রমরমিয়ে চলা ভেজাল সরষের তেলের ব্যবসা রুখতে অবশেষে পুলিশের অভিযান

0
109

পিয়া গুপ্তা, উত্তর দিনাজপুরঃ

ভেজাল মিশছে সরিষা তেলে৷ ভেজার সরিষা তেল উৎপাদনের শীর্ষে এখন কালিয়াগঞ্জ। বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বল্প সময়ে অধিক লাভের জেরে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সাধারণ মানুষ৷ রীতিমতো গোডাউনে খুলে প্রকাশ্যেই চলছে ভেজালের কারবার৷ আর এই ভেজাল তেল ঢুকছে গৃহস্থ ঘরে৷ এমনকি বিদ্যালয়গুলির মিড ডে মিলে খাবারেও৷

পুলিশি অভিযান।নিজস্ব চিত্র

ফলে, যে কোনও দিন এই ভেজাল তেলের প্রভাবে বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র ছাত্রীদের অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখছেন অনেকেই। প্রশাসনের নাকের ডগায় কালিয়াগঞ্জের বেশ কিছু সংখ্যক মিলে ও বিভিন্ন গোডাউনে এই ভেজাল সরিষা তেল তৈরির কারবার চলছে রমরমিয়ে৷

আশ্চর্যজনক ভাবে প্রশাসনও এতদিন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেও আজ দেখা গেল জেলা পুলিশের ডিএসপি প্রসাদ প্রধান এবং গোবিন্দ শিকদার ও কালিয়াগঞ্জ থানার আইসি নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী ।

নিজস্ব চিত্র

রবিবার গভীর রাতে কালিয়াগঞ্জের রশিদপুর মোড়ের কাছে একটি নামি তেল মিলের কারখানায় হানা দেয় পুলিশ সেই সেই তেলের মিলের মালিক ইন্দ্রচাদ আগারওয়াল সেখান থেকে বেপাত্তা হয়ে যান।

এরপর পুলিশ সেই তেল মিলের বিভিন্ন রাসায়নিক তরল পদার্থ এবং বিভিন্ন তেলের টিন ও বিভিন্ন ধরনের তেলের আনুষঙ্গিক কিছু জিনিস বাজেয়াপ্ত করে নেয়। এরপর সেই তেল মিল তালা লাগিয়ে দেয় পুলিশ।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক আতঙ্ক দেখা দিয়েছে কালিয়াগঞ্জের এই তেল মিলের পাশাপাশি আরও যে সমস্ত কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এরকমভাবে ভেজাল তেল উৎপন্ন করে আসছে তাদের মধ্যে। জানা যায়, পুলিশ সূত্রে এই তেল মিল মালিকের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ ডোমকলে সিঙ্গুর থেকে নবান্ন অভিযানের প্রচার কর্মসূচি

এই তেল মিলের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ভেজাল তেল উৎপন্ন হচ্ছে বলে এমন খবর ছিল নাকি পুলিশের কাছে । যদিও জানা যায় যেগুলো তেল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরেই জানা
যাবে এই তেল মিলে ভেজাল হচ্ছিল কি না সে ব্যাপারে।

অন্যদিকে জানা যায় দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ এই তেল মিল এর মালিক গোপাল মাস্টার্ড অয়েল নামে ব্র্যান্ড দিয়ে বাজারে তাদের উৎপাদিত তেল বিক্রি করে আসছিল।

আর তারা তাদের তেল মিলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে নামেই কারখানা থাকলেও আসলে পামওয়েল তেলের সাহায্যে সরষের তেল বানিয়ে তারা বাজারে বিক্রি করতো বলে অভিযোগ।

এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ কালিয়াগঞ্জে এমন বহু তেল মিল রয়েছে যে তেল মিল গুলি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় তেল মিল গুলিতে কোনও প্রকার খোল পাওয়া না গেলেও প্রতিদিন এই সকল মিল ও গোডাউন থেকে কয়েকশ টিন ভেজাল সরিষার তেল উৎপাদন হচ্ছে। যা উত্তর দিনাজপুর জেলা সহ রাজ্য ও ভিন রাজ্যে ট্রাকে করে পাড়ি দিচ্ছে অনায়াসে।

সুত্রের খবর, কম দামের সাদা তেল ও পাম ওয়েল জাতীয় তেল ভিন রাজ্য থেকে বহন করে কালিয়াগঞ্জে নিয়ে আসছে বড় বড় ট্যাঙ্কার। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ টি এমন ট্যাঙ্কার ঢোকে কালিয়াগঞ্জে।

চারিদিকে উঁচু প্রাচীর দেওয়া বন্ধ তেল মিলের আড়ালে ও গোডাউনে প্রকাশ্য দিবালোকে খালি করা হচ্ছে ট্যাঙ্কারগুলি। এরপরেই সেই কমদামী সাদা বা পাম তেলের মধ্যে সরিষার তেলের রং আনতে ব্যবহার করা হচ্ছে এক ধরনের ক্ষতিকারক রাসায়নিক তরল পদার্থ।

এক টিন সাদা বা পাম তেলে এক ড্রপার বা কয়েক এমএল রাসায়নিক সেই বিষাক্ত তরল ব্যবহার করে মিশ্রণ করলেই কমদামী তেল সরিষার তেলের রং ধারণ করছে। কোথাও সাদা বা পাম তেলের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে সামান্য খাঁটি সরিষার তেলও।

অপরদিকে, এক টিন তেলে খাঁটি সরিষার তেলের ঝাঁঝ আনতে ব্যবহার করা হচ্ছে অপর এক প্রকার বিষাক্ত দমবন্ধ করা ঝাঁঝ যুক্ত তরল।

তেলে ঝাঁঝ আনতে এই বিষাক্ত ঝাঁঝ যুক্ত তরল এক টিনে এক ফোঁটা মেশানো মাত্রই কমদামী সাদা তেল ও পাম তেল খাঁটি সরিষা তেলের মত ঝাঁঝ বিশিষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

ফলে, সাধারণ মানুষের বোঝবার উপায় থাকছে না, এই বিষাক্ত তেল খাঁটি না কমদামী নামমাত্র সরিষার তেল। ফলে খাঁটি সরিষার তেলের তুলনায় একই রকম দেখতে এই কম দামের ভেজাল সরিষার তেল নিজেদের অজান্তেই কিনছেন সাধারণ মানুষ।

সুত্রের খবর, কম দামের সাদা তেল ও পাম ওয়েল জাতীয় তেল ভিন রাজ্য থেকে বহন করে কালিয়াগঞ্জে নিয়ে আসছে বড় বড় ট্যাঙ্কার। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ টি এমন ট্যাঙ্কার ঢোকে কালিয়াগঞ্জে।

বন্ধ তেল মিলের আড়ালে ও গোডাউনে প্রকাশ্য দিবালোকে খালি করা হচ্ছে ট্যাঙ্কারগুলি। এরপরেই সেই কমদামী সাদা বা পাম তেলের মধ্যে সরিষার তেলের রং আনতে ব্যবহার করা হচ্ছে এক ধরনের ক্ষতিকারক রাসায়নিক তরল পদার্থ।

খাঁটি সরিষার তেলের তুলনায় এক টিন ভেজাল সরিষার তেল ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত কম দামে বিক্রি করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। টিন প্রতি এতোগুলো টাকা কম দামে খাঁটি সরিষার তেলের মত ঝাঁঝ যুক্ত ভেজাল তেল, খাঁটি সরিষার তেল বলে বেশি লাভের আশায় হাটে বাজারে কেজি বা লিটার হিসেবে বিক্রি করছেন সাধারণ দোকানদাররা। এই সকল ভেজাল সরিষার তেল শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জের গৃহস্থ বাড়িতে ঢোকার পাশাপাশি ঢুকছে বিদ্যালয় গুলির মিড ডে মিলে।

ফলে, বিষাক্ত রাসায়নিক তরল সাধারণ মানুষ থেকে ছাত্র ছাত্রীদের শরীরে দিনের পর দিন নিজেদের অজান্তেই প্রবেশ করছে। যার ফলস্বরূপ যে কোনও দিন খাদ্যে বিষক্রিয়ায় খবর পাওয়ারও সম্ভাবনা দেখছেন কালিয়াগঞ্জের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা।

কালিয়াগঞ্জ পুরএলাকার মাত্র কয়েকটি ওয়ার্ড বাদ দিলে প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই ও শহর লাগোয়া এলাকায় বেশকিছু বন্ধ মিলে ও গোডাউনে রমরমিয়ে প্রকাশ্যে দিবালোকে ভেজাল সরিষা তেল তৈরির কারবার বহাল তবীয়তে চললেও তা প্রশাসনের তরফে তা বন্ধের কোনও তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় নি।

কালিয়াগঞ্জে ভেজাল সরিষা তেলের কারবার বন্ধ করতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আন্দোলনে নামলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। উল্টে অল্প সময়ে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় ভেজাল তেল তৈরির কারবারের দিকে এগিয়ে আসছেন বেশকিছু অসাধু মানুষজন।এলাকাবাসীদের অভিযোগ, একটি তেল মিলে অফিসারদের অভিযান চালানোর খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেজাল তেল উৎপাদনকারীরা সেই সময়ের জন্য নিজেদের তেল মিল ও গোডাউনের মেন গেটে তালা মেরে উৎপাদন সাময়িক ভাবে বন্ধ রেখে দেন।

অফিসাররা চলে যাবার পর থেকেই ফের ভেজাল তেল তৈরির রমরমা শুরু হয়ে যায় ঐ সকল মিল ও গোডাউনে। কালিয়াগঞ্জ বাসীদের দাবি, একসঙ্গে সমস্ত ভেজাল তেল মিল গুলিতে অভিযান করুক প্রশাসন। যাতে ভেজাল তেলের কারবারিরা নিজ নিজ মিলের প্রধান গেটে তালা মারার সুযোগ না পান। তবেই সমস্যা সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভেজাল সরিষা তেলের এক কারবারি জানান, উপর মহল, থেকে নিচ মহল পর্যন্ত ‘সেটিং’ করেই এই ব্যবসা চলছে।

উপর মহল থেকে নিচ মহল পর্যন্ত কারা এই তালিকায় রয়েছে ও কি সেটিং রয়েছে? এব্যাপারে ওই ব্যবসায়ীকে প্রশ্ন করা হলে সে ব্যবসার খাতিরে কোনও উত্তর দেননি।

ব্যবসায়ীদের মধ্যেই প্রচলিত একটি কথা রয়েছে,‘‘বছর পাঁচেক চুটিয়ে এই ভেজাল তেল তৈরির কারবার চালাতে পারলে সারা জীবন কোনও কাজ না করে ঘরে বসে থেকে খেলেও লাভের টাকা শেষ হবেনা।’’

ফলে, নিজের আখের গুছাতে গিয়ে শিশু থেকে সাধারণ মানুষের শরীরে বিষাক্ত রাসায়নিক ঢুকিয়ে তিল তিল করে মৃত্যুর কোলে ফেলে দেওয়া এই সকল ভেজাল তেলের কারবারিরা কি আদৌও শাস্তি পাবে? নাকি এই ভাবেই কালিয়াগঞ্জে ভেজাল তেল তৈরির কারবার রমরমিয়ে চলতে থাকবে? অদৃশ্য যমরাজের আঁতুড়ঘর থেকে কবে মুক্তি পাবে কালিয়াগঞ্জের সাধারণ মানুষ? এই সব প্রশ্ন এখন ঘোরাফেরা করছে কালিয়াগঞ্জের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।

এদিকে আজকে যেভাবে পুলিশ হানা দিল ভেজাল তেলের কারবারি বিরুদ্ধে তাকে সাধুবাদ জানান কালিয়াগঞ্জের মানুষ।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here