বিদ্যুৎ মৈত্র, নিউজ ফ্রন্ট: চলে গেলেন বাম আমলের প্রথম অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র।মঙ্গলবার সকাল ৯.১৫মিনিটে একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে তাঁর মৃত্যু হয়।রাজ্য জুড়ে প্রিয়জন হারাবার যন্ত্রণা অনুভূত হয় সোস্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই। খুব স্বাভাবিক। বর্তমানে রাজ্য এবং কেন্দ্র যে দিকেই তাকানো যাক না কেন বিদগ্ধ রাজনীতিকের বড় অভাব ।সেইদিক থেকে উনি ছিলেন বর্তমান রাজনীতিকদের অভিভাবক তুল্য। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি তো বটেই।ব্যক্তি অশোক মিত্র কে নিয়ে আজ এবং আগামী দিনগুলোয় আলোচনা চলবে তারপর আর এক প্রসঙ্গ এসে ঢেকে দেবে এ প্রসঙ্গ ও। সেই প্রসঙ্গের ভেতর থাকতেই এ লেখার সুত্রপাত। এখন প্রশ্ন হল কে এই অশোক মিত্র? একজন রাজনীতিবিদ? একজন সাহিত্যিক? একজন অর্থনীতিবিদ? একজন প্রাক্তন মন্ত্রী? একজন স্পষ্ট বক্তা? কোনটা? উত্তর আসবে এর সবগুলিই উনি। উপরন্তু একজন উন্নতমানের গ্রন্থ সমালোচক ও উনি। এ প্রসঙ্গে “পুরানো আখরগুলি” দ্রষ্ট্রব্য। ১লা মে ২০১৮তে ওনার অন্তিম যাত্রার সময় উনি ৯০বছর অতিক্রম করেছেন। এই অশোক মিত্র যখন থেকে অশোক মিত্র হলেন তখন উনি ৫৮। কারণ তাঁর এই বয়সেই রাজ্যের মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করছেন বাম আমলের প্রথম অর্থমন্ত্রী। আর মানুষজন বিতর্ক ভালোবাসে।
ফলে ১৯৬৮ তে অসাধারণ গদ্য “কবিতা থেকে মিছিলে” লিখে ফেলা সাহিত্যিক কে তখন চিনতে পারেনি বাঙালী। যেমন চিনতে পারে নি সেই অশোক বাবুকে, যিনি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছিলেন সরকারি উচ্চপদের চাকরি। মার্ক্সবাদ যাকে টেনে এনেছিল বামদলের বড় শরিক সিপি(আই)এম-এ। ততদিন অশোকবাবুকে জ্যোতিবাবুর দলের একজন উচ্চশিক্ষিত কমরেড বলেই মানুষ জানতেন, চিনতেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো। এটাই তো সহজাত বাঙালি। যেহেতু ১৯৭৭এ বাম সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে দীর্ঘ অরাজকতা কাটিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখাবে বলে। আর তার দশবছরের মাথায় একজন মন্ত্রী বলা ভালো ঠোঁটকাটা মন্ত্রী তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধের জন্য মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করছেন সুতরাং এটা চায়ে পে চর্চা তো বটেই। ফলে তিনি মানুষের কাছে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যান বিতর্কিত তকমা নিয়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের স্বপ্ন দেখার দিনগুলোয় গুটিকতক সুড়সুড়ি দেওয়া মানুষের প্ররোচনায়। অথচ তার আগে বামজমানায় ভূমিসংস্কারে ঊল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে ছিলেন তিনি। সেটা কিন্তু চায়ের ঠেকে চর্চিত হয় নি বলেই শুনি আমরা। এই আমরা কারা? যারা সেসময় জন্মাইনি কিংবা জন্মেছি এক আধ বছর। তারা। এরপর আমরা বড় হলাম। স্কুলে পড়তে পাঠালো আমাদের মা বাবারা। তারা কিন্তু আজকের বাচ্চাদের মত প্রাথমিকে ইংরাজী শিখতে পারলাম না। তারা প্রথম ইংরেজি শিখলাম ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে। তখন জন্মের একযুগ পার হয়ে গিয়েছে।অশোক বাবু ও সংসদীয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। তখন কিন্তু উনি রাজ্যবাসীর কাছে সাদাকে সাদা কালো কে কালো বলবার মানুষ হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন।সময় সুযোগ মত “কবিতা থেকে মিছিলে” প্রবন্ধের মতো চোখা চোখা ডায়ালোগ না দিলেও সেগুলোতে কিন্তু বাউন্ডারি হাঁকাচ্ছেন।আমরা সবটা না বুঝলেও বুঝছি। অল্প অল্প করে খেয়াল রাখতে রাখতে আমরা যেদিন যুবক হলাম সেদিন ও অশোক বাবু হাতে কলম তুলে নিয়ে অনায়াসে সব্যসাচীর মত বাংলা ও ইংরাজীতে দৈনীক পত্রপত্রিকায় ঝড় তুলছেন। যা পড়ে তার উত্তর দিতে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে ওনার আমৃত্যু ভালোবাসার দলের কমরেডদের। আর আমরা ওনার বাংলা লেখাটার পাঠোদ্ধার কষ্টেসিষ্টে করতে পারলেও ইংরাজি লেখা গুলো পড়তে গিয়ে পালিয়ে আসছি বিদেশী শব্দ গুলো দেখে।কেন জানেন? আমরা শিখতে পারি নি ইংরেজী পড়া, ওনার সিদ্ধান্তের কারণেই। ১৯৮২ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতায় এল তখন উনি অর্থদপ্তরের পাশাপাশি শিক্ষা কমিশনের দায়িত্ব পান। সেই অশোক বাবুর সুপারিশে মাতৃভাষায় শিক্ষা দিতে গিয়ে প্রাথমিকে ইংরাজী তুলে দিল রাজ্য সরকার। ইংরাজী তুলে দিলে যে একদিক পঙ্গু হয়ে যায় সেটা একবার ও সেসময় ভাবেন নি মাষ্টারমশাই। পরবর্তীতে যখন আবার ইংরাজীকে ফিরিয়ে আনলো বাম সরকার তখন কিন্তু সর্বনাশ যা হবার হয়ে গিয়েছে। কৈ তা নিয়ে তো কোথাও ওনার ঠোঁটকাটা কথা শুনি নি? তাহলে কি উনি ঠোঁটকাটা ছিলেন না রাগী ছিলেন? বাজারি কাগজ গুলো ওনাকে বিক্রি করে নি তো পরোক্ষে? কি জানি? আমরা তো নভীস।আমরা কিন্তু ওনার দলের শাসন ক্ষমতা চলে যাওয়ার আগে আগে বাংলা দৈনীক গুলোয় প্রকাশিত লেখা গুলো পড়ে বামশাসনকেই গালাগালি দিতে শিখছি।উনি বলছেন মানেই ঠিক বলছেন এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করছি। আবার মনটা খুঁত খুঁত ও করছে ইংরাজী শিখতে দেন নি বলে। এই করতে করতে রাজ্যে যখন লাল নিশান মাথা নোয়ালো কমরেড অশোক মিত্র ও কষ্ট পেলেন সব সৎ কমরেডদের মতোই। কিন্তু আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না বর্ষীয়ান প্রাক্তন এই মন্ত্রী। ২০১৬ সালে বর্তমান শাসকদলের নেত্রীকে লক্ষ্য করে সরাসরি আক্রমণ করলেন। না সেদিনগুলোয় কিন্তু আপনার প্রতি গভীর আস্থা ছিল যে মানুষগুলোর তারা কিন্তু অশোকবাবুকে স্পষ্টবক্তা হিসেবে চিহ্নিত করলেন না, লেখায় তার শব্দ চয়নের জন্য তিনি চিহ্নিত হলেন পক্ষপাত দুষ্ট লেখক হিসেবে। হয়ত কেন, সেদিন অনেকের মনের কথাই তিনি লিখেছেন। কিন্তু ওনার মতো এতবড় শিক্ষাবিদের কলমের ডগায় এত ভোঁতা শব্দ কেন? প্রশ্ন তুললো রাজ্যের শিক্ষিত যুবক যুবতী।কেউ কেউ বললেন ওনার কথামতো উনি ভদ্রলোক ছিলেন না বলেই হয়ত এভাবে লিখেছিলেন (“আমি ভদ্রলোক নই, কমিউনিষ্ট” স্মর্তব্য)। না কি দলের সাথে “নেমক হারামি” করবেন না বলে দলকে সন্তুষ্ট রাখতে উল্টো কলম ধরলেন? কোনটা ? আসলে এই ধরনের লেখায় বিক্রি বাটা বাড়ে কাগজের। তারপর সেটা যদি বহুল প্রচারিত হয় ও আর লেখক যদি অশোক মিত্র হন, তাহলে তো কথাই নেই। হয়ত সেই ফাঁদেই পা দিয়েছিলেন “আপিলা চাপিলা”র স্রষ্টা। তবে যাই হোক, যত সমালোচনাই হোক না কেন অশোক বাবু মনেপ্রাণে একজন কমিউনিস্ট ছিলেন। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে উনি আসলে কি ছিলেন? সাহিত্য রস যার লেখায় তিনি সাহিত্যিক তো বটেই। কিন্তু যে খেলোয়াড় ক্যাপ্টেনের সঙ্গে মনোমালিন্যের জন্য দল ছেড়ে চলে যায় তাকে খেলোয়ার বলা যায় কি? বিভিন্ন বিষয়ের অগাধ পান্ডিত্য যার তিনি আর যাই হোক জনগণের নেতা হয়ে উঠতে পারেন নি। তাত্বিক নেতা ছিলেন। লড়াই করে টিকে থাকবার মতো নেতা তিনি ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন আলিমুদ্দিনের নেতারা “সর্বভারতীয় রাজনৈতীক দলের স্বামী হারানো মহিলা নেত্রীর (তাঁর লেখা মতো)” সাথে যেন বিধানসভা ভোটে জোট করে। জোট হয়েছিল। কিন্তু তাঁর দল বিধানসভায় বিরোধী দলের তকমা হারিয়েছিল। সেই পরিণতি চোখের সামনে জ্ঞানত দেখে গেলেন কমরেড মিত্র। এটাও শুনে গেলেন তার এই মতের বাংলা লাইন হায়দ্রাবাদে সদ্য সমাপ্ত পার্টি কংগ্রেস, নির্বাচন প্রেক্ষিত জোটের পক্ষে মত দিয়েছে। তাই জোট হবে। কোনদিন হয়ত ক্ষমতাও পাবে। কিন্তু মানুষের মিছিলে মানুষের মাঝে ৭৭ এর আগের মতো রোমাঞ্চকারি দল হিসেবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি সেই দল? সেই সংশয় নিয়েই বিদায় নিলেন ইন্দিরা জমানার মুখ্য অর্থনৈতীক উপদেষ্টা।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584