নবনীতা দত্তগুপ্ত, বিনোদন ডেস্কঃ
এই সময়ে দাঁড়িয়ে করোনা একাই ভিলেন, এমন কথা বলা ঠিক নয়। তার জেরে হওয়া লাগাতার লকডাউনের কারণে আজ অনেকেই কর্মহীন। বলা ভাল, কর্মহারা। কম সংখ্যক লোক দিয়ে বাড়িতে বসিয়ে কাজ টেনে নিয়ে যাওয়ার চক্করে কোম্পানি খারিজ করেছে অনেককেই। পেশা বদলেছেন অনেকে। তাতে কেউ কেউ কম বেশি ভাল আছেন হয়ত, তবে অধিক সংখ্যক মানুষ আছেন আর্থিক সংকটে।
লকডাউনের কারণে দফায় দফায় শুটিং বন্ধ হওয়ার খবর নতুন নয়। সিরিয়ালের শুটিং ৫০ জনের ইউনিট নিয়ে শুরু হলেও সেভাবে শুরু হয়নি সিনেমার শুটিং। বন্ধ প্রেক্ষাগৃহ। বন্ধ রঙ্গশালা। ফলে, থিয়েটার কর্মীরাও আজ নিদারুণ অর্থ সংকটে। যারা থিয়েটারের পাশাপাশি অন্য কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের ব্যাপার আলাদা। কিন্তু যারা কেবলই থিয়েটার কিংবা সিনেমায় কোনও পার্শ্বচরিত্র করে পেট চালায় তাদের জীবন আজ কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে তা বলাই বাহুল্য।
এমনই এক অভিনেতা শ্রীকান্ত মান্না। দীর্ঘ ২৫ বছরের অভিনয়জীবন তাঁর ৷ শ্রীকান্ত মান্না ‘সংস্তব’ নাট্য দলে নিয়মিত অভিনয় করছেন আজ ২৫ বছর। এছাড়াও বহু বাংলা ছবি, মেগা সিরিয়াল ও শর্ট ফিল্মে দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন রঙ্গশালায় আলো জ্বলছে না, পর্দা উঠছে না। একগুচ্ছ সামাজিক নিয়মবিধি মেনে ধারাবাহিকের কাজ শুরু হলেও সবাই সেখানে কাজ পাচ্ছেন না। জমানো টাকায় কতদিন? পেট তো কারো কথা শোনে না। সে গর্জে ওঠে খিদেয়। তাই পেটের দায়ে আজ মঞ্চ, শুটিং ফ্লোরের অপেক্ষা ছেড়ে মাছ নিয়ে বাজারে বসছেন অভিনেতা শ্রীকান্ত মান্না।
এক সময়ে মিঠুন চক্রবর্তী, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তীর, আবির চট্টোপাধ্যায়ের মতো তাবড় তাবড় অভিনেতার সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেছেন তিনি ৷ সংসার চলে অভিনয় থেকে উপার্জিত টাকাতেই। কিন্তু আজ কোথায় চরিত্র? কোথায় ফ্লোর? কেউ ডাকে না। অগত্যা পেটের দায়ে বেছে নিয়েছেন নতুন পেশা। অভিনেতা থেকে তিনি আজ মাছ বিক্রেতা। কোনও কাজকেই ছোট মনে করেন না তিনি।
নিউজ ফ্রন্টের তরফ থেকে তাঁকে ফোন করি। জানতে চাই ফ্লোর, মঞ্চ ছেড়ে এই পেশাতে। আফসোস হয় না? তিনি হাসি মাখানো কণ্ঠে জানান- “অভিনয় আমার মনের খিদে মেটায় আর মাছ বিক্রি আমার পেটের খিদে মেটাচ্ছে। দুটোই কাজ ৷ রকমটা আলাদা শুধু। প্রথম প্রথম যখন বাজারে বসতাম মুখ ঢেকে রাখতাম ভাল ভাবে, যাতে কেউ আমায় চিনতে না পারে। বাড়ি গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেক আপ হীন ‘আমি’কে দেখতাম। একদিন ভাবলাম, আজ যদি এরকম কোনও রোল আমাকে মঞ্চে বা অনস্ক্রিনে করতে হত, তখন যদি এরকম আমার লজ্জা লাগত কিংবা ইতস্তত করতাম তা হলে তো চরিত্রটা থেকে পরিচালক আমায় বাদ দিয়ে দিতেন। বের করে দিতেন ফ্লোর থেকে।
সেদিনের পর থেকে আর আমি লজ্জা পাই না। মাছ বিক্রি করছি বলে আমার কোনও লজ্জা নেই। আফসোসও নেই। কারণ আমার পেটের জ্বালা মিটছে আজ এই পেশাতেই। যখন কাজকর্ম হারালাম আর চলছিল না সংসার তখন ঠিক করেছিলাম এমন একটা রাস্তা বের করব যেটাতে আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারব। ২০২০ থেকে আজ অবধি যে দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা দিন কাটাচ্ছি তাতে অনেকেই পেশা বদলে অন্য চাকরি করছেন কেউ বা ব্যবসা করছেন।
আরও পড়ুনঃ ফ্লোরে ফিরছে অরিন্দম শীলের মহাশ্বেতা দেবী অনুপ্রাণিত ছবি ‘মহানন্দা’
আমি চাকরির চেষ্টা করিনি, কারণ আমি জানি একদিন না একদিন আবার চরিত্র মিলবে, মঞ্চের পর্দা উঠবে, সেদিনও আমি চাকরিটা ছাড়ব না। কারণ দুঃসময়ে যে কাজটা আমাকে অন্ন জোগাবে তাকে ছেড়ে দেওয়া মানে বেইমানি করা। কিন্তু যদি কোনও জায়গায় আমি চাকরিতে জয়েন করি তারা আমাকে বেশিক্ষণের জন্য বা বেশিদিন অভিনয়ের জন্য ছাড়বে না বা ছুটি দেবে না। তখন আমাকে যে কোনও একটা কাজ বেছে নিতে হবে। আবার আমি আমার নীতিবোধকেও বিসর্জন দিতে পারব না। তাই মাছ বিক্রি করার কথা ভাবি। ভোর ৫ টা থেকে বেলা ১২ টা কি বড়জোর দুপুর ১ টা অবধি কাজ করার পর আমি ফ্রি। তখন আমি বাড়ি ফিরে গান শোনা, সিনেমা দেখা এগুলো আজ করতে পারি।
পরে ফ্লোর বা মঞ্চ থেকে ডাক পেলেও মাছ বিক্রির পর বিস্তর সময় আমি পাব সেগুলির পিছনে সময় দেওয়ার। অভিনেতাদের কেরিয়ার ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে চলে। তাই একটা নির্দিষ্ট কিছু কাজ পাশে রেখে দেওয়া দরকার। এটা নিজের জীবন দিয়ে আজ বুঝলাম। পড়ে রইল অন্য কাজ না করে বাজারে মাছ বিক্রি কেন? তার বিশ্লেষণ তো আগেই দিলাম। যে কাজ আমায় দুঃসময়ে অন্ন জোগাবে তাকে আমি ছাড়ব না।”
আরও পড়ুনঃ এই বছরেই আসছে ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান-৩’
জানতে চাই, অভিনয়ের সুবাদে অনেকে আপনাকে চেনে। তাদের মধ্যে কেউ আপনাকে দেখে চিনতে পারেনি? তাদের কাছ থেকে কীরকম প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন? উত্তরে শ্রীকান্ত জানান- “প্রথমে অবাক হয়েছেন। পরে উৎসাহ দিয়েছেন। বলেছেন, আমরাও ভালভাবে বাঁচার জন্য অন্য আরও কোনও পথ খুঁজছি। পাড়া প্রতিবেশী, অভিনেতা বন্ধুরা, সাংবাদিকরাও আমাকে উৎসাহ দিচ্ছেন। অনেকেই বলছেন তাঁরা আমার জন্য গর্বিত। আর কী চাই?
এই অশান্তির সময়ে দাঁড়িয়ে আমি একা নই, সকলেই কোনও না কোনওভাবে সমস্যায় আছেন। হয়ত তা আমার থেকেও বেশি। তাই আমার কোনও আফসোস নেই আজ সকাল সকাল মাছ নিয়ে বাজারে বসছি বলে। কত ধরনের মানুষকে দেখছি, চিনছি। কত ধরনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমার। এটাকেও একটা চরিত্র বলেই মেনে নিই আজকাল। বাজারটা আমার ফ্লোর বা মঞ্চ। সমৃদ্ধ হচ্ছি। সত্যিকারের ফ্লোরে বা মঞ্চে ফিরলে দর্শককে অনেক বেশি ন্যাচরাল অভিনয় উপহার দিতে পারব বলে আশাবাদী আমি।”
আরও পড়ুনঃ টিভিতে আসছে ‘অলৌকিক অভিযান’, সত্য জানতে তৈরি থাকুন
এই প্রসঙ্গে শ্রীকান্ত মান্না আরও বলেন, অভিনয়জীবনে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি আমার গুরু বলে মানি। তিনি একটা কথা বলতেন- “তুমি যদি সত্যিই অভিনয় করতে চাও তা হলে সেটা তোমাকে করতে হবে। কীভাবে করবে সেটা তোমার ব্যাপার। করতে হবে সেটাই বড় কথা।”
অভিনেতার কতগুলো দামী কথা এই প্রসঙ্গে না লিখলে চলে না। তাঁর কথায়- “যে কোনও কাজ আনন্দ করে করলেই সেটা ঘিরে কষ্ট বা খারাপ লাগা কাজ করে না। একটা ভাল দিনের জন্য আমরা সবাই লড়াই করছি। ভাল দিন, চিন্তামুক্ত ভোর একদিন আসবেই। সবাই হাসিমুখে আবার ব্যস্ততায় ডুব দেব আমরা। লড়াইতেই লুকিয়ে আছে ভাল দিনের ঠিকানা। আমরা করব জয় নিশ্চয়।”…
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584