হীন নিঃস্ব বুভুক্ষুর অন্তরাত্মার হাহাকার ।

আরও পড়ুনঃ আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা ঘিরে উদ্দীপনা বালুরঘাটে

সব স্বাধীনতার স্বাদ যে মিষ্টি হয় না , তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ সেদিনের সেই কঙ্কালসার ‘ নিজভূমে পরবাসী ‘ উদবাস্তু মানুষগুলো । একদিকে সর্বস্ব হারিয়েও টিকে থাকার দুর্দম অসহনীয় , অসম যুদ্ধ ; অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দাদের বিমাতৃসুলভ ব্যঙ্গবিদ্রুপ —  তবে সমস্ত প্রতিকূলতাকে রীতিমতো দাপটের সঙ্গে দুরমুশ করে শেষমেষ বিজয়ীর হাসি হাসে বাঙালের জেদ।

কাঁটাতাঁরের রক্তাক্ত দাগ পিঠে নিয়ে চিরস্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয় এপার বাংলার নাগরিকপঞ্জিতে । খোলা আকাশ কিংবা একফালি ত্রিপলের নীচে রাতের পর রাত কাটানো অসহায়, উদবাস্তু মানুষগুলো পশ্চিমবঙ্গে এসে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা খুঁজে নিয়েছিল লাল-হলুদ রঙে ।

রক্তের লাল আর মশালের হলুদ ক্রমে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল রিফিউজিদের বেঁচে থাকার ঐকান্তিক ইচ্ছাশক্তির সাথে । সমস্ত হতাশা, ক্লান্তি , হেরে যাওয়ার গ্লানি ভোলানো এক পরম শান্তিদায়িনী ভরসার কোল হয়ে উঠল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব।

মশালের অগ্নিশিখা সর্বহারা বাঙালের মননে দিল নিভতে নিভতেও জ্বলে ওঠার তেজ । সবুজের বুক চিরে আপ্পারাও , সালে , আমেদ খানের প্রাণান্তকর দৌড়ে ওপার বাংলার মানুষ খুঁজে পেল সাফল্যের শিখরে পৌঁছনোর এক সঞ্জীবনী মন্ত্র।

ভেঙ্কটেশের ড্রিবলিং শেখালো জীবনের সব বাধাবিপত্তিকে হেলায়  অতিক্রম করার পাঠ । অর্থাৎ সেদিনের সেই ছিন্নমূল , উদবাস্তু মানুষগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে অবলম্বন ছিল একটাই — ফুটবল তথা ইস্টবেঙ্গল ।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম উদ্দীপক যদি ১৯১১-এর  শিল্ড জয় হয় , লেসলি ক্লডিয়াস সরণির লাল-হলুদ তাঁবু তবে পূর্ববঙ্গীয় বিপর্যস্ত মানুষগুলোর জীবনদায়ী স্পন্দন । ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে ঠিক সেভাবেই আজ আবার উঠে আসছে জম্মু-কাশ্মীরের আরেক ফুটবল ক্লাব রিয়েল কাশ্মীর । খুব স্বল্পদিনেই ভারতের ফুটবল মানচিত্রে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেওয়ার সংকেত দিচ্ছে ২০১৬ সালে নির্মিত ভূস্বর্গের এই দলটি ।

মুক্ত অরণ্য থেকে একটা ছোট্ট পাখিকে তুলে নিয়ে এসে যখন প্ল্যাটিনামের বেড়ি পরিয়ে সোনার খাঁচায় বন্দি করা হয় , তখন কেউ খোঁজ রাখে না তার মনোবাঞ্ছার। তিনবেলা খাবার আর নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতিতে লুপ্ত হয় পাখিটির স্বাধীনতা , নিষ্ক্রিয় হয় তার উড়ান ডানা।

পাখি বাইরে থাকলে সমস্যা অনেক । সে ইচ্ছে মতো উড়ান দেবে নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে , কখনও বা ডানা ঝাপটে প্রকাশ করবে নিজের ন্যায্য দাবিদাওয়া । তার চেয়ে তাকে ভরে দাও খাঁচায় ! সুন্দর জীবন আর নিরাপদ ভবিষ্যতের প্যানডোরা বাক্সের আশ্বাস দিয়ে রোধ করো তার কণ্ঠ । মনুষ্যত্বের অন্যতম বড় ব্যধিই হল প্রভুত্বব্যঞ্জনা আর আধিপত্যের লালসা ।

আরও পড়ুনঃ মহিলা ফুটবল প্রতিযোগিতায় বিজয়ী নয়াগ্রাম পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মু গভমেন্ট কলেজ

তাই তো মিথ্যে স্বপ্নের গ্যাসবেলুনে  চড়িয়ে বিলাসিতার নীল সেলুনে ঘুরিয়ে হঠাৎ-ই একদিন পাখিকে জেলে ভরা হয় তারই হিতকল্পের নামে । ঠিক যেমন কাশ্মীরবাসীরই অজান্তে গোটা উপত্যকাকে পুরোপুরি সেনা দিয়ে মুড়ে ফেলে, জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন করে তাদেরই উন্নতিকল্পের বুলি আওড়ে সরকার রদ করল ৩৭০ ধারা !

সত্যিই কি অদ্ভুত না ? যাদের কল্যাণে সরকারে এত উদগ্রীবদী, তাদেরই খাঁচায় বন্দি করে ঘোষণা করতে হচ্ছে যুগান্তকারী জনদরদী আইন ? নাকি এ কেবল একটি সুচারু আড়াই প্যাঁচের চাল মাত্র ? সমস্ত দেশবাসীর কাছে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সুকৌশলে কাশ্মীরকে আনা হল চিরাচরিত সাংবিধানিক ধারার বাইরে। দেশের বাকি প্রজাদের সম্মুখে নিজের শৌর্যের গরিমা প্রকাশে অরণ্যের পাখির মতো ভূস্বর্গকেও নতুন উপায়ে শৃঙ্খলিত করল বাস্তবের মহারাজা।

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট সমগ্র ভারতবাসীকে আনন্দে উদ্বেল করলেও পূর্ববঙ্গের ভিটেমাটিহারা মানুষগুলোর কথা ভাবেনি কেউ। তাই তো স্বাধীনতার সাথেসাথেই নিজের অজান্তে রক্তশূন্য বিপ্লবী পেয়েছিল দেশভাগের গ্লানি। তার মতামত শোনার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন মনে করেননি নবগঠিত রাষ্ট্রনেতাগণ।

ব্রিটিশের গুলিতে বাবাকে হারানো বিপ্লবী স্বদেশি বন্ধুর হাতে ধর্ষিতা হতে দেখল নিজের বোনকে। কারণ , সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতা যে তাকেই অন্ধকারে রেখে নিজের জন্মভূমিকে খাতায় কলমে বানিয়ে দিয়েছে ভিনদেশ । তবে সেদিনের সেই বাস্তুহারা মানুষগুলোর মতো আজ কাশ্মীরও জেগে উঠছে ফুটবলকে ঘিরেই।

সেনার ভারী বুটের পদসঞ্চার, জঙ্গির গুলি, পুলওয়ামার রক্তস্নানকে উপেক্ষা করে উপত্যকার গ্যালারি ভর্তি মানুষ গলা ফাঁটায় রিয়েল কাশ্মীরের জন্য। মাইনের ক্ষতকে ভুলিয়ে দেয় মাঠে কাশ্মীরি ছেলেদের দাপাদাপি আর একটা ফুটবল ।

কাশ্মীরিদের আবেগের সাথে নিজেদেরও গভীরভাবে একাত্ম করে ফেলেছেন রিয়েল কাশ্মীরের দেশি- বিদেশি ফুটবলাররা আর সে কারণেই ৩৭০ ধারা রদের পর গোটা কাশ্মীর যখন সমগ্র দেশ থেকে বিছিন্ন, উপত্যকা জুড়ে এক অজানা ভয়ের আবহ ; ম্যাসন রবার্টসন ,দানিশ ফারুখরা ডুরান্ড খেলতে হাজির হন কলকাতায়  ।

কারণ , তারা জানেন পার্বত্য উপত্যকার ওই অবরুদ্ধ মানুষগুলোর মনে প্রাণের সঞ্চার করতে পারে একমাত্র ফুটবল , ধ্বনিত করতে পারে বেঁচে থাকার সুর , জীবনযুদ্ধে লড়াই করার স্পর্ধা।

আরও পড়ুনঃ আট দলীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা মহেশতলায়

দিনের পর দিন পরিবারের সাথে যোগাযোগ না থাকার পরও , প্রতি মুহূর্তে আপনজনের শোকবার্তা শোনার উৎকণ্ঠা বুকে নিয়েও মাঠে তাই নিজেদের দুশো শতাংশ নিংড়ে দেন রিয়েল কাশ্মীর ফুটবলাররা। নব্বই মিনিট আটকে রাখেন মোহনবাগানের মতো প্রবল পরাক্রমশালী দলকে।

হ্যাঁ , এটাই ভারতীয় ফুটবল। ইস্ট-মোহনের পর উঠে আসছে আবেগের আরেক নাম রিয়েল কাশ্মীর যার অগ্রগমনের মধ্যে দিয়েই হয়তো সন্ত্রাসের শৈত্যকে উপেক্ষা করে গোটা উপত্যকাবাসী খুঁজে নেবে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার উমপ্রদায়ী স্ফুলিঙ্গকে।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here