কলমে শ্রীমতী লপিতা সরকার
এবার বাজেটে মোদী সরকারের প্রধান বিজ্ঞাপন হলো বিপুল পরিকাঠামো নির্মাণে ব্যয় যাতে নাকি পঁচিশ বছর বাদে সুফল পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত বলে রাখি এই পরিকাঠামো তৈরির জন্য আগের বাজেটেও অর্থ বরাদ্দ ছিল। যদিও এবার তা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য শুনলাম না।
বাজেটের প্রধান প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক
পরিকাঠামো প্রসারের ক্ষেত্রে মূলধনী ব্যয় ধরা হয়েছে 1.75 লক্ষ কোটি টাকা। এই ব্যয় থেকে মূলত লাভ পাবে সরকারের হয়ে যেসব বেসরকারী সংস্থা বৃহত নির্মাণ কাজ করে, হাইওয়ে, সেতু, রেললাইন নির্মাণের কাজ হাতে গোণা কয়েকটি মাত্র সংস্থাই করে থাকে। এই কাজ করাতে গেলে যন্ত্রপাতির পাশাপাশি যেটুকু শ্রমের নিয়োগ হবে সেটুকুই প্রাপ্তি। তবে নির্মাণ শিল্পে কায়িক শ্রম যারা দেয় তারা মূলত অসংঘটিত ক্ষেত্র (informal sector) থেকেই আসে। এদের মজুরিখাতে নির্মাণ সংস্থাগুলোর খুব বেশি ব্যয় হবার কথা নয়। তবে অল্প সংখ্যক দক্ষ কর্মচারীর (যেমন structural engineer) বেতন বাড়বে। PM গতিশক্তি নামে যে প্রকল্প এসেছে তার মধ্যে অনেকাংশে এই পরিকাঠামো তৈরি করার ব্যাপারটাও এসে যাচ্ছে।
পরিবেশের উন্নতির কথা বলা হয়েছে । সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি করা হবে। সঠিক দিশা তবে নতুন নয়। অচরাচরিত উৎস থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করার দিকে আগের সরকারও উৎসাহ দেখিয়েছিলেন।
প্রায় চারশটি নতুন বন্দে ভারত এক্সপ্রেস চলবে। সম্ভবত এটাই হলো সরকারি ভাবে রেলে বেসরকারীকরণের সূত্রপাত। ভারতীয় রেলওয়ে হলো সাধারণ ও দরিদ্র জনগণের যাতায়াতের সবচেয়ে সহজ ও সুলভ উপায়। ঝকঝকে বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের টিকিট কাটার ক্ষমতা কি তাদের আদৌ থাকবে ? যাদের এই ক্রয় ক্ষমতা আছে তারা বেশিরভাগই আকাশপথে যাত্রা করতে পছন্দ করে।
অনেকগুলি পোস্টঅফিসকে প্রায় ব্যাঙ্কের সমমর্যাদা দেওয়া হল। এটা একটা ভালো পদক্ষেপ। বাজেট বক্তৃতায় উৎপাদিকা শক্তি বাড়ানো, আর্থিক উন্নতিতে সবাইকে সামিল করা এইসব ভালো ভালো কথা আছে। কিন্তু এর জন্য কি নীতি নেওয়া হবে তা স্পষ্ট করা হয়নি।
RBI digital টাকা প্রণয়ন করতে চলেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই ডিজিটাল মুদ্রা কাজ করে প্রায় সাধারণ মুদ্রার মতই, অর্থাৎ লেনদেন করা যায় ,সঞ্চয় করে রাখা যায়। আবার এই মুদ্রার বিনিময় মূল্য বাড়লে তা বিক্রি করে লাভ করা যায়। ভারতের যেসব গ্রাহক এই ধরণের ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে RBI প্রণীত ডিজিটাল মুদ্রার ক্ষেত্রে তাদের সঞ্চয়ের নিরাপত্তা থাকবে ।গোটা পৃথিবীতে এই প্রথম কোন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ডিজিটার মুদ্রা প্রণয়ন করল। অন্য ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনে লাভ করলে তার ওপর 30% হারে কর বসানো হয়েছে। এটাও ঠিক হয়েছে বলে মনে করি। কারণ আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষ এখনো ডিজিটাল মুদ্রায় সড়গড় নন। তাঁদের সঞ্চয় (যদি কিছু থাকে) এখনো পর্যন্ত ব্যাঙ্ক জমা (প্রধানত), শেয়ার কিম্বা গোল্ড বন্ডের মাধ্যমে। তবে ডিজিটাল মুদ্রা সবাই ব্যবহার করতে শুরু করলে ব্যাঙ্কগুলোর ভবিষ্যত কি হবে তা ভবিষ্যতই বলবে।
এবারের বাজেটে কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়নি। শুধু গঙ্গার তীরবর্তী পাঁচ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ হয়েছে। ড্রোন উড়িয়ে নজরদারি করা হবে এ বিষয়ে। ভারতে তৈরি কৃষি যন্ত্রাংশের ওপর কর বসেছে আর আমদানিকৃত কৃষি যন্ত্রাংশের ওপর কর কমেছে। এ হলো কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরির দেশীয় শিল্প পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবার পরিষ্কার ছক।
পরিকাঠামো নির্মাণে যা অন্যতম উপাদান সেই ইস্পাতের দাম বেড়েছে। ক্ষুদ্র ও গ্রামীণ শিল্প সম্পর্কে আশার কথা কিছু নেই। শুধু নতুন ব্যবসার (start-up) কিছু করছাড় আছে।
সামাজিক সুফল দেবার মতো প্রকল্পের (social welfare schemes) ক্ষেত্রে দেখছি যে শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বরাদ্দ বেড়েছে। মনে রাখতে হবে যে একই সঙ্গে একশ দিন কাজের মতো জনপ্রিয় প্রকল্পে সংস্থান কমানো হয়েছে।
করছাড় ও কর বসানোতে দিশাহীনতা প্রকট। মোটরগাড়ি শিল্প কয়েক বছর যাবত ধুঁকছে ,অথচ করছাড় দেওয়া হল হীরের গয়নায়। সাধারণ মানুষের ওপর আয়করভার কমল না অথচ কর্পোরেট রোজগারে কর কমল! প্যান্ডেমিকের বাজারে তো কিছু ব্যবসায়ী ধনকুবের হয়ে গেছে । তাদের ওপর বাড়তি কর নয় কেন?
সরকারি ক্ষেত্রের গুরুত্ব কমিয়ে বেসরকারিকরণের প্রবণতা কেন? (শিগগিরই LIC -র শেয়ার বিক্রি শুরু করবে সরকার)! সাধারণ মানুষের হাতে ক্রয়ক্ষমতা আসবে কি করে? চাহিদা না থাকলে উৎপাদন কমতে বাধ্য। কর্পোরেটের হাতে দেশের সম্পদ তুলে দিয়ে শেয়ার বাজার সাময়িক চাঙ্গা রাখা যায়। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে GDP র মূল্য বাড়িয়ে দেখানো যায়। কিন্তু আসলে তা এক বৃহৎ ফানুস মাত্র। এ ফানুস একদিন ফাটবেই। এই বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যা নিয়ে পশ্চিমী ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর অন্ধ অনুকরণ একদিন বিপর্যয় আনতে বাধ্য।সেইদিনের জন্য মহাপ্রভু সুড়ঙ্গপথ এবং নিজস্ব জেট প্লেনের ব্যবস্থা করে রেখেছেন!
[লেখক পরিচিতিঃ (প্রাক্তনী) প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা, অর্থনীতি বিভাগ
অবসরপ্রাপ্ত অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস কলেজ, কলকাতা। ]
(প্রতিবেদনের মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584