অমিতাভ চক্রবর্তী
চমকে উঠবেন না। পলাশির যুদ্ধ জয়ের স্মারক উৎসব আজ বাঙালির জাতীয় উৎসব। শারদ উৎসব। ইতিহাস কিন্তু আমাদের এই তথ্যই দিচ্ছে। যদিও কলকতার প্রথম পুজো নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব ফল্গু ধারার মত বয়েই চলেছে, কোন পুজো প্রথম সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের নাকি…
সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়ির পুজো মুঘল আমলেও যে স্বমহিমায় আয়োজিত হ’ত তা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু তখনও কলকাতা নামে যে শহরকে আমরা চিনি জানি তার পত্তন হয়নি। ছিলো তিনটে পৃথক পৃথক গ্রাম। সুতানুটি, কলকাতা আর গোবিন্দপুর। আর যার হাত দিয়ে এই সুপ্রাচীন দুর্গা পুজোর শুরুয়াৎ তিনি লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়। রায় চৌধুরী পরবর্তীতে প্রাপ্ত উপাধী। আর সেই পুজো শুরু হয় ১৬১০ –এ।
ঐতিহাসিকদের মতকে প্রাধান্য দিয়ে যদি জব চার্নককেই কলকাতার পত্তঙ্কারী ধরা হয় তবে ১৬৯০ এর ২৪ আগস্ট হলো এই সাবেকী কলকাতার জন্মদিন। অতএব সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজোকে সেই অর্থে কলকাতার প্রথম পুজো বলা যাবেনা।
১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে সিরাজদৌল্লা পরাজিত হলো। ক্লাইভের পক্ষে যারা ছিলেন মানে ঐ মীর জাফর, জগৎ শেঠ, উমি চাঁদ এরা…তা এদের সঙ্গে ছিলেন নবকৃষ্ণ দেব … পরবর্তীতে ইংরেজদের দেওয়া রাজার মুকুটও মাথায় পড়েছিলেন।
তা কলকাতার শোভবাজার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা নবকৃষ্ণদেব বাংলার ইতিহাসে একজন স্বনামধন্য মানুষ। পলাশির যুদ্ধের পূর্বে তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডীয়া কম্পানির মুনশি পরে হয়েছিলেন সুতানুটির তালুকদার। পলাশির যুদ্ধের ফলে কপাল খুলে গিয়েছিল নবকৃষ্ণ’র। মিরজাফর, রামচাঁদ রায়, আমির বেগ আর নবকৃষ্ণ মিলে সিরাজদৌল্লার লুকোনো কোষাগার লুঠ করলো। নবকৃষ্ণের ধনবান হওয়ার গুপ্ত ইতিহাস এটাই। পলাশির যুদ্ধে ইংরেজরা জয় লাভ করলে নবকৃষ্ণের ভাগ্যে শুধু অর্থই নয় পেলেন সম্মান এবং ক্ষমতা। ১৭৬৬ সালে পেয়েছিলেন ‘মহারাজা বাহাদুর’ খেতাব। আর সুতানটির তালুকদার হয়েছিলেন ১৭৭১ সালে।
সিরাজদৌল্লা পরাজিত হলে বাংলার যারা সবচেয়ে বেশি উল্লসিত হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর কলকাতার এই নবকৃষ্ণ দেব। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির এই জয় কে তারা হিন্দুদের জয় বলেই মনে করেছিলেন আর ক্লাইভের পরামর্শে তারা পলাশির যুদ্ধের বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন দুর্গা পুজোর মাধ্যমে। বসন্তকালীন দুর্গাপুজোকে পিছিয়ে নিয়ে গেলেন শরৎকালে ওই ১৭৫৭ সালেই। এরপর থেকে প্রত্যেক বছর তারা এই শরৎকালে দুর্গা পুজোর আয়োজন করতেন পলাশির যুদ্ধ জয়ের কথা মনে রেখে এবং অন্যান্য জমিদার ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করেছিলেন তা পালন করতে। এমনি কি ক্লাইভ নিজে খ্রীষ্টান এবং মূর্তি পুজোর বিরোধী হলেও স্রেফ রাজনীতির স্বার্থে হিন্দু প্রেমিক সেজে ১৭৫৭ সালে নবকৃষ্ণের পুজোয় একশো এক টাকার দক্ষিণা এবং ঝুড়ি ঝুড়ি ফলমূল পাঠিয়েছিলেন এমন কি উপস্থিত থেকে পুজোর আনন্দ উপভোগ করেছিলেন।
ইতিহাস বলে ষোলো এবং সতেরো শতকের সন্ধিকালে উত্তরবঙ্গের তাহেরপুরের ভুঁইয়া রাজা কংশ নারায়ন মোঘলদের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধের পূর্বে বহু অর্থ ব্যয় করে শরৎকালে দুর্গা পুজো করেছিলেন। অবশ্য এই তথ্য প্রমান নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে এটা গল্প কাহিনী। কিংবদন্তী।
তো এদিকে নবকৃষ্ণ দে্বের দুর্গা পুজোর আয়োজন মূলত ক্লাইভকে তুষ্ট করার জন্য। এবং শুধু পুজো দিয়ে যে ক্লাইভের মন ভরানো যাবেনা সেটা ভালোই জানতেন নবকৃষ্ণ। তাই ক্লাইভের জন্য বাইজি নাচ এবং মদ মাংসেরও আয়োজন করেছিলেন। তাই একই উঠোনের এক প্রান্তে নির্মান করেছিলেন ঠাকুর দালান আর অন্য প্রান্তে নাচ ঘর।
কলকাতার শরৎকালীন দুর্গোৎসব চালু করার সময় রাজা নবকৃষ্ণ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা পরে উল্লেখ যোগ্য হয়ে ওঠে এবং কলকাতার বাবুদের মধ্যে এই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। কলকাতার হিন্দু মাতব্বররা যারা সাহেবদের নেমন্তন্ন করে নিজেদের বাড়ীতে নিয়ে আসতেন তারাও ভালোভাবে জানতেন কেবল মাটির পুতুল দেখে সাহেবরা খুশি হবেন না তাই মোটা টাকা খরচ করে ভারতের বিখ্যাত বাইজিদের ভাড়া করে আনতেন। পুজোর বাইরেও নাচ ফূর্তি কলকাতার দুর্গাপুজোর এক অবিচ্ছেদ্দ অঙ্গ ছিল বলা যায়। তরজাগান, আখড়াই, হাফ আখড়াই বাইজি নাচ ছাড়া কলকাতার বাবুরা দুর্গা পুজোর কথা ভাতেই পারতেন না। পুরোনো কলকাতায় যে সব বাবুরা বাঈনাচ দেখিয়ে যথেষ্ট নাম কিনেছিলেন তাদের দলে একেবারে প্রথম ছিলেন অবশ্যই এই নবকৃষ্ণ দেব। তবে তার উত্তরপুরুষরাও কম যায় নি। তাদের মধ্যে ছিলেন গোপীমোহন দেব, রাধাকান্ত দেব, রাজকৃষ্ণ দেব। এছাড়াও ছিলেন প্রাণকৃষ্ণ সিংহ, কেষ্টচন্দ্র মিত্র, রামহরি ঠাকুর, বারানসী ঘোষ, দর্পনারায়ন ঠাকুর, সুখময় রায়, কিষনচন্দ্র রায়, রূপচাঁদ রায়, মদন্মোহন দত্ত, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রাণকৃষ্ণ হালদার, মতিলাল শীল।
পুরোনো কলকাতার দুর্গাপুজোর একটি প্রথা ছিল পশুবলি। কালীপ্রসন্ন সিংহ এর হুতুম প্যাঁচার নকশা থেকে জানা যায় দুর্গা পুজোয় পাঁঠা, ভেড়া, আর মোষ বলি হত। বলাই বাহুল্য কলকাতার পুজোর এই পশুবলি নবকৃষ্ণ দেবের হাত ধরেই চালু হয়েছিল। শোভাবাজারের আরেক ধনী বাবু জয় মিত্রের বাড়ীতে মোষ, পাঁঠা, গোসাপ, পায়রা, মাগুর মাছ এমনকি ফল-মশলা যেমন, লেবু, গোলমরিচ, সুপুরি বলি দেওয়া হ’ত। সিমলের মল্লিক বাড়ীতে পাঁঠা আর মোষ বলির রেওয়াজ ছিল। রামদুলাল সরকারের বাড়ীতে প্রথম দিকে ছাগল বলি হত পরে প্রাণী হত্যা না করে কুমড়ো বলি দেওয়ার রেওয়াজ চালু করে।
আজ যেমন খিচুড়ি ভোগ তেমনি বাবু কলকাতায় খিচুড়ি ভোগ হলেও পাঁঠার মাংস ছিলো খাদ্য তালিকার প্রধান আকর্ষণ। সাহেবদের জন্য গোমাংস আর বিলিতি মদের ব্যবস্থা থাকতো বলে ১৮৩১ সালের সমাচার দর্পনে উল্লেখ করা আছে। আর ঢাকিদের জন্য বরাদ্দ ছিলো মোষের মাংস। আর মিষ্টির মধ্যে গুরুত্ব পেত তক্তি, পেঁড়া, মগধের লাড্ডু।
কলকাতায় প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসব পলাশির যুদ্ধের বিজয় উৎসব। সেখান পরে দেখা হত পলাশি যুদ্ধে বিজয় স্মারক-উৎসবে। যে উৎসবের গোড়াপত্তনে জড়িয়ে ছিল সাম্প্রদায়িক এবং জাতীয়তাবিরোধী মনোভাব ক্রমে তা রুপান্তরিত হয়েছে সকল বাঙালির জাতীয় উৎসবে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584