ঐতিহ্যবাহী মনসা পুজোয় করোনাজয়ের প্রার্থনায় ব্রতী শালবনীর পিরি পরিবার

0
120

নিজস্ব সংবাদদাতা,পশ্চিম মেদিনীপুরঃ

আজ থেকে ৭৫ বৎসর পূর্বে স্বপ্নে পাওয়া ‘লোহার বাড়ি’ আজও মা মনসা রূপে পূজিতা হন ভাতমোড়ের পিরি বাড়িতে। পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনীর ভাতমোড় গ্রামের এক অখ্যাত গৃহবধূ রসবালা দেবী এক আশ্বিনের গভীর রাতে মা মনসার স্বপ্নাদেশ পান যে তার হাতে পূজিতা হবেন বলে ।

manasha devi | newsfront.co
‘ লোহার বাড়ি ‘ মা মনসার রূপ ৷ নিজস্ব চিত্র

তবে কোনো মূর্তিতে নয় পূজিতা হবেন ‘লোহার বাড়ি’তে। দেবী নিজের কথা মতো রেখে যান একটি লোহার শলাকা । সেই থেকে আজও নিষ্ঠার সাথে ওই লোহার বাড়ি পূজিতা হয়ে আসছেন মা মনসা রূপে। তবে এবার সময় টা অন্যরকম। তাই অনাবশ্যক আড়ম্বরে না মেতে করোনা কে জয় করে পৃথিবী আবার এগিয়ে চলুক নিজের নিয়মে এই প্রার্থনা জানিয়ে এবার মা মনসার পুজোয় ব্রতী হবে শালবনীর পিরি পরিবার।

temple | newsfront.co
নিজস্ব চিত্র

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনীর ভাতমোড় একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এই গ্রামেই বাস করতেন ব্রজনাথ পিরি। ব্রজনাথ বাবু জমিদার না হলেও প্রচুর জমির মালিক ছিলেন। প্রভূত সম্পত্তি আর জমির মালিক হওয়ার সুবাদে কোনোদিন ভাত কাপড়ের অভাব ঘটেনি পিরি বাড়িতে। ব্রজনাথ বাবুর স্ত্রী ছিলেন রসবালা দেবী। ব্রজনাথ বাবু ও রসবালা দেবীর চার ছেলে এক মেয়ে। রসবালা দেবী পাঁচ সন্তানের লালন পালন, সংসারের সমস্ত ঝক্কি, স্বামীর আবদার, শ্বশুর শাশুড়ির খেয়াল একা হাতে সামলাতেন।

আরও পড়ুনঃ পুজোকে ঘিরে সচেতনতায় জোর ঝাড়গ্রাম মহকুমা প্রশাসনের

তাই এই রসবালা দেবী শুধু পিরি পরিবারের নয় তিনি হয়ে উঠেছিলেন এলাকার সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। শোনা যায় পিরি পিরিবারে কোনো অতিথি গেলে তাকে না খাইয়ে রসবালা দেবী ছাড়তেন না। এই সমস্ত দিক সামলে নিয়ম করে বাড়িতে প্রতিদিন মা মনসার পুজো করতেন৷ কারণ চাষবাসের উপর নির্ভরশীল সংসার। তখনকার দিনে মাঠে সাপখোপের উপদ্রব খুব ছিল৷ তাই সেই উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই তিনি মনসার পুজো করতেন৷

সংসারের হাল সামলে ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে যখন তারা সংসারী হয়েছে ,তখন তিনি একটু সময় পেয়েছেন মাকে মন-প্রাণ ভরে আরাধনা করার ৷ ঠিক সেই সময়ই আশ্বিনের এক গভীর রাতে বাড়ির সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, বাড়ি আলো করে মা মনসা স্বপ্নে এলেন রসবালা দেবীর৷ স্বপ্নাদেশ করেন তার হাতে তিনি পূজিতা হতে চান৷ তবে কোনো মূর্তি রূপে নয় একটি লোহার দন্ড হয়ে পূজিতা হবেন। সেই দন্ডটি দেবী রেখে যান বাড়ির তুলসী তলায়। বলেই তিনি মিলিয়ে যান। মা মিলিয়ে যাওয়ার পরই রসবালা দেবীর ঘুম ভেঙে যায়৷ পাশেই শুয়ে থাকা স্বামী ব্রজনাথ বাবুকে ঘুম থেকে তুলে মায়ের স্বপ্নাদেশের কথা বলেন। এদিকে বাড়ির সকলেই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ঘুম থেকে উঠে পড়েন।

আরও পড়ুনঃ করোনা আবহে কঠোর নিয়মের বেড়াজালে ঐতিহ্যবাহী আলিপুরদুয়ার দুর্গা বাড়ির পুজো

স্ত্রীর মুখে দেবীর এই কথা শুনে ব্রজনাথ বাবু বাড়ির অন্যান সদস্যদের নিয়ে বাড়ির উঠোনে বেরোতেই দেখেন উঠোনের এক কোনে কিছু একটা চকচক করছে। দুরুদুরু বুকে এগিয়ে গেলেন সেই স্থানে। গিয়ে দেখেন একটি লোহার শলাকা পড়ে রয়েছে। আনন্দে, ভয়ে এবং ভক্তিতে রসবালা দেবীর চোখে জল এসে যায়৷ মা তো তাকে স্বপ্নে বলেছেন কোনো মূর্তিতে নয় লোহার বাড়িতে পূজিতা হবেন। পরদিন সকালে সেই স্থানে মনসা গাছ লাগিয়ে তার নিচেই লোহার শলাকা টি কে মনসা রূপে পুজো করেন রসবালা দেবী৷ সেই লোহার শলাকাই ‘লোহার বাড়ি’ নামে পরিচিত৷

আজীবন রসবালা দেবী পুজো করেন মা মনসার। পরে তার অবর্তমানে পুজোর ভার নেয় তার ছেলে প্রমথনাথ পিরি। প্রমথনাথ বাবুও ছিলেন মা,মনসার পরম ভক্ত। তিনি ছিলেন সাপুড়ে। সাপ খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন৷ তবে এলাকায় সাপুড়ের চেয়ে কবিরাজ হিসেবেই সুখ্যাতি ছিল তাঁর। শোনা যায় অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা করে রুগী কে সুস্থ করে তুলেছেন৷ ফলে মায়ের মাহাত্ম্য এলাকা সহ দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে । খোলা আকাশের পরিবর্তে মায়ের জন্য মাটির মন্দির নির্মাণ করেন প্রমথনাথ বাবু। বর্তমানে কংক্রিটের সুরম্য মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে।

মায়ের পুজো, সাপ খেলা আর কবিরাজি করতে করতেই একদিন প্রমথনাথ বাবু বার্ধ্যক্যে আসীন হন। নড়াচড়া প্রায় বন্ধ। কিন্তু তাঁর অবস্থায় মায়ের দেখভাল কে করবেন এই নিয়ে পিরি পরিবার পড়লো মহাফাঁপরে৷ প্রমথনাথ বাবুর তিন ছেলে তিন মেয়ে। ছেলেরা চাকরী ও ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকার কারণে মায়ের দেখভালের দায়িত্ব নেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই ফের মায়ের স্বপ্নাদেশ, ” পিরি পরিবারের সদস্যের হাতেই পুজো চান” ৷ কিন্তু পুজো করবেন কে? মায়ের আদেশেই প্রমথনাথ বাবুর দুই নাবালক পৌত্র সঞ্জয় পিরি ও জন্মেঞ্জয় পিরি কে পুজোর দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়৷ সেই মতো এখনো সঞ্জয় বাবু ও জন্মেঞ্জয় বাবু মায়ের আরাধনা করে আসছেন৷

আরও পড়ুনঃ অনাড়ম্বর ভাবে পূজিত হবে ঐতিহ্যবাহী পানিগ্রাহী পরিবারের পট-দেবী

সঞ্জয় বাবু জানান, নিত্যা পুজো ছাড়াও প্রতি মাসের সংক্রান্তি তিথিতে মায়ের পুজো হয়। তবে প্রতিবছর আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি তিথি যা ডাক সংক্রান্তি হিসেবে পরিচিত ওই দিনটি তে ধুমধাম করে মায়ের পুজো করা হয়। দূর -দূরান্ত থেকে আসে ভক্তরা। অনেকে মায়ের কাছে মানত করে যান তারাও আসেন ওই দিনটিতে। এছাড়াও পিরি পরিবারের যে যেখানেই থাকুক না কেন এই সময় বাড়িতে ফিরে আসবেই৷ সারা রাত ধরে চলে পুজো পাঠ৷ চলে খাওয়া দাওয়া হৈ-হুল্লোড়। দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে চলা এই পুজো শুধু পিরি পরিবারের নয় হয়ে উঠেছে এলাকার পুজো। তবে এবার সেসব কিছুই হচ্ছে না করোনার আবহে। শুধু পরিবারের নিয়ম মেনে পুজো হবে। তবে যে সমস্ত ভক্ত মায়ের পুজো দিতে আসবেন তাদের প্রত্যেক কে অবশ্যই মাস্ক পরে মন্ডপে আসতে হবে। আর এবার মায়ের কাছে একটাই প্রার্থনা সকলের বিশ্বের এই অচলাবস্থা দুর করে আবার আগের অবস্থায় যেন বিশ্বকে ফিরিয়ে দেন।

পিরি পরিবারের এক সদস্যা সোনালী দে বিবাহ সূত্রে থাকেন সুদূর পাঞ্জাবে। যত কষ্টই হোক প্রতিবছর এই সময় তিনি আসনেই, কোনো বছর বাদ যায় না। তবে এবার তিনি আসছেন না৷ আক্ষেপ করে সোনালী দেবী বলেন, “করোনার কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু উৎসব বাড়িতে তা পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই এবার যাচ্ছিনা। তবে মায়ের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন পৃথিবী কে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেন তাড়াতাড়ি”।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here