রাহুল চক্রবর্তীর মুখোমুখি নবনীতা দত্তগুপ্ত
নবনীতাঃ ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’ ধারাবাহিকে তোমার এন্ট্রিটা কিন্তু দারুণ ছিল।
রাহুলঃ ওহ্! থ্যাঙ্ক ইউ নবনীতা। তুমি দেখেছো তার মানে।
নবনীতাঃ আলবাত দেখেছি। তাই তো কথা বলতে আগ্রহী।
রাহুলঃ বলো কী বলবে।
নবনীতাঃ নেগেটিভ, পজিটিভ নানা ধরনের চরিত্রে তোমাকে আমরা পেয়েছি। ইন্সপেক্টর অসীমের চরিত্রটা কেমন এনজয় করছ এবার?
রাহুলঃ এটা আমার ড্রিম রোল। অনেকদিন এরকম একটা চরিত্রের অপেক্ষায় ছিলাম। আমার অনেক পুলিশ বন্ধু আছে জানো তো? তারা বলে, আমাকে নাকি পুলিশের রোলে মানাবে। আমার মধ্যে নাকি পুলিশ পুলিশ ব্যাপার আছে একটা। খুশি হই শুনে। ইচ্ছেও ছিল খুব এরকম একটা চরিত্র করার। পেয়ে গেলাম। ভাল তো লাগবেই। আর একটা কথা কী জানো তো, যখন কেউ কোনও ইউনিফর্ম পরে তখন সে খুব ডিসিপ্লিন্ড হয়ে যায়। তা সে স্কুল ড্রেস হোক বা মিলিটারির ড্রেস বা পুলিশের উর্দি। পুলিশের উর্দি গায়ে চাপিয়ে আমিও নিজেকে আরও ডিসিপ্লিন্ড করে তুলছি। খুব আনন্দ পাচ্ছি চরিত্রটা করে।
নবনীতাঃ তুমি এমনিতেও ডিসিপ্লিন্ড। আমরা যারা তোমায় চিনি তারা জানি।
রাহুলঃ আচ্ছা। বাহ। খুশি হলাম।
নবনীতাঃ এই চরিত্রটার জন্য নিজেকে কী ভাবে প্রস্তুত করলে?
রাহুলঃ এই চরিত্রটার জন্য আমি নিজেকে নিজে প্রতিদিন শেখাই এবং পরিণত করি। তবে, চরিত্রটার জন্য আমি অনেক ওজন কমিয়েছি। ৮৫ কেজি থেকে ৭৩ কেজিতে ওজন নামিয়েছি। আরও কমাব। এই লকডাউনে অনেকে মুটিয়েছে ঘরে বসে। আমি রোগা হয়েছি। আগে চেহারা নিয়ে ভাবতাম না জানো তো? ভাবতাম, কে কাজ দেবে? আমার তো কোনও স্বজন নেই যে পোষণ করবে। কী হবে রোগা হয়ে? তবে, এবার এমন একটা চরিত্র আমাকে নতুন করে বাঁচার রসদ জোগাল।
নবনীতাঃ তুমি তো অনেক কাজ করো রাহুল দা। এই তো ‘নকশিকাঁথা’ করে উঠলে। ‘কোড়া পাখি’র চরিত্রটাও খুব ভাল।
রাহুলঃ হ্যাঁ তা ঠিক। এই যে তুমি বললে না, “তুমি তো অনেক কাজ করো রাহুল দা..”- এই কথাটা জানে অনেকেই কিন্তু বলার লোকের অভাব। আজ এত বছর ইন্ডাস্ট্রিতে আছি এখনও প্রথমসারির সংবাদপত্র আনন্দবাজারে আমার একটা ছবি বেরোল না। এক সাংবাদিক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) আমাকে বলেছিলেন লাখ খানেক টাকা দাও ছবি ছেপে লেখা বের করব। কেন দেব বলো তো? ওরা যেদিন মনে করবে আমার ছবি ছাপা যায় সেদিনই ছাপুক।
তবে, কখন খারাপ লাগে জানো তো? যখন দেখি সবেমাত্র আসা কোনও অভিনেতা বড় কভারেজ পেয়ে যায়। ঠিক করে হয়ত তারা ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতেও শেখেনি। তাদের ইয়াব্বড় ইন্টারভিউ আর ছবি জ্বলজ্বল করে পাতা জুড়ে। হিংসে নয়, খারাপ লাগা কাজ করে। নিজেকে বিতাড়িত মনে হয় তখন।
অথচ এত বছর অভিনয় করে ৬০ টা বড় পর্দার জন্য কাজ করেছি, ৩০ টার মতো প্যারালাল হিরোর অভিনয় করেছি আমি। কিন্তু সেটা প্রচারের আলোয় আনে না কেউ। অথচ পাশের ব্যক্তিটির এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউতে ছয়লাপ হয় মিডিয়ার দেওয়াল।
কী করলে প্রথম সারির কাগজে ছবি ছাপানো যায় আমার জানা নেই। তা হলে কি কোনও অভিনেত্রীকে নিজের প্রোডাকশন হাউজের অফিসে বসিয়ে তার গায়ে মাখোমাখো হলে ছবি ছাপা হবে বড় করে? সত্যিই জানা নেই আমার। যাক, বলো আর কী বলবে।
নবনীতাঃ তোমার কথার যুক্তি গুলো খুব স্পষ্ট অনুভব করছিলাম।
রাহুলঃ আমি স্পষ্টবাদী। ভয় পাই না। যা বলি প্রকাশ্যেই বলি। আমি আমার বাবার আদর্শে মানুষ। ভয় পেয়ে মনে মনে কথা বলার পাত্র নই। যা বললাম সব লিখতে পারো তুমি।
নবনীতাঃ অসীম চরিত্রে কেমন সাড়া পাচ্ছ?
রাহুলঃ দারুণ সাড়া পাচ্ছি। অনেক চরিত্রে অভিনয় করেছি ছোটপর্দায়। এমন সাড়া পাইনি কখনও। ইন্সপেক্টর অসীম এককথায় হিরো। প্রথমদিনের এন্ট্রিটা নিয়ে আমি নিজেও আশাবাদী ছিলাম। বেশ একটা ‘দাবাং দাবাং’ ব্যাপার ছিল না?
নবনীতাঃ আমারও সেটাই মনে হয়েছিল। তোমাকে কারো সঙ্গে তুলনা করব না বলে বলিনি এতক্ষণ।
রাহুলঃ আমিই বলে দিলাম। (সহাস্যে) একই ধরনের পারিবারিক রোলে অভিনয় করতে করতে একঘেয়ে লাগছিল। কোনও কাজকে ছোট করছি না। তবে কি জানো তো, নিজেরও তো ভাল লাগা বলে কিছু না কিছু থাকে। আমারও আছে। ভুলেই গেছিলাম আমি কখনও হিরোর রোলে অভিনয় করেছি বা পরবর্তীতেও করতে পারি। অসীম বাবু আমাকে আবার চাঙ্গা করে তুলল। আমি কনফিডেন্ট আবারও হিরোর রোল করতে পারব। আমি ডাকও পেয়েছি এর মধ্যেই পরিচালক অতনু ঘোষের কাছ থেকে। একপ্রকার হিরোর রোল বলতে পারো। শ্রাবন্তীর সঙ্গে একটা হিরোর রোল করার কথা আছে আমার। বেশি কিছু বলব না। আগে কথা আরও এগোক তারপর বলব।
নবনীতাঃ অসীমে ফিরি। অনেক হার্ডওয়ার্ক করতে হচ্ছে নিশ্চয়ই। ছুটোছুটি, অ্যাকশন সবই তো আছে।
রাহুলঃ আছে তো। করছি সবই। ওই যে বললাম মজা পাচ্ছি। তাই কঠিন লাগছে না খাটুনিটা। আজ ৬ বছর হল আমি আমার রেটও বাড়াইনি। আমার মতে, প্রযোজনা সংস্থার উচিত বুঝে রেট বাড়ানো। আমি কাজে বিশ্বাসী। দীঘা গিয়েছিলাম দুদিন লকডাউন জেনে। ফোন করা হল লকডাউন উঠে গেছে শনিবারের। শুক্রবার রাত তিনটেয় ফিরে এলাম কলকাতায়। এখন শুটিঙেই আছি। ব্রেকে কথা বলছি তোমার সঙ্গে। একটা মানুষের ডেডিকেশনের মূল্য দেওয়া উচিত বলে মনে করি আমি।
নবনীতাঃ দাদা তোমারও তো প্রোডাকশন হাউজ আছে।
রাহুলঃ হ্যাঁ। আমি আগেও একবার তোমায় বলেছিলাম, আমি নিজে একজন অভিনেতা বলে আমি জানি অভিনেতাদের কষ্ট আর চাহিদার কথা। আমি সেই অনুযায়ী সকলের দিকটা দেখতাম। এভাবে দেখার লোক কম আছে ইন্ডাস্ট্রিতে। একেবারে নেই বলব না। এই প্রসঙ্গেও একটা কথা বা খারাপ লাগাও বলতে পারো সেটা বলার আছে। আমি প্রোডাকশন হাউজ খুললাম। ধারাবাহিকটি জনপ্রিয় হল। ধারাবাহিক নিয়ে লেখাও হল।
কিন্তু আমার নতুন এই উদ্যোগ এবং পদক্ষেপ নিয়ে গুটিকয়েক মিডিয়া কভারেজ দিল। ওদিকে কত নিউজ দেখি যেগুলো নিউজই নয়। অভিনেতা-অভিনেত্রী স্লিম হল কি দুবা হ্যাঁচ্চ দিল সেটাও নিউজ হয়ে যাচ্ছে। তুমি আমার কভারেজ দিয়েছিলে আমার মনে আছে। আমি বলছি না আমায় নিয়ে বিশাল কিছু লিখতে হবে। কিন্তু মানুষ তো কাজের স্বীকৃতি চায়।
আমার কাজকর্মকে এড়িয়ে যাওয়া, আমার পাশের মানুষটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া এগুলো আমি আজকাল এনজয় করি। আমি কিন্তু আমার জায়গায় টিকে আছি। বিলীন হয়ে যাইনি ইন্ডাস্ট্রি থেকে। এটাই আমার স্বস্তি আর শান্তির জায়গা। আমি তেল মেরে নিজের প্রচার করতে পারব না কখনও। কারো কাছে গিয়ে নিজের ঢাঁক পেটাতে পারব না। নিজের ঢাঁক পিটিয়ে লোক দাদাগিরিতেও চলে যাচ্ছে।
নবনীতাঃ মানে?
রাহুলঃ হ্যাঁ। আমি ‘অন্দরমহল’-এ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা রোল করতাম তুমি জানো। কিন্তু যখন টিম অন্দরমহলকে নিয়ে যাওয়া হল দাদাগিরিতে তখন একবারও আমার নাম ওঠেনি। অথচ যে মাত্র কয়েকদিনের জন্য অভিনয় করল সে চলে গেল। ওই যে, আমি তেল মারতে পারিনি। যাব যাব বলিনি। আমি আজ অবধি অরূপ বিশ্বাস, স্বরূপ বিশ্বাস কিংবা মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে পারিনি আমাকে বড় বড় কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য। আমি মনে করি আমার কাজ দেখে ঠিক একদিন তাবড় তাবড় পরিচালকদের কাছ থেকে ডাক পাব। তাঁরা ডাকবেন। আমি আজ অবধি শ্রীকান্ত মোহতার প্রোডাকশনে কাজ করিনি। টেলিভিশনেও করিনি। ভাবতে পারো? এটুকু কি পেতে পারতাম না?
নবনীতাঃ নেপোটিজমের কথা চলে আসে এবার।
রাহুলঃ হ্যাঁ, আমার পরিবারে কেউ কখনও অভিনয় করেনি বা স্টার হয়নি। ফলে, আমাকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার লোক ছিল না। যেটুকু করেছি নিজে করেছি। বাবা এবং মা শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমার বাড়িতে নিয়মানুবর্তিতা, কড়াকড়ি দারুণ মাত্রায় ছিল। আমার বাবা গরিব-দুঃখীদের জন্য স্কুল বানিয়েছিলেন। হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করত অনেকে। রাঁধুনি না আসলে মা নিজে রেঁধে খাওয়াতেন সকলকে। এরকম পরিবারে আমার বড় হওয়া।
ইন্দিরা গান্ধীও এসেছেন আমাদের বাড়িতে। বাবা রাজনীতি করতেন। আমিও করি। রাজনীতি করে বাবাও অতিরিক্ত কোনও সুবিধা নেননি। আমিও নিই না। এই আমপানের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত বহু পরিবারকে আমি সাহায্য করেছি। নিউজ দেখেছো কোথাও? আমি প্রচার করে সাহায্যে বিশ্বাসী নই। আমি সুন্দরবনের বহু পরিবারের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। কেউ জানেও না সেই কথা। আমি নিজের খরচে এসব করেছি। আমাকে কেউ স্পনসর করেনি। আমি জানি আমি যতই সমাজসেবা করি না কেন এম.এল.এ টিকিট আমি পাব না।
আশাও করি না৷ বললে হয়ত বিশ্বাস করবে না, আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভীষণ সম্মান করি, ওঁর পাশে আমায় দেখাও যায় নানা অনু্ষ্ঠানে৷ কিন্তু আজ অবধি আমি দশটা টাকাও নিইনি দিদির কাছ থেকে। এমন অনেকেই আছেন আমাদের ইন্ডাস্ট্রির যাঁরা দিদির কাছ থেকে সবরকমের সুবিধা নেয় আবার তাঁকে পিছনে গালাগালও দেন। তাঁরাই আজ বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত।
দিদির কাছে আমার একটাই জিজ্ঞাস্য- “পদ পেতে গেলে কি আপনাকে গালাগাল দিতে হয় আপনার আড়ালে? কাজ পেতে হলে সহকর্মীকে আলিঙ্গনে বাঁধতে হয়? নাকি আর্বানাতে ফ্ল্যাট কিনতে হয়? নাকি বোনের জন্য বিউটি পার্লার আর নিজের বাবার নামে রেস্তোরাঁ খুলতে হয়?”
যাঁদের কথা আমি বলতে চাইছি তাঁরা আজ গ্ল্যামার দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত না থাকলে তাঁদের কেউ চিনত না। কেউ তাঁদের এম.এল.এ হওয়ার পরীক্ষায় বসার টিকিটও দিত না। সেই অভিনেতাদের কি উচিত না একটা স্টুডিও বানিয়ে টেকনিশিয়ানদের কর্মসংস্থান তৈরি করে দেওয়া? অভিনয়ই তো তাঁদের আজ জনপ্রতিনিধির সিংহাসন দিল। কানন দেবীর কথায় ‘মুভিটোন’ স্টুডিওর জায়গায় কিন্তু আজও প্রোমোটিং হয়নি। গোছানো একটা স্টুডিওই রয়েছে সেটা।
নবনীতাঃ সোজা কথায় নিজের ঢাঁক পেটালেই হবে বাজিমাত।
রাহুলঃ আর আমি সেটা পারি না। তাই ভাল কাজেরও স্বীকৃতি মেলে না৷ আড়ালেই পড়ে থাকি।
প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি, অভিষেক চ্যাটার্জি, তাপস পাল, চিরঞ্জিত চ্যাটার্জি সমসাময়িক অভিনেতা। কাকে নিয়ে বেশি লেখালিখি হয়? সেটা তাঁর ক্যারিশ্মা। আমি সেটাকে স্যালুট জানাই। কিন্তু বাকিদের নিয়ে কি কিছুই লেখার নেই? আমার প্রশ্ন এটাই।
নবনীতাঃ তোমার প্রত্যেকটা কথা আমি জাস্ট গিললাম রাহুল দা। জানলাম আর ভাবলাম। এবার তোমার বরানগরের বাড়ির ইতিহাস নিয়ে একটা স্টোরি করতে চাই। রাজি তো?
রাহুলঃ আমি খুশি হব।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584