নিজস্ব সংবাদদাতা,দক্ষিণ দিনাজপুরঃ
ইতিহাসকে ঘিরেই কুসংস্কার। আর সেই কুসংস্কারে বিশ্বাসী হয়ে এখন পর্যন্ত কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে কেউই ঘুমান না দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর ব্লকের বেলবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের পীরপাল গ্রামের গ্রামবাসীরা। কাঠের নয় মাটিরই তৈরি খাটে অথবা মাটিতে ঘুমান গ্রামবাসীরা।
এলাকার গ্রামবাসী ও ইতিহাসবিদের মুখে শোনা যায় ১৭০৭ সালে পীরপালের মাটিতে ইখতিয়ার উদ্দীন বিন মোহম্মদ বখতিয়ার খলজীর দেহ সমাধিস্থ করা হয়। এর পর তিনি দেবতা পীর রূপে আবির্ভূত হন বলে বিশ্বাস গ্রামবাসীদের। বীর যোদ্ধাকে মাটিতে সমাধিস্থ করার পর থেকে গ্রামবাসীরা কাঠের তৈরি খাটে বা চৌকিতে ঘুমালে তাদের স্বপ্নাদেশে মেরে ফেলার ভয় দেখানো হত। এই ভয়ে বিগত কয়েকশো বছর থেকে পীরপালের গ্রামের মানুষ কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে ঘুমান না। আর কেউ যদি কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে ঘুমান তাহলে সেই পরিবারের সকলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনটাই মত গ্রামবাসীদের।
তবে ইতিহাসবিদের দাবী, বখতিয়ার খলজীকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য গ্রামবাসীরা মাটিতে ঘুমান। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর, তপন, হরিরামপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গঙ্গারামপুর এলাকার পীরপাল অন্যতম। জেলার ইতিহাসবিদ ও স্থানীয় গ্রামবাসীদের মুখে শোনা গেছে ১৭০৭ সালে সুলতানি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে বখতিয়ার খলজী পাল বংশের লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে সংগ্রামপুর, দেবী কোর্ট সহ গোটা গৌড় দখল করে নেন। লক্ষ্মণ সেন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে তৎকালীন বঙ্গে পালিয়ে যান এবং তার সৈন্যরা পরাজিত হয়ে নদীয়া জেলা পর্যন্ত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
আরও পড়ুনঃ ফালাকাটায় ফের হাতির হানা, সংকটে ১৫ পরিবার
অন্য দিকে এরপর বখতিয়ার খলজী তিব্বত ও কামরূপ অভিযানে যান। সেখানে বিফল হয়ে বখতিয়ার খলজী দেবীকোটে ফিরে আসেন। তিব্বত অভিযান বিফল এবং সৈন্যবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতির ফলে লখনৌতির মুসলিম রাজ্যের প্রজাদের মধ্যে বিদ্রোহ ও বিরোধ দেখা দিতে শুরু করে। এরই ফলে বাংলার ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলো দিল্লির সাথে সম্ভাব্য বিরোধে আগে থেকেই কোনঠাসা হয়ে পড়ে। এরকম নানাবিধ চিন্তা, এবং পরাজয়ের গ্লানিতে বখতিয়ার খলজি প্রচন্ড ভাবে অসুস্থ ও শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এর অল্প কিছুদিন বাদে বাংলার ১২০৬ বঙ্গাব্দে ও ইংরেজীর ১৭০৭ খ্রীষ্টাব্দে তিনি শয্যাশায়ী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
কেউ কেউ অনুমান করেন যে বখতিয়ার খলজীর মৃত্যুর পিছনে তার প্রধান সেনাপতি আলীমর্দান খলজীর হাত ছিল। এরপর বখতিয়ারের মৃতদেহ পীরপালে সমাধিস্থ করা হয়।যেহেতু তিনি বীর যোদ্ধা ছিলেন তাই তিনি ভগবান পীর রূপে আবির্ভূত হন বলে গ্রামবাসীদের মত। তার পর থেকে এলাকার বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ কাঠের তৈরি চৌকিতে বা খাটে ঘুমান না। গ্রামবাসী মঙ্গল রায় জানান – “চৌকি বা খাটে ঘুমালে স্বপ্নাদেশে তাদের ভয় দেখানো হয়। বাপ-ঠাকুর্দার সময় থেকে তারা গল্প শুনে আসছে রাতে চৌকি বা খাটে শুলে স্বপ্নে ঘোড়া ছোটার আওয়াজ পাওয়া যায়। আর এরপর সেই পরিবারের সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই তারা কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে ঘুমান না বা কাউকে ঘুমাতে দেন না”।
তবে এই বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন জেলার ইতিহাসবিদ সুমিত ঘোষ। তিনি বলেন , “বখতিয়ার খলজী যেহেতু বীর যোদ্ধা ছিলেন তাই তাকে সম্মান জানাতেই পীরপালের মানুষ মাটিতে ঘুমায়। তবে ওই এলাকার মানুষের মধ্যে কিছু কুসংস্কার আছে। যেহেতু বীর যোদ্ধা বখতিয়ার খলজী পীরপালের মাটিতে শায়িত আছেন তাই গ্রামবাসীরা কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে ঘুমান না।”এই বিষয়ে পীরপালের বয়স্ক এক গ্রামবাসী রাজেন রায় বলেন, “কয়েকশো বছর আগে থেকে এই গ্রামের মানুষ মাটিতে ঘুমায়।
আরও পড়ুনঃ এগরায় বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন
কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে কেউ ঘুমায় না।” বখতিয়ার খলজীকে পীর বাবা মানার কারণে গ্রামের বয়স্করা আজও মাটির তৈরি “উঁচু ঢিপি বা খাটে” ঘুমায় । বিজ্ঞানের যুগে এমন ঘটনাকে বাহিরের দুনিয়া কুসংস্কার বললেও পীরপাল গ্রামের মানুষ ভয়ে বা শ্রদ্ধায় বংশ পরম্পরায় মেনে চলেছে এই প্রথা ।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584