শুভশ্রী মৈত্র
বিজেপি শাসিত অসমে সদ্যগঠিত রাইজোর দলের একমাত্র বিধায়ক অখিল গগৈ। শিবসাগর কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত তিনি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে দেশদ্রোহিতার মামলায় জেলবন্দি থাকার পর অবশেষে মুক্তি পেলেন গগৈ।
জেল থেকে বেরিয়েই জানিয়েছেন সিএএ বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। আবার একই সঙ্গে একথাও জানালেন কোন ‘বিদেশি’ অসমে স্থায়ী বাসিন্দা হতে চাইলে তা বরদাস্ত করা হবে না। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা জরুরি, এনআরসি সম্পর্কে একটি শব্দও খরচ করলেন না তিনি, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে তবে কি এনআরসি-তে আপত্তি নেই অখিলের?
গগৈ জেলবন্দি থাকাকালে তাঁর স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন বহু মানুষ, বহু মানবাধিকার সংগঠন। এখন মূল প্রশ্ন নিজের স্বাধীনতার বিনিময়ে গগৈ কি জাতি, ধর্ম, ভাষা নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের স্বাধীনভাবে এদেশে থাকার অধিকারের মর্ম বুঝলেন নাকি মানলেন! বোধহয় না। কারণ জেল থেকে বেরিয়েই জনসমক্ষে প্রথম যে বক্তব্য তিনি রাখলেন তা কিন্তু কিছুটা হুমকির সুরেই বাজলো অসমের ‘বাঙালি’ বিশেষত ‘বাঙালি মুসলমান’-দের কানে, ঠিক যে হুমকি তাঁরা মোদি-শাহের মুখে শুনে আসছেন বিগত সাত বছর ধরে।
অসমে দীর্ঘকালীন বাঙালি বিদ্বেষ, একাধিকবার বাঙালিদের বিরুদ্ধে জাতিদাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছেন অসমের বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমান সকলেই। তার মধ্যে বাংলাভাষী মুসলমানরা নিজেদের সম্পর্কে ‘বিদেশি’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ এইসব শব্দগুলি শুনতে শুনতেই কয়েক প্রজন্ম কাটিয়ে ফেলেছেন অর্থাৎ তাঁরা যে ভারতীয় এটা কিন্তু মোটেই স্বতঃসিদ্ধ নয়, প্রমাণ সাপেক্ষ- শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এই সত্যিই তাঁরা জীবনভর দেখে চলেছেন। সেখানে অখিলের বক্তব্য আর এক পরত হুঁশিয়ারি যোগ করলো বলা যায়। গত ছয় বছর যাবৎ অসমে বাংলাভাষী মুসলমানদের জীবন এমনিতেই জর্জরিত যদিও কখনোই তাঁদের পক্ষে প্রকৃত ভারতীয় হয়ে অসমে বাস করা কোনদিনই সহজ ছিলনা।
আরও পড়ুনঃ ঘুষ দেওয়ার সামর্থ্য নেই, যোগী রাজ্যে ৭৫ দিন মর্গে পড়ে রইল কোভিড মৃতদেহ
অসমীয়া জাতীয়তাবোধের এত ধরণের ভাগাভাগির সঙ্গে মানিয়ে চলা মোটেই সহজ নয়। আর তাছাড়া অসমের একাধিক জাতিদাঙ্গা বারেবারে প্রমাণ করেছে তাদের অন্তর্নিহিত মুসলমান বিদ্বেষ, বাঙালি বিদ্বেষ। আপাত ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ কিছু শব্দ, যেমন ‘বিদেশি’ , ‘দেশীয়’ ইত্যাদি ব্যবহার করে একাধিক রাজনৈতিক নেতা চেষ্টা করেন তাদের মুসলমান বিরোধী ধ্যান ধারণা এবং অযথা বৈদেশিক আতংকের ভুত দেখা রাজনীতিকে( Xenophobic) আড়াল করতে, সেই একই প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছে অখিল গগৈয়ের মধ্যেও।
এমনকি তার যথেষ্ট প্রমাণও গগৈ রেখেছেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারে। ক্রমাগত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট কে আক্রমণ করে গেছেন তথাকথিত ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ শব্দ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কথা বলেছেন হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ টেনে। এপ্রসঙ্গে আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, বদরুদ্দীন আজমলের অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট কে আগাগোড়া বিরোধিতা করেছেন অখিল গগৈ। তাঁর দাবি ছিল বদরুদ্দিনের দল মুসলিম মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক একটি দল।
আরও পড়ুনঃ ‘অব্যাহতি দেবেন না’, শীর্ষ আদালতে রামদেবের আবেদনকে চ্যালেঞ্জ DMA-এর
যদিও নিজে বিলক্ষণ জানতেন যে এই অভিযোগ সত্যি নয় কিন্তু এই দাবি যে সংখ্যা গরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের কাছে খুবই তৃপ্তিদায়ক! তাকে কি করে অস্বীকার করেন তিনি! হীরেন গোহাই, অসমের এক প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী যিনি বর্তমানে অখিল এবং তাঁর দল রাইজোর পার্টির সঙ্গে কার্যত সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছেন, এক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুক্ত কণ্ঠে জানিয়েছেন যে রাইজোর দল এখন বদরুদ্দিনের দল সম্পর্কে বিজেপির শেখানো কিছু মিথ্যে বুলি আওড়াচ্ছে।
বিগত সাত বছর অসমে বসবাসকারী বাংলাভাষী মুসলমানদের জন্য যে কি যন্ত্রণার তা না দেখলে অনুভব করা সহজ নয়। কিন্তু পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে হিমন্ত বিশ্বশর্মা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর। যেকোন ক্ষেত্রে মুসলমানদের নিশানা করা তাঁর নিত্যদিনের কাজ বলা যেতে পারে। সহজ কথায় এনআরসি র মাধ্যমে বাংলাভাষী মুসলমান মুক্ত অসম তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু সত্যিই কি তা করতে পারবেন তিনি? উত্তর হলো ‘না’-কোনদিনই যে তা সম্ভব নয় সে তিনি ভালোই জানেন।
আরও পড়ুনঃ মনোরঞ্জন ব্যাপারী একা নন, রাজ্য সরকারের অনেক বিধায়কই কাজ করতে পারেন নাঃ লকেট
এবার আসা যাক মূল বিশ্লেষণে : প্রকৃত পক্ষে অসম ভুগছে ‘আত্মপ্রতারণা’য়। সব বাংলাভাষী মানেই বাংলাদেশী, সকলকে ধরে ধরে সরকার বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে এমন কল্পনায় বিভোর অসম; কিন্তু না, তা অসম্ভব। যাঁরা সত্যিই বাংলাদেশি তাঁদেরও যে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয় তা সকলের থেকে ভালো জানে সরকার। তাহলে কেন এই নাটক? সহজ বাংলায় তাঁদের সর্বদা ভয়ে রাখা, আতঙ্কে রাখা। শুধু এই একটি কারণেই নয় আরো একটি বড় কারণ হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ অসমীয়াদের মনে সর্বদা এক বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে রাখা, যে আমাদের সব সম্পদ এরা অন্য দেশ থেকে এসে ভোগ করছে, যা আসলে অসমিয়াদের প্রাপ্য।
কিন্তু কে ঠিক করে দেবে যে কে আসল অসমীয়া? আসল সত্য নিয়ে মুখ খোলেন না কোন রাজনৈতিক নেতা বা কোন বুদ্ধিজীবীই। সকলেই কিন্তু বিলক্ষণ জানেন এই ‘আসল অসমীয়া’ উদ্বেগ কেন জিইয়ে রাখা হচ্ছে। কারণ এই আতঙ্কের লভ্যাংশ ঘরে তোলে সব রাজনৈতিক দলই। অখিল গগৈ ও তার বাইরে নন। দেশদ্রোহিতার মামলায় জেলে থেকেও তিনি কি বুঝবেন আদৌ যে স্বাধীনতার অধিকার মানে জাতি ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতার অধিকার!
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584