নবনীতা দত্তগুপ্ত, বিনোদন ডেস্কঃ
সবার চাই সমান সম্মান৷ নারী, পুরুষ, তৃতীয় লিঙ্গ- সব পরিচয়ের আগে কিন্তু আমরা মানুষ। মান আর হুশ যাদের আছে তারাই মানুষ। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমরা সবাই সমান। কিন্তু আমাদের সমাজ সেটা কি মেনে চলে? তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আজও আমরা বাঁকা চোখে দেখি। গাড়ির জানলার কাছে এসে টাকা চাইলে আমরা কাঁচ তুলে দিই। ওদের ভাব-ভঙ্গি দেখে মুখ টিপে হাসতেও বাকি রাখি না।
আইন আজ সর্বক্ষেত্রে ওদের জন্য আসন সংরক্ষিত করলেও কটূ কথা পিছু ছাড়ে না ওদের। কিন্তু সেই ‘ওরা’ই কত না গুণের অধিকারী। কেউ আইনজীবী, কেউ শিক্ষকতা করে, কেউ বা অভিনয় করে। কেউ ভাল গানও গায়, আবার নাচেও। কিন্তু সেই ‘ওরা’ যখন অভিনয় করতে চায় তখন শুনতে হয় ‘তালি’ বাজানোর চরিত্রেই নেওয়া হবে তাদের। কিন্তু সব চরিত্রে অভিনয় করার সমানাধিকার ওরাও চায়। যে চরিত্রগুলো ওদের শারীরিক গঠনের সঙ্গে মানানসই হতে পারে, সেই চরিত্র ওরা পায় না। হাস্যকর চরিত্রেই কাজের সুযোগ পায় ওরা। এদের নিয়েই টিভির পর্দায় চলছে ধারাবাহিক ‘ফিরকি’। প্রতি পর্বে ওদেরই আধিপত্য। বাংলা টেলিভিশনে এই প্রথম এমন বিষয় নিয়ে কাজ হল। একটা দুটো সিন নয়, এবার পুরো পর্ব ঘিরে ওদেরই আধিপত্য।
ফিরকির মা লক্ষ্মী একজন বৃহন্নলা। সে নিজের সবটুকু দিয়ে মেয়েকে মানুষ করেছে৷ মায়ের জন্য সম্মান খোঁজে ফিরকি। সে কি পারবে মায়ের সম্মান ফিরিয়ে দিতে? সময় বলবে। তবে, চ্যানেলের উদ্যোগে এই লক্ষ্মী মায়ের কথা মাথায় রেখেই অনুষ্ঠিত হল ‘সমান সম্মান ২০২০’।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে এদিন ‘ফিরকি’র বিষয় নিয়ে চলে আলোচনা। ধারাবাহিকের প্রযোজক স্নিগ্ধা বসুও বক্তব্য রাখেন এই বিষয়ে। বক্তব্য রাখেন অর্জা ব্যানার্জি, সম্প্রীতি পোদ্দার। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সুজি, ধারাবাহিকের পরিচালক বিধান পালদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন সঞ্চালক শর্মিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়।
সকলের বক্তব্যেই উঠে আসে স্ত্রী, পুরুষ এবং অন্যান্য বিভাগের মানুষদের দিতে হবে যোগ্য সম্মান, যোগ্য অধিকার। ফিরকির দাবিও এটাই৷ আর তাই ফিরকি ধারাবাহিক শুরু হয়ে যাওয়ার পর এহেন ‘সমান সম্মান উৎসব’-এর মাধ্যমে ফিরকি ও তার মা লক্ষ্মীকে পরিচয় করাল চ্যানেল। হাজির ছিলেন অন্যান্য দুই চরিত্রাভিনেতাও। সুজি এবং কুসুম সামন্ত। এই প্রথমবার এমন এক সিরিয়াস চরিত্রে কাজ পাওয়ায় খুশি ওঁরা। এর আগে কেউ এমন সিরিয়াস চরিত্র দেয়নি ওঁদের।
একটা প্রশ্ন বারবারই ঘুরে ফিরে আসে- এতই যখন সমান সম্মানের কথা বলে হচ্ছে তা হলে ফিরকির মায়ের ভূমিকায় কোনও বৃহন্নলাকেই নেওয়া হল না কেন? সেখানে কেন কোনও মহিলাই জায়গা পেলেন। প্রযোজক স্নিগ্ধা বসুর কথায়, “আমরা লক্ষ্মী চরিত্রের জন্য অডিশন নিয়েছি। পাক্কা একটি বছর আমরা এই চরিত্রের জন্য কারোকে খুঁজেছি। সেখানে যদি কোনও দক্ষ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে আমরা পেতাম আমরা তাকেও নিতে রাজি ছিলাম। কিন্তু সেরকম কারোকে আমরা পাইনি। কেউই সাহস পায়নি প্রতিদিন চরিত্রটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কারণ ওরা কেউই ক্যামেরার সামনে সেভাবে অভ্যস্ত নয়। ওরা নিজেরাই ভাবছে মানুষ রোজ আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ রোলে নিতে পারবে তো? কেননা ওদেরকে আজও সমাজ একটু অন্য চোখেই দেখে। আমাদের যদি ওদের মধ্যে থেকে কারোকে লক্ষ্মী চরিত্রের জন্য নিতে কিংবা অন্য কোনও চরিত্রের জন্য নিতে সমস্যা থাকত তা হলে তো আমরা সুজি কিংবা কুসুমকেও নিতাম না। কেউই লক্ষ্মী চরিত্রের জন্য সাহস করে এগিয়ে আসতে চায়নি তাই নেওয়া যায়নি। প্রতিদিন স্ক্রিপ্ট পড়ে তা দর্শকের মনের মতো করে তোলা তো সহজ ব্যাপার নয় তাই ওরা নিজেদের প্রতি সেই ভরসাটা দেখাতে পারেনি। আমি বলব চ্যানেল ‘ফিরকি’ নিয়ে একটা বড় চ্যালেঞ্জ নিল। এমন একটা বিষয়কে দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলাটা সহজ ব্যাপার নয়৷ রাত ৯ টা হল প্রাইম টাইম। এই সময়ে গোটা পরিবার টিভির সামনেই থাকে বেশিরভাগ বাড়িতে। সেই সময়ে ‘ফিরকি’কে মানুষ কতটা নেবে বা আদৌ নেবে কিনা সেই ব্যাপারে চ্যানেলও নিশ্চিত করে কিছু জানে না। সেদিক থেকে চ্যানেলের কাছে ফিরকি সত্যিই চ্যালেঞ্জিং। আমরা ওদের সমস্যাগুলো তুলে ধরতে চাইছি যা বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা।” তাঁর এই উত্তরের পরে সত্যি আর কিছু বলার থাকে না।
এদিন ‘সমান সম্মান উৎসব’-এ হাজির ছিলেন চ্যানেলের অন্যান্য ধারাবাহিকের অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও। তাঁরা চ্যানেলের এহেন উদ্যোগকে স্যালুট জানালেন। তাঁরাও ফিরকির মা লক্ষ্মীর মতো মানুষদের সমাজে সমান অধিকার দাবি করেন।
অনুষ্ঠানে এদিন নানারকমের খেলার আয়োজন করা হয়। ঘুড়ি ওড়ানো থেকে শুরু করে বেলুন ফাটানো— সবই ছিল খেলার বিষয়। এছাড়া ছিল দেদার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা। বাঘাযতীন অভিযান সংঘ ক্লাব প্রাঙ্গন সেজে ওঠে বেলুন, ঘুড়ি, ছাতা, ফুলের সমারোহে। সব মিলিয়ে রঙিন হয়ে ওঠে ‘সমান সম্মান উৎসব’।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584