শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতাঃ
রাজ্যে কোনও রোগী যাতে চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত না হন, তার জন্য কড়া নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর থেকে রাজ্য প্রশাসন। এমনকি করোনা রোগী ফেরালে হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা থেকে লাইন্সেস বাতিলের মত হুমকিও দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও হাসপাতালগুলির বেপরোয়া মনোভাবে ফের অকালে ঝরে গেল একটি তরতাজা প্রাণ!
তিন-তিনটি হাসপাতাল ফিরিয়ে দেওয়ার পর আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে ১১ ঘন্টা পর শুক্রবার বিকেলে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হলেও রাতেই মৃত্যু হল ইছাপুরের বাসিন্দা করোনা আক্রান্ত যুবক শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের।রাজ্যে এতগুলি করোনা হাসপাতাল এবং এত শয্যা থাকা সত্ত্বেও কেন করোনা রোগীরাই প্রত্যাখ্যানের শিকার হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
সূত্রের খবর, বেশ কিছুদিন ধরেই শরীর খারাপ থাকার পর বৃহস্পতিবার রাতে আচমকাই যুবকের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। শুক্রবার ভোর ৫ টা নাগাদ যুবকের বাবা-মা তাকে কামারহাটি ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে সুগার পরীক্ষাতে তার হাই সুগার ধরা পড়ে। ইএসআই হাসপাতালে আইসিসিইউ ফাঁকা না থাকায় তাকে বেলঘড়িয়া মিডল্যান্ড নার্সিংহোমে রেফার করে দেন কামারহাটি ইএসআই হাসপাতালের ডাক্তাররা।
আরও পড়ুনঃ পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি মুখ্যমন্ত্রীর
এদিকে মিডল্যান্ড নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হলেও ওই নার্সিংহোম যুবকের করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট দেখতে চায়। রিপোর্ট না থাকায় ওই নার্সিংহোমে যুবকের করোনা পরীক্ষা হয়। আর তারপরেই রিপোর্ট আসে করোনা পজিটিভ। তখন নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ বলে, এটা কোভিড হাসপাতাল নয়, আপনারা অন্য কোথাও নিয়ে যান।
এদিকে অ্যাম্বুল্যান্সে পড়ে থেকে ক্রমশ শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে ওই যুবকের। যুবকের বাবা মা তাকে নিয়ে তাকে নিয়ে ফের কামারহাটি ইএসআই হাসপাতালে ফিরে আসেন। সেখানে চিকিৎসকরা পাশ্ববর্তী কোভিড হাসপাতাল সাগরদত্তে তাঁকে ভর্তি করানোর নির্দেশ দেন। এদিকে সাগরদত্ত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে বলা হয়, বেড নেই। একটু অক্সিজেনও ওই অসুস্থ যুবকের জন্য চাইলেও দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ বাবা-মায়ের।
আরও পড়ুনঃ করোনায় আক্রান্ত লক্ষ্মীর স্ত্রী
এরপরেই চোখের সামনে সন্তানের স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে কার্যত দিশেহারা হয়ে যান বাবা। পাড়ার লোকের পরামর্শে স্বাস্থ্যভবনের হেল্পলাইনে তাঁরা ফোন করেন। সেখান থেকে জানানো হয়, কেউ কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন বলে হাসপাতাল থেকে জানানো হয়নি। সেই রিপোর্ট না পেলে তারা কিছু করতে পারবেন না। শেষপর্যন্ত কলকাতা পুলিশের হেল্পলাইনে ফোন করে যুবকের পরিবার। সেখান থেকে বেলঘড়িয়া থানার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের। বেলঘড়িয়া থানা থেকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হয়। এবার যুবকের অ্যাম্বুল্যান্সের সঙ্গে যান পুলিশকর্মীরাও।
দুপুর দু’টো নাগাদ পুলিশের পরামর্শে ছেলেকে নিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছন ওই দম্পতি। কিন্তু অভিযোগ, সেখানেও ভর্তি না নিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। তারপরেই মায়ের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। ওয়ার্ডে ঢুকে ছেলেকে বাঁচানোর কাতর আর্তি নিয়ে চিৎকার শুরু করেন শুভ্রজিতের মা। ছেলেকে ভর্তি না নিলে আত্মহত্যার হুমকি দেন। তারপরেই স্ট্রেচারে করে ওই যুবককে ওয়ার্ডের ভিতরে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
১১ ঘন্টা পর সন্তানকে কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি করে কিছুটা আশা পেয়েছিলেন যুবকের বাবা-মা। কিন্তু বহুক্ষণ ধরে বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকায় স্বাস্থ্যের চূড়ান্ত অবনতি হয়ে গিয়েছিল ওই যুবকের। শুক্রবার রাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। শনিবার ভোরবেলাই হাসপাতাল থেকে ইছাপুরের বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে যায় তাদের একমাত্র ছেলের মৃত্যু সংবাদ।
আশ্চর্যের বিষয় এটাই, শনিবার পর্যন্তও খাতায় কলমে এখনও কোভিড পজিটিভ হিসাবে ওই যুবকের স্বাস্থ্য দফতরের কাছে নথিবদ্ধ হয়নি। কোথাও কেউ বেসরকারিভাবে করো না পরীক্ষা করিয়ে তা রিপোর্ট পজিটিভ এলে সেই তথ্য ছাড়া স্বাস্থ্য দফতরের কাছে, এই ঘটনা যেন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ করে দিল। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষকর্তা বিষয়টিকে সমন্বয়ের অভাব বলে দায় এড়ালেও সমন্বয় তৈরি করার দায়িত্ব কার, তার সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের বুলেটিন অনুযায়ী, রাজ্যের ৮০ টি কোভিড হাসপাতালে ১০৮৩০টি বরাদ্দ কোভিড বেডের মধ্যে ২৭ শতাংশ রোগী ভর্তি রয়েছে। বাকি ৭৩ শতাংশ ফাঁকা থাকলেও করোনা রোগীদেরকেও কেন বেডের অভাবে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে কেন ঘুরে বেরাতে হচ্ছে কিশোরের পরিবারকে, তার জবাব মেলেনি। কেন ঘোষণা করা হলেও সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, সেটাই প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ মানুষ।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584