নবনীতা দত্তগুপ্ত
কখনও ‘শ্রীময়ী’ ধারাবাহিকের রোহিত সেনের পুলিশ বন্ধু বিকাশ আবার কখনও ‘প্রথমা কাদম্বিনী’র দুর্গামোহন। আর এখন ‘রানী রাসমণি’ ধারাবাহিকে সারদামণির বাবা রামকুমার মুখুজ্যের চরিত্রে রয়েছেন দেবনাথ চ্যাটার্জি। দেবনাথের অভিনয় জার্নি শুরু হয় মঞ্চে৷ থিয়েটারের একনিষ্ঠ কর্মী তিনি। তাঁর সঙ্গে কথা বলে লিখছেন নবনীতা দত্তগুপ্ত।
নবনীতাঃ অভিনয়ে তো বেশ অনেকদিন হল।
দেবনাথঃ নয় নয় করে ২৫ বছর হয়ে গেল অভিনয়ে। স্কুলে-কলেজে পড়ার সময় থেকেই নাটক করি। গণনাট্য সংঘ করতাম। বালির পটভূমি শাখাতে অভিনয় করতাম। এরপর অনেকদিন কলকাতার ‘স্পন্দন’-এ নাট্যকর্মী হিসেবে কাজ করেছি। অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি করতাম। একটা সময়ে কর্মক্ষেত্রে বেশ প্রতিষ্ঠাও পেলাম। মাইনেও খারাপ ছিল না। বরং বেশ ভালই ছিল। চাকরি আর মঞ্চ একসঙ্গেই চলত তাল মিলিয়ে। চাকরিটা দরকার, আর মঞ্চটা টানের জায়গা। নেশার জায়গা। নেশা আর পেশা এক হলে অসুবিধা হয় না।
কিন্তু আমার নেশা আর পেশা ছিল ভিন্নমুখী। ফলে, মঞ্চে কাজ করার সময় বা স্টেজে এন্ট্রি নেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে যখন এই জাতীয় ফোন আসত- “কখন কোথায় কী ডেলিভারি হবে?…” তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনটা এদিক ওদিক হয়ে যেত। উৎপল দত্ত একটা কথা বলতেন শুনেছি, সাক্ষাতের সুযোগ তো আর হয়নি। উনি বলতেন- “হয় অভিনয় নয় চাকরি।” আমি কথাটা উপলব্ধি করি।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি চাকরিটা ছাড়ি। এরপর শুধুই অভিনয়। সান্নিধ্য পেয়েছি দেবশঙ্কর হালদারের মতো বহু নাট্যব্যক্তিত্বর। এরপর একদিন ফোন পাই পৌলমী দির (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা) কাছ থেকে। জানতে পারি ওনাদের ‘মুখোমুখি’ নাট্যদলের আগামী নাটক ‘ফেরা’তে আমার জন্য একটা চরিত্র আছে। আমি কি আর সেই সুযোগ ছাড়ি? ব্যস, সেই থেকে আজ অবধি আমি ‘মুখোমুখি’রই অংশ।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন অভিনেতা এবং মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি, এর থেকে বড় পাওয়া আমার কাছে আর কিচ্ছুটি নেই৷ বলতে ভাল লাগে এবং তৃপ্তি পাই এই ভেবে যে আমি সৌমিত্রবাবুর একপ্রকার ছায়াসঙ্গী ছিলাম। নিজের সুবিধা, অসুবিধার কথা আমায় বলতেন। কিছু খেতে ইচ্ছে করলে আমায় বলতেন। কোনও কাজে ওনার সঙ্গে আমার যাওয়ার থাকলে ওনাকে গাড়ি থেকে নামানো, গাড়িতে তোলা আমিই করতাম। এই কাজগুলো করে আমি আনন্দ পেতাম, শান্তি পেতাম।
নবনীতাঃ পর্দায় সুযোগ এল কীভাবে?
দেবনাথঃ চেতনার ‘ডন’ নাটকের একটা শো ছিল। সেদিন কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় দেখতে আসেন ‘ডন’। এরপরই একদিন মেসেঞ্জারে কমলেশ্বর বাবু আমায় টেক্সট করেন ‘পাসওয়ার্ড’ ছবিতে একটা রোলে কাজ করার জন্য। সেই সুযোগ পাওয়া অনস্ক্রিনে। এরপর কমলেশ্বর মুখার্জির সঙ্গে স্টার জলসায় মহালয়া এবং অরিজিনালস ‘এন্টনি কবিয়াল’-এ অভিনয় করি।
এরপর এস ভি এফ থেকে ডাক পাই ‘প্রথমা কাদম্বিনী’তে দুর্গামোহন দাসের চরিত্রের জন্য। বেশ কয়েকদিনের ট্র্যারক ছিল ওটা। প্রায় তিন মাস। এরপর ‘শ্রীময়ী’ ধারাবাহিকে রোহিত সেনের পুলিশ বন্ধু বিকাশের চরিত্রটা করি কয়েকদিন। খুব বেশি ট্র্যাীক ওটাতে ছিল না। তবে, বেশ ভাল একটা চরিত্র ছিল বিকাশ। লীনা গঙ্গোপাধ্যায় একটা পার্শ্ব চরিত্রকেও যেভাবে গুরুত্ব দেন তা এক কথায় অনবদ্য৷ রোহিতের বাবার আনুকুল্যে বিকাশ লেখাপড়া করে। এহেন গল্প একটা পার্শ্ব চরিত্রকে কোথাও গিয়ে নায়ক করে তোলে।
আবার ট্র্যাককটা ফিরবে কিনা জানি না। তবে, ফিরলে খুশি হব৷ কিছুদিন শ্রীময়ীতে ওই চরিত্রটা করার পরই লকডাউন হয়। এরপর অনেকদিন বসে থাকা। আমার মেয়ে ক্লাস টেন-এ পড়ে। মাধ্যমিক দেবে। এমনও সেভিংস নেই যে ৮-৯ মাস ব্যাঙ্কের থেকে টাকা তুলব আর খাব। তাই সেই সময় বেশ সংকটে পড়ি। কাজ ছিল না কোনও। এর মাঝে অবশ্য জানতে পারি পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বায়োপিক ‘অভিযান’-এ আমি সৌমিত্রবাবুর সহকারীর রোল প্লে করব। ঠিক যে ভূমিকাটা আমি বাস্তবে পালন করতাম সৌমিত্রবাবুর পাশে থেকে, সেই চরিত্রটাই আমাকে করতে হবে ছবিতে। ফলে, কাজটা করতে আমার এতটুকু অসুবিধা হয়নি।
নবনীতাঃ বাহ্, এটা বেশ ইন্টারেস্টিং।
দেবনাথঃ হ্যাঁ।
নবনীতাঃ এখন তো রানী রাসমণি ধারাবাহিকে সারদামণির বাবার চরিত্রে আপনি।
দেবনাথঃ হ্যাঁ। সারদামণির বাবা রামকুমার মুখুজ্যের আগে বেশ অনেকদিন কোনও কাজ ছিল না আমার। এই চরিত্রটা আমার মুখে হাসি ফুটিয়েছিল। একটা স্থায়ী চাকরি ছেড়ে অনেক ঝুঁকি নিয়ে সংসার চালাচ্ছি। কাজ না থাকলে সংকট বাড়বে। এটা মাথায় ঘুরত সর্বক্ষণ। তা সে যাইহোক, এখন বেশ ব্যস্ত এই চরিত্রটা নিয়ে৷ খুব ভাল একটা চরিত্র। এনজয় করছি। তবে এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলব, এই চরিত্রটা নিয়ে খুব একটা স্টাডি করতে পারিনি। পরিচালক রূপক দা খুব ভাল করে আমায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন। সেই মতোই কাজটা করে চলেছি। আশা রাখি সকলকে খুশি করতে পারব চরিত্রটা দিয়ে।
আরও পড়ুনঃ বাবার ঘর ছেড়ে গদাধরের পথে সারদা
নবনীতাঃ ওয়েব সিরিজও তো করলেন।
দেবনাথঃ হ্যাঁ। আড্ডা টাইমসের ‘ফেলুদা ফেরত’-এর দ্বিতীয় গল্প ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’ তে আমি অনিকেন্দ্র সোমের চরিত্রে আছি। এ ছাড়া হই চই-এর ওয়েব সিরিজ ‘পাপ’-এও অভিনয় করেছি সাউন্ড রেকর্ডিস্টের ভূমিকায়। এ ছাড়া জি ফাইভে সায়ন্তন ঘোষালের পরিচালনায় সুরিন্দর ফিল্মসের ব্যানারে ‘লালবাজার’ সিরিজে অভিনয় করেছি পুলিশ অফিসারের ভূমিকায়।
নবনীতাঃ পুলিশ চরিত্র তার মানে বেশ অনেকবার করা হয়ে গেল।
দেবনাথঃ তা বটে। ডাক্তার চরিত্রও। লকডাউনে একেবারেই যে কাজের অফার আসেনি তা নয়। তবে তা বেশিরভাগই হয় ডাক্তার নয়তো পুলিশের চরিত্রে। তাই করিনি। ওই চরিত্রগুলো বড্ড ছকে বাঁধা। সব পুলিশ চরিত্র তো বিকাশের মতো হয় না। একবার যদি স্টিকার লেগে যায় যে এই অভিনেতা শুধু পুলিশ বা ডাক্তারের চরিত্রই করে তা হলে অন্য চরিত্রের জন্য আর ডাক পাব না হয়ত। মোটা মাইনের চাকরি ছেড়েছি বলে টাকার জন্য যে কোনও চরিত্র পেলেই করে ফেলব না। চরিত্র পছন্দ হলে তবেই করব।
নবনীতাঃ সঠিক সিদ্ধান্ত এটা।
দেবনাথঃ একেবারেই তাই। আমি ঠিকই করে নিয়েছি, গতে বাঁধা চরিত্র থেকে দূরে থাকব।
নবনীতাঃ বিকাশ চরিত্র ফের এলে?
দেবনাথঃ করব। কেননা চরিত্রটায় আলাদা শেড আছে৷
নবনীতাঃ অনেক ধরনের চরিত্রই করা হয়ে গেল। কোনটা সবথেকে বেশি মনে ধরে?
দেবনাথঃ নাটকের কথাই আগে বলি। কারণ মঞ্চ থেকেই আমার অভিনয়জার্নি শুর। ‘মুখোমুখি’র নতুন নাটক ‘অন্ধযুগ’। নির্দেশনায় পৌলমী চট্টোপাধ্যায়। এখানে আমি কৌরবপুত্র যুযুৎসুর চরিত্রে অভিনয় করছি। যে কিনা কৌরবদের বিপক্ষে গিয়ে পাণ্ডবদের শিবিরে যোগদান করেছিল। এবং যুদ্ধের পর বাবা-মা ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আত্মহত্যা করে। মহাভারতের এই চরিত্রটা নিয়ে খুব একটা আলোচনা কোথাও হয় না। এই কৌরব যে কতখানি প্রত্যাখ্যাত তা দেখানো হবে অন্ধযুগে। এই চরিত্রটা আমার বড় প্রিয়।
তাছাড়া পর্দায় বলতে গেলে বলব, বড় পর্দায় তেমন তো বড় রকমের কোনও কাজ এখনও করে উঠতে পারিনি তাই ছোট পর্দার কথাই বলব। দুর্গামোহন দাস আমায় পরিচিতি দিয়েছে। আর বিকাশ আমায় জনপ্রিয়তা দিয়েছে। সুতরাং এই চরিত্রগুলো আমার কাছে বেশ প্রিয়। অভিনেতার কাছে নিজের সব চরিত্রই সমান কদরের হয়৷ তবে ব্যক্তিগত অধিক পছন্দ বলেও তো কিছু থাকে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই চরিত্রগুলো আমার কাছে বেশি আদরের।
আরও পড়ুনঃ এ আর রহমানের সুরে ইমনের প্রথম হিন্দি সিঙ্গল ‘নেহি সামনে’
নবনীতাঃ স্টেজ শো আর সিরিয়ালের টাইট শিড্যুল। দুটো ব্যালান্স করেন কী ভাবে?
দেবনাথঃ এটা সৌমিত্রবাবুর কাছ থেকেই শেখা। যখন সিরিয়ালের শুটে থাকি তখন ওই চরিত্রটার মাঝে থাকি। এরপর যখন প্যাক আপ করে গাড়িতে চেপে স্টেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিই তখন স্টেজের চরিত্রটা নিয়ে ভাবি।
নবনীতাঃ অভিনয় ছাড়া আর কী করা হয়?
দেবনাথঃ কিছুই করি না এটা ছাড়া।
নবনীতাঃ কোন ধরনের চরিত্রের অপেক্ষায় আছেন?
দেবনাথঃ ডি গ্ল্যাম চরিত্র। চাষী বা শ্রমিকের চরিত্র পেলে খুশি হব। নিজেকে নানাভাবে ভাঙতে চাই।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584