নবনীতা দত্তগুপ্ত, বিনোদন ডেস্কঃ
“ট্রান্স জেন্ডারদের পর্দায় দেখলেই দর্শক চ্যানেল ঘুরিয়ে দিচ্ছে, তাই বন্ধ হবে ফিরকি।এমন কথাই চ্যানেলের তরফে জানানো হয় আমাদের। তাহলে গত সপ্তাহের টি আর পি রেট ৬.৪ হল কীভাবে? অঙ্ক মিলছে না। ফিরকি বন্ধ হচ্ছে জানার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় দর্শকের রি- অ্যাকশনের সঙ্গেও চ্যানেলের কথার মিল পাচ্ছি না…”- দাবি ‘ফিরকি’ ধারাবাহিকের মুখ্য চরিত্রাভিনেত্রী লক্ষ্মী ওরফে আর্যা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
এক ট্রান্স জেন্ডার মা ও তার পালিত মেয়ে ফিরকিকে কেন্দ্রে রেখে শুরু হয় ধারাবাহিক ‘ফিরকি’৷ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও সমাজে রয়েছে সমান সম্মান- এই বার্তা দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়া ছিল উদেশ্য। তাই এক তৃতীয় লিঙ্গের চরিত্রকে রাখা হয় গল্পের ভিত হিসেবে৷ সে লক্ষ্মী৷ এই চরিত্রে অভিনয় করছিলেন আর্যা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ্ঞে হ্যাঁ, ‘করছিলেন’ শব্দটা বলতে হয় আর্যার কথার উপর ভিত্তি করেই।
আর্যা জানান- “লক্ষ্মীর মৃত্যু হয়েছে সেদিন, যেদিন হঠাতই সিরিয়ালের শুটিং বন্ধ করার নির্দেশ আসে চ্যানেলের তরফে। এই ধারাবাহিকের প্রথম প্রোমো এতটাই লাইক, শেয়ার পায় যে চ্যানেল দ্বিতীয় প্রোমো আনতে সাহস পায় না। যদি আগের প্রোমোর মতো ভিউ আর না হয়।… ”
আর্যা আরও জানান- “একজন মেইন স্ট্রিমের মানুষ হয়ে একজন ট্রান্সজেন্ডারের চরিত্রে অভিনয় করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল আমার পক্ষে। বিধান দা এবং সৌমেন দা না থাকলে পারতাম না লক্ষ্মী হয়ে উঠতে। আর ধন্যবাদ জানাই স্নিগ্ধা দি ও তাঁর ‘অ্যাক্রোপলিশ’-কে।
আজ যতটুকু মানুষ আমাকে চিনেছে তার পিছনে স্নিগ্ধা দি’র অবদান সবটুকু। লক্ষ্মীর মাধ্যমে নিজের অন্যদিক আবিষ্কার করেছি আমি। বাংলা সিরিয়ালে ট্রান্স জেন্ডারদের নিয়ে গল্প ফাঁদার সাহস স্নিগ্ধা দি’ই বোধ করি প্রথম দেখালেন। সাধারণত এদের নিয়ে গল্প কেউ বলে না বা বলতে চায় না। এদের জীবনের যন্ত্রণাও তাই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয় না।
আমি তো বটেই সুজি (রানি) এবং কুসুম (পার্বতী)ও সমানভাবে কৃতজ্ঞ দিদির কাছে। দিদি অনেক চেষ্টা করেছিলেন ফিরকিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু চ্যানেল কোনও না কোনও কারণে শুরুর দিন থেকেই সিরিয়ালটাকে কোণঠাসা করেছে। হয়ত বন্ধ করার পরিকল্পনা ছিল। দর্শক চ্যানেল ঘুরিয়ে দিচ্ছে- এই কথাটা মানতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ কষ্ট পেয়েছেন এটা শুনে যে ফিরকি বন্ধ হতে চলেছে। সোশ্যাল মিডিয়া তার বড় প্রমাণ দিচ্ছে গতকাল থেকে।”
আরও পড়ুনঃ “আমাদের জন্য বন্ধ হচ্ছে ফিরকি, সমান সম্মান পেতে গিয়ে অপবাদ কুড়োলাম”- সুজি, কুসুম
‘ফিরকি’ আর্যার প্রথম বাংলা ধারাবাহিক। মুম্বই থেকে এসেছিলেন টলিউডে কাজ করতে এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে। ‘ফিরকি’ তাঁকে অনেককিছু দিয়েছে। রানি, পার্বতীদের মতো বন্ধু উপহার দিয়েছে। স্নিগ্ধা বসুর মতো প্রযোজকের সান্নিধ্যে আসতে দিয়েছে। আর দিয়েছে মানুষের ভালোবাসা। ফিরকি তাঁর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে চিরকাল। ভেজা চোখে এমন সব কথা নিজেই বললেন আর্যা।
পাশাপাশি ছিল একগুচ্ছ খারাপ লাগা আর ক্ষোভের আগুন। কী রকম? আর্যা জানান- “ধারাবাহিকের নাম ‘ফিরকি’ হলেও মুখ্য চরিত্র লক্ষ্মী। কেননা ট্রান্স জেন্ডারদের জীবন এই ধারাবাহিকের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে ফিরকি মেয়েটি উপলক্ষমাত্র। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্রেক কার্ড থেকে লক্ষ্মীর ছবি সরিয়ে ফেলা হয়। রাখা হয় ফিরকি আর নীলাদ্রির ছবি।
এটা শুধু লক্ষ্মী বা আর্যার অপমান নয়, গোটা ট্রান্স জেন্ডার কমিউনিটির অপমান বলে মনে করি আমি। ওদের সম্প্রদায়কে রিপ্রেজেন্ট করছিলাম আমি। একইভাবে বলতে পারি, এহেন কাজ সিরিয়ালটির মূল ভাবনা থেকে চ্যানেলের এক প্রকার সরে যাওয়া। ট্রান্স জেন্ডারদের কেন্দ্রে রেখে ধারাবাহিক– এমন কথা সামনে এনে বা সহজ কথায় টোপ হিসেবে রেখে ধারাবাহিকটি শুরু করে পরে সেই ফ্যামিলি ড্রামায় ঢুকে পড়ছিল ধারাবাহিক।
ব্রেক কার্ড থেকে মুখ্য চরিত্রের ছবি সরিয়ে নেওয়া যায় বুঝি? পুজোর বৈঠকে ‘ফিরকি’ থেকে আমি, সম্প্রীতি আর সায়ন যাই। প্রশ্ন ওদের দিকেই যাচ্ছিল। সঞ্চালক সুদীপা চ্যাটার্জি আমাকে কোনও প্রশ্ন তো করেনইনি, এমনকী আমার ইন্ট্রোডাকশনও দেননি অনস্ক্রিনে। কেমন যেন তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের নজরে দেখছিলেন আমায়। আমি মনে করি ওই বৈঠকে আমার জায়গায় সুজি বা কুসুমের যাওয়া উচিত ছিল। কারণ ওদের কমিউনিটিউর গল্প উঠে আসছে ধারাবাহিকে৷
আরও পড়ুনঃ দুঃস্থ যুবকের চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন সাংসদ মিমি
শুনলে অবাক হবে, আজ অবধি একটা লাইভও করা হয়নি লক্ষ্মীদের নিয়ে। জি বাংলার জন্মদিনের কেক আসেনি লক্ষ্মী, রানিদের সেটে। সেটা কাটা হয়েছে ফিরকির শ্বশুরবাড়ির সেটে। এভাবে ব্রাত্য থেকেছি আমরা। শুরু থেকে। কিন্তু কেন? তা হলে সিরিয়ালটা শুরু হল কেন? ”
আর্যার কথায় চিন্তার সুর শোনা গেল। সে সুজি, কুসুমদের নিয়ে বেশ চিন্তিত। তাঁর কথায়- “আমি যখন কলকাতায় নিজের কেরিয়ার গড়তে আসি তখন ভাবি, খুব কঠিন লড়াইয়ে ঝাঁপ দিলাম। তবে এখন আমি বুঝেছি আমার লড়াইটা অনেক কম সুজি, কুসুমের থেকে। আমি কাজ পেলেও পেতে পারি৷ কাজ চলছেও কয়েকটা।
অন্যান্যরাও ঠিক আজ বাদে কাল কাজে ফিরবে৷ কিন্তু সুজিদের কে কাজ দেবে? কী করবে ওরা? স্নিগ্ধা দি’র মতো মানুষ ক’জন আছে পৃথিবীতে? একটা চ্যানেল যখন রিপোর্ট জানায় যে ট্রান্স জেন্ডারদের জন্য ধারাবাহিক জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে তখন কেউ কি আর ওদের নিয়ে গল্প ভাববে বা ওদের দিয়ে অভিনয় করাবে? তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? সমান সম্মান কি পেল ওরা? আমি চ্যানেলের কাছে জবাব চাই। কিছু এবার বলুক ওরা। সমীক্ষার রিপোর্ট দেখাক যে ফিরকি লোকে দেখছে না, লক্ষ্মী, রানিদের দেখে লোকে চ্যানেল ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
শুরুর দিন থেকে আমায় দিয়ে নানারকমের হার্ড ওয়ার্ক করিয়ে টি আর পি বাড়ানোর প্রচেষ্টা ছিল চ্যানেলের৷ রাত তিনটের সময়েও কাজ করেছি। শীতের রাতে নৌকা থেকে জলে ঝাঁপ দেওয়ার সিনও করেছি। কাঁচে পা কেটে গেছে। তোয়াক্কা করিনি। বিধান দা গান চালিয়ে আমার মুড আনতেন। যাতে কাজটা চোখে পড়ার মতো হয়। এত কিছুর পরেও আমায় বারবার কোণঠাসা করা হয়।
তবে, সৌমেন দা আর বিধান দা’র কাছে যা শিখেছি তা ভাঙিয়ে চলবে আমার অনেকটা পথ। নিজের মতো করে মোনোলগ যোগ করতাম। ওঁরা সেটা গ্রহণ করতেন। কাজ করতে গিয়ে অনেক স্বাধীনতা পেয়েছি। প্রথম দিকে লক্ষ্মী হয়ে উঠতে বেশ অসুবিধায় পড়ি। বিধান দা, সৌমেন দা কোনও চাপ সৃষ্টি করেননি আমার উপর।
আমাকে আমার মতো করে বলতে দিতেন।কণ্ঠস্বর পালটে আমায় কথা বলতে হত৷ ওটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ আর বড় টাস্ক ছিল আমার জন্য। এগুলো আমার মনে থাকবে চিরকাল। দু-তিন মাসের মধ্যে আমি কলকাতা ছাড়ছি। আমার মালয়ালম ছবির আরেকটু কাজ বাকি আছে। ওটা সারতে যাব। ফিরকি টিমকে ভুলব না কোনওদিন। অনেক ভাল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে কলকাতা ছাড়ছি। আরও ভাল লাগত যদি এভাবে মাঝপথে ফিরকি থেমে না যেত। আর অন্যায়ভাবে লক্ষ্মী, রানি, পার্বতীদের ব্রাত্য না করে দেওয়া হত।”
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584