মুনিরুল তারেক, ঢাকাঃ
করোনা ভাইরাসের ভয়ানক প্রাদুর্ভাব বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী রাষ্ট্রকেও দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই ব্যাধিকে পুঁজি করেই চলছে অসাধু বাণিজ্য। এক শ্রেণির স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা করোনা পরীক্ষার নামে নমুনা সংগ্রহ করে হাতিয়ে নিচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা। ইতিমধ্যে এমন দুটি প্রতারক প্রতিষ্ঠানের তিন কর্ণধারকে গ্রেফতার করেছে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
এই তিন জনের মধ্যে একজন হচ্ছেন সরকারে ক্ষমতাসীন দলের নেতা পরিচয়ধারী এক ব্যক্তি। রয়েছেন একজন সরকারি নারী চিকিৎসক ও তার স্বামী। গত মার্চ থেকে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ধরা পড়া শুরু করে। এরা তখন বিনামূল্যে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করবে বলে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছে। পরীক্ষা না করেই দিয়েছে করোনার ‘ভুয়া’ রিপোর্ট।
এদিকে, গত ৮ জুলাই কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে করে দোহা থেকে যাওয়া ১২৫ বাংলাদেশিকে বিমান থেকে নামতে দেয়নি ইতালি। করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে যাওয়া যাত্রীদের কয়েকজনকে সেখানে পরীক্ষা করালে পজেটিভ আসায় এই সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ নিয়ে ইতালির সংবাদপত্র ইল মেসাজ্জেরোর প্রথম পাতায় ‘দাল বাংলাদেশ কন তেস্ত ফালসি’ বা ‘বাংলাদেশ থেকে ভুয়া টেস্ট সহকারে’ শিরোনামে প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
এছাড়া মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের ভুয়া রিপোর্ট নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনের হেডলাইন ছিলো ‘বাংলাদেশে বড় ব্যবসা: করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি’। করোনার ভুয়া রিপোর্টের বিষয়টি সারাবিশ্বে বাংলাদেশের মাথা নীচু করে দিয়েছে।
স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে নারী চিকিৎসকের প্রতারণাঃ
ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। তার প্রকৃত নাম সাবরিনা শারমিন হুসেইন। ওভাল গ্রুপ নামক প্রতিষ্ঠানের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান প্রধান আরিফ চৌধুরীর সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়েবন্ধনে জড়িয়ে করেন নাম পরিবর্তন। প্রথম সংসার ছেড়ে দেওয়ার পরই বদলে যায় জীবন। সাবরিনা পান ওভাল গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব।
সরকারি চিকিৎসক হিসেবে কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্যতা থাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বড় আয়োজনের ঠিকাদারী কাজ বাগিয়ে দিতেন স্বামীকে। স্ত্রীর মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে প্রভাব বিস্তার করেন আরিফ। এই সব সম্পন্ন কাজ করতে গিয়ে আইটি, সাউন্ডসহ যেসব ছোট প্রতিষ্ঠানের দ্বারা কাজ করাতেন, তাদের পাওনা আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে এই দম্পতি জোবেদা খাতুন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (জেকেজি হেলথকেয়ার) নামক সংস্থা খুলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চুক্তি করে যে, তারা ক্যাম্প করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার জন্য বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহ করবে। সেই নমুনা সরকারের নির্দিষ্ট পরীক্ষারাগারে পৌঁছে দেবে। সেখানে ফল আসলে তা নমুনা দেওয়া ব্যক্তিকে জানিয়ে দেবে। কিন্তু এই দম্পতি ঢাকার একটি বন্ধ থাকা কলেজের ময়দানে ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানে নমুনা নিতেন, সঙ্গে নিতেন ৩ হাজার ৫শ’ টাকা। আর সংগৃহীত নমুনা ফেলে দিয়ে দেওয়া হতো নিজেদের মন মত ভুয়া রিপোর্ট।
জেকেজি হেলথকেয়ার ২৭ হাজার রোগীকে করোনার পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনা নির্ধারিত পরীক্ষারাগারে পাঠিয়ে সঠিক রিপোর্ট দিয়েছে। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০টি রিপোর্ট নিজেরাই দিয়েছে কোনো প্রকার পরীক্ষা ছাড়াই।
গত ২৪ জুন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরী এবং চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনাকে ১২ জুলাই গ্রেফতার করেছে পুলিশ বর্তমানে তারা গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে রিমান্ডে রয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ নব্য জেএমবির ভারতীয় বংশোদ্ভুত নারী সদস্য ঢাকায় গ্রেফতার
রিজেন্ট হাসপাতালের ভুয়া করোনা রিপোর্ট কেলেঙ্কারীঃ
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকায় নিজের রিজেন্ট হাসপাতালের দুটি শাখা করোনাক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত করে দেন এর চেয়ারম্যান মোঃ সাহেদ। সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছেন, বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হবে। এভাবে প্রায় তিন মাস চলার পর বেরিয়ে এলো পিলে চমকানো খবর।
করোনা পরীক্ষার নমুনা নিয়ে পরীক্ষা না করেই দেওয়া হতো ভুয়া রিপোর্ট। বিনামূল্যের চিকিৎসার কথা বলে ভর্তি করে রোগীর কাছ থেকে আদায় করা হতো লাখ লাখ টাকা।
কয়েক দিনে আগেও সবাই এই সাহেদকে চিনতেন সৎ এবং মানবদরদী মানুষ হিসেবে। টেলিভিশনের টক-শোতে উপস্থিত হয়ে জোর গলায় কথা বলতেন সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষে। নিজেকে পরিচয় দিতেন দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য হিসেবে। করোনা নিয়ে প্রতারণা প্রকাশের পর বেরিয়ে এলো তার ভয়ঙ্কর রূপ।
এই ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম লেখা সাহেদ করিম। কিন্তু বহু বছর ধরে নানাবিধ অপকর্মে লিপ্ত থাকায় নিজেকে লুকাতে কখনো মোঃ সাহেদ, কখনো সাহেদ আলম সেজেছেন। আর পেশাগত পরিচয়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে বহু ছলচাতুরি। কখনো মেজর, আবার প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান, কখনো বা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, কখনো বলেছেন সংসদ সদস্য। আবার কখনো মেজর ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী, কর্ণেল ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরীও তার পরিচয় ছিলো।
আরও পড়ুনঃ বিত্তের চেয়ে জীবন মূল্যবান! উচ্চহারে কর দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে চিঠি কোটিপতিদের
এতো সব ভুয়া পরিচয় দিয়ে তিনি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরকে বোকা বানিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।গত ১৫ জুলাই ভোর ৫টা ১০ মিনিটে সাতক্ষীরা সীমান্তের দেবহাটা থানার সাকড় বাজারের পাশে অবস্থিত লবঙ্গপতি এলাকা থেকে নৌকায় পালিয়ে থাকা অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করেছে এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব)। তিনি ভারতের পালানোর উদ্দেশ্যে সেখানে অবস্থান করছিলেন। বর্তমানে তিনি গোয়েন্দা পুলিশের রিমান্ডে রয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584