প্রীতম সরকার
জৈষ্ঠ মাসের শুক্লা পক্ষের ষষ্ঠী বাঙালীর কাছে ‘জামাই ষষ্ঠী’ নামে পরিচিত। এদিন শ্বশুর বাড়িতে জামাইদের আপ্যায়নের রীতি বেশ পুরানো। কিন্তু হিন্দু শাস্ত্রতে কিন্তু এই ষষ্ঠীর সঙ্গে জামাইদের কোন সম্পর্ক নেই। বাঙালী তাদের ১২ মাসের ১৩ পার্বনে এই দিনটিকে জামাইদের আদর আপ্যায়নের জন্য বেছে নিয়েছেন। এদিন জামাইদের শ্বশুর বাড়িতে নিমন্ত্রন করে কবজি ডুবিয়ে খাওয়ানোর রেওয়াজ সাবেক কাল থেকেই বাঙালী সমাজে চলে আসছে।
এবছরের পরিস্থিতি করোনা ভাইরাসের সংক্রমনের কারনে অবশ্য আলাদা। কিন্তু তাতেও পিছপা নন শ্বাশুড়িরা। বর্তমান যুগের স্মার্ট ফোনে ভিডিও কলিং এর মাধ্যমে জামাইদের আশীর্বাদ জানাতে আগ্রহের কমতি নেই শ্বাশুরিদের। এজন্য অনেক বয়স্ক শ্বাশুড়ি রীতিমতো স্মার্ট ফোনের ভিডিও কলিং এর নিয়ম রপ্ত করেছেন।
কিন্ত শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে, যে অনুষ্ঠানটি এখন জামাই ষষ্ঠীতে পরিনত হয়েছে, আদপে সেটার উল্লেখ রয়েছে ‘অরন্য ষষ্ঠী’ নামে। বাঙালীর অনেক লোকাচার বা অনুষ্ঠান কালচক্রে অন্য অনুষ্ঠানে যে বদলে গিয়েছে, এটি তার একটি জলন্ত উদাহরন। অন্যন্য ব্রতের মতো পরিবারের মহিলারাই এই ষষ্ঠী পালন করেন। বিশেষ করে সেইসব বাঙ্গালী মহিলারা, যাঁদের বিবাহিত কন্যা সন্তান রয়েছে।
ব্রত সম্পর্কিত গ্রন্থে পাওয়া যায়, এই তিথিতে মহিলারা একহাতে পাখা নিয়ে বিন্ধ্যবাসিনী ষষ্ঠী দেবীর পূজো করতেন। প্রথমে এই ব্রত পালন করতে হতো গৃহের বাইরে কোন বটগাছের তলায়। পরে বাড়ির মধ্যে বটের ডাল পুঁতে, তার নীচে পিটুলি, ভুষা কালি দিয়ে ষষ্ঠী দেবী তার সন্তানাদি ও তার বাহন বিড়ালের মূর্তি তৈরি করে পূজো করতেন।
পূজোর শেষে মহিলারা বটপাতার উপর রাখা ষষ্ঠীদেবীর প্রতীকী সন্তানদের মূর্তিগুলি হাতে নিয়ে ব্রতকথা শুনতেন। শুধু স্বামী পুত্র বললে ভুল হবে। এই ব্রত পালন করা হত যাতে মহিলার বিবাহিত কন্যারা বাপ, মা, ভাই, বোন, শ্বশুর, স্বামী, পুত্র- সবারই দীর্ঘ জীবন সুখ শান্তিময় হয়। এই সব নিয়ম মেনে ব্রত পালনে বাঙালী নাড়ির নরম মনের পরিচয় পাওয়া যেত। এই ব্রত পালনের সময় মা-এরা তাঁর বিবাহিত মেয়েদের বাড়িতে ডেকে পাঠতেন এবং উদ্দেশ্য ছিল, মেয়ে এই ব্রততে অংশ নিয়ে সুখ শান্তির প্রার্থনায় যোগ দিতে পারে। কিন্তু এই প্রথা এখন অন্য অর্থে অন্য সামাজিক প্রথায় বদলে গিয়েছে। একটু চিন্তা করলেই কারনটাও আন্দাজ করা যায়।
আরও পড়ুনঃ মহামারিতে সমাজ কর্মী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ
আসলে সেকালে বিবাহত মেয়ে মানেই শ্বশুর বাড়ির অন্তঃপুরের বাসিন্দা ছিলেন। তখনতো মায়েরা এতটা স্বাধীন ছিলেননা। এখনকার মতো যখন তখন বাইরে বের হওয়ার সুযোগ তখন ছিলনা। তাই বিবাহিত মেয়ের স্বামীর উপর দায়িত্ব এসে পড়তো মেয়েকে বাপের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার। ফলে জামাইকে নিমন্ত্রন করে তোয়াজ করা এবং এলে তাঁকে চব্যচষ্য খাইয়ে সন্তুষ্ট করা। তাঁকেও এই ব্রত পূজোয় জড়িয়ে নিয়ে জামাইয়ের কপালে দই এর ফোঁটা দিয়ে আশির্বাদ করা হতো তাঁর দীর্ঘজীবন কামনায়।
মা ষষ্ঠীর স্মারক হিসাবে তার হাতে বেঁধে দেওয়া হতো হলুদ রঙের সুতো। হাতে তুলে দেওয়া হতো আশীর্বাদি বস্ত্রাদি। সঙ্গে নানারকম মিষ্টির সঙ্গে তুলে দেওয়া হতো নানারকম ফলের সম্ভার। এসবই হতো সকালে পূজোর শেষে বাড়িতে ফিরে আসার পরে। মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ষষ্টী পূজোর কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন, ‘মাটিতে একটা বটগাছের ডাল পুঁতবো। ভট্টাচার্য্য কি পূজো করতেন জানিনা। ছোট ছোত খই-চুপড়ি করে খই-বাতাসা আর এক কড়া কড়ি দিত।’ দিনের সঙ্গে পূজোর উপকরন কমে গিয়ে জামাই বরণ প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। এবার তো করোনার লকডাউনে সেটাও বন্ধ।।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584