নবনীতা দত্তগুপ্ত
“স্নেহাশিস চক্রবর্তীর মতো প্রযোজক বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে কমই আছেন বলে আমার মনে হয়। স্নেহাশিস দা এমন একজন প্রযোজক যাকে নিজের যে কোনও অসুবিধার কথা বলা যায়। অনেক শেখার আছে ওঁর কাছে। আমি গুরু মানি স্নেহাশিস’দাকে।” জানালেন অভিনেতা সুদীপ সেনগুপ্ত।
সুদীপের সঙ্গে দূরভাষ আড্ডায় নবনীতা দত্তগুপ্ত
টেলিভিশন এমন এক মাধ্যম যা একজন অভিনেতাকে খুব তাড়াতাড়ি দর্শকের কাছের মানুষ করে তুলতে পারে। দর্শকের কাছে তেমনই এক পরিচিত পার্শ্ব চরিত্রাভিনেতা সুদীপ সেনগুপ্ত। আরও একটা কথা বলার, পার্শ্ব চরিত্ররা না থাকলে মুখ্য চরিত্রদের মেলে ধরার অবকাশ থাকে না।
সুদীপ সেনগুপ্ত বাংলা টেলিভিশনের জনপ্রিয় মুখ। থিয়েটার দিয়ে শুরু হয় অভিনয়ের পথে হাঁটা। শাঁওলি মিত্রর নাটক দল ‘পঞ্চম বৈদিক’ নাটক দলে নাটক করেন আজ ১৪ টি বছর ধরে। নাটক করতে করতেই নাট্য দলের অন্য আরেকজন প্রাণদাত্রী অর্পিতা ঘোষের প্রেরণায় ‘কেয়া পাতার নৌকো’ ধারাবাহিকের জন্য অডিশন দেন। লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের পছন্দ হয় সুদীপের অভিনয়। আর ব্যস, সিলেক্ট হন লুতফরের চরিত্রে।
শুরু হয় টেলি কেরিয়ার। তারপর থেকে একের পর এক বাংলা ধারাবাহিকে গুরুত্বপূর্ণ সব চরিত্রে অভিনয় করে চলেছেন তিনি। কেয়া পাতার নৌকো, ইষ্টি কুটুম, বিকেলে ভোরের ফুল, হিয়ার মাঝে, চোখের তারা তুই, জয় বাবা লোকনাথ, গোয়েন্দা গিন্নি, গুড়িয়া যেখানে গুড্ডু সেখানে, সাধক বামাক্ষ্যাপা, এসো মা লক্ষ্মী, জয়কালী কলকাত্তেওয়ালি, প্রথম প্রতিশ্রুতি, রানী রাসমণি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন সুদীপ।
আরও পড়ুনঃ অক্টোবরের একুশে ফের ঋতাভরীর গোপন কম্ম ফাঁস
আকাশ আটে এক মাসের গল্প- ‘প্রতিনিয়ত’তে লিড রোলে অভিনয় করেন তিনি। এ ছাড়াও লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মাটি’ ছবিতেও অল্প সময়ের একটি রোলে অভিনয় করেন সুদীপ। এবার বেশ অনেকদিন পর আবার লম্বা একটি ট্র্যাকে ফিরলেন ‘জীবন সাথী’ ধারাবাহিকে। নায়িকা ঝিলম ও প্রিয়মের দাদার চরিত্রে অভিনয় করছেন সুদীপ। এহেন সুদীপের সঙ্গে আড্ডা জমল দূরভাষে। সেই কথোপকথনের নির্যাস রইল আপনাদের জন্য।
নবনীতাঃ অভিনয়ের ইচ্ছা কি ছোট থেকেই?
সুদীপঃ আমার বাড়িতে সাংস্কৃতিক আবহ ছিলই। বাবা খুব ভাল আবৃত্তি করতেন। ছোট থেকে বাবার সঙ্গে ছড়া ছড়া খেলা খেলতাম। খেলার সময়েও ছড়া বলতাম। ছ’পাতার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটা আমি বাবার মুখে মুখে শুনেই মুখস্থ করে ফেলেছিলাম দু’পাতা। মা গান গাইতেন। মঞ্চেও গেয়েছেন অনেকবার। অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ ওই তখন থেকেই।
নবনীতাঃ তুমি থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ডের। শুরুয়াতটা কীভাবে?
সুদীপঃ হ্যাঁ আমি রবীন্দ্র ভারতীতে নাটক নিয়ে পড়াশুনা করেছি। পাশাপাশি শাঁওলি মিত্রর নাটক দল ‘পঞ্চম বৈদিক’-এ অভিনয় করি। শাঁওলি দি আর অর্পিতা দি আমার গুরু। এই দুজন না থাকলে নাটক করা হত না। আর ধারাবাহিক তো নয়ই। অনেক শিখেছি দুজনের কাছেই। মঞ্চ এবং পর্দার সামনে কী ভাবে দাঁড়াতে হয় তা আমায় শিখিয়েছেন অর্পিতা ঘোষ এবং শাঁওলি মিত্র। ওঁদের হাত আমার মাথার উপরে না থাকলে কিছুই হত না।
নবনীতাঃ ‘ইষ্টি কুটুম’ ধারাবাহিকে একেবারে অন্য কায়দায় কথা বলতে হয় তোমাকে। রপ্ত করেছিলে কীভাবে?
সুদীপঃ রনিতারা (বাহামণি) এক মাসের ওয়ার্কশপ করেছিল। আমি সেটা করিনি। প্রথম দিনই ছিল পুরুলিয়ায় শুট। আর প্রথম সিনই ছিল আমার কঙ্কা মা অর্থাৎ অনুশ্রী দাসের মতো একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে। প্রথম দিনই গিয়ে দেখি প্রায় দেড় পাতার মতো একটা সংলাপ বলতে হবে সাঁওতালি ভাষায়। খুব একটা অসুবিধা হয়নি। লীনা দি এবং পরিচালক গাইড করেছিলেন। তারপর স্ক্রিপ্ট পড়ে পড়েই রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া ‘কেয়া পাতার নৌকো’তেও আমায় বাঙাল ভাষায় কথা বলতে হয়। সেটাতে আমার একেবারেই অসুবিধা হয়নি। কারণ আমি নিজে কাঠ বাঙাল। দেশ বরিশাল। ফলে, বাঙাল ভাষা আমার রক্তেই আছে।
নবনীতাঃ মঞ্চ এবং টেলিভিশন দুই প্ল্যাটফর্মেই তোমার বিচরণ। মঞ্চ নাকি টেলিভিশন কোন প্ল্যাটফর্মটা তোমার কাছে বেশি আদরের?
সুদীপঃ মঞ্চ এবং টেলিভিশন দুটি জায়গাই সমান আদরের। দুটোই সমান প্রিয়। শাঁওলি মিত্রর ‘পঞ্চম বৈদিক’ নাট্যদলে আমার অভিনয়ের পাঠ। তাই তাকে ছেড়ে আমি যাব না কখনও। রবীন্দ্র ভারতীতে আমি নাটক নিয়ে লেখাপড়া করেছি বটে; কিন্তু হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন ওই দুজন মানুষ।
নবনীতাঃ ‘জীবন সাথী’তে তোমার চরিত্রটা কেমন?
সুদীপঃ ‘জীবন সাথী’ নিয়ে বলা শুরু করার আগেই বলি স্নেহাশিস দা’র (চক্রবর্তী) কথা। ওঁর মতো প্রযোজক বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে কমই আছেন বলে আমার মনে হয়। স্নেহাশিস দা এমন একজন প্রযোজক যাকে নিজের যে কোনও অসুবিধার কথা বলা যায়। সবরকমের কথা আলোচনা করা যায়। একইভাবে ধারাবাহিকের প্রত্যেকটি চরিত্র সম্বন্ধে দাদার সম্যক জ্ঞান থাকে। আর সেটা সকলকে তিনি বুঝিয়েও দেন খুব সুন্দরভাবে।
স্নেহাশিস’দা পরপর দুটো ধারাবাহিকে আমায় গুরুত্বপূর্ণ দুটি চরিত্রে ভরসা করলেন৷ আমি ধন্য। প্রথমে ‘বিকেলে ভোরের ফুল’, আর এবার ‘জীবন সাথী’। ওঁর কাছে শেখার আছে অনেককিছু। অমন মানুষের অনুগত হব না তো কার অনুগত হব? ও হ্যাঁ, জীবন সাথী নিয়ে জানতে চাইছিলে। আমার একেবারে পজিটিভ একটা রোল এখানে।
গল্পের দুই নায়িকা ঝিলম ও প্রিয়মের দাদা আমি। আরেকজন বোনও আছে অবশ্য। আমি সকলের বড় দাদা। আমি চাকরি করি। বোনদের সব ব্যাপারে সাপোর্ট করি আমি। সুখের সংসার আমাদের।
আরও পড়ুনঃ ‘হাসিওয়ালা অ্যান্ড কোম্পানি’র হোস্ট যিশু সেনগুপ্ত
ঝিলম যখন সংকল্পের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে তার ভালোবাসা তুর্ণর কাছে চলে যায় তখন আমি প্রিয়মকে রাজি করাই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে। আমার এরকমই নানা ভূমিকা দর্শক দেখবেন ধারাবাহিকে। সবমিলিয়ে দারুণ একটা চরিত্র।
নবনীতাঃ ছোটপর্দায় ব্যস্ত তুমি। কখনও বড় পর্দায় বড় অফার পেলে ছোটপর্দা ছেড়ে দেবে?
সুদীপঃ একেবারেই না। টেলিভিশন আমাকে পরিচিত করেছে। সবচেয়ে বড় সত্যি কথা কী জানো তো? সকলেরই নিজের ব্যাপারে সম্যক ধারণা থাকা উচিত। আমি খুব ভাল করেই জানি, আমি কোনওদিন দেবের মতো অভিনেতা হতে পারব না। আমার হাইট বলো বা আমার লুক কিংবা অভিনয়ের ধরন কোনওকিছুই আমাকে কখনও অ্যাকশন হিরো করতে পারবে না৷
আমি সাহিত্যধর্মী ছবির নায়ক হলেও হতে পারি। আর তুমি যে বললে না, বড় অফার? সেটা পেলে অবশ্যই করব। আর ভাল চরিত্র পেলে তবেই করব। যেখানে আমার কিছু করার থাকবে স্ক্রিনে। লোক আমার দিকে চোখ দেবে। তবে, কোনও মূল্যেই আমি টেলিভিশন কিংবা মঞ্চ ছেড়ে দেব না।
নবনীতাঃ এই লকডাউনে অনেকে অনেককিছু বানাল সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে মেলে ধরার জন্য। তুমি কী করলে?
সুদীপঃ সবাই করল। তাই আমি কিছু করলাম না তেমন। দর্শক হতে ভাল লাগে আমার। তবে, আমার স্ত্রী মিতা খুব ভাল ডান্সার। আর আমি কবিতাটা বলি। সেই কবিতা আর নাচের একটা মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলাম আমরা। আমাদের সঙ্গে ছিলেন আমাদের বন্ধুরা- দ্রাবিণ চট্টোপাধ্যায়, বাপ্পা আর বুবুন। ওই অবধিই। আর বিশেষ কিছু করিনি।
তাছাড়া আমি কোনও একটা কাজ করেই তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী নই। নিজেই নিজের বড় সমালোচক আমি। খুঁতখুঁতেও বটে। কাজ শেষ করেই ভাবি– “ওটা আরেকটু ভাল করা যেত। ওটা ওরকম করলে কেমন হত?”– এইসব আর কী। তাই একটা কিছু করলাম আর সেটা ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিলাম ওটা আমার দ্বারা হয় না। আমি পারি না।
নবনীতাঃ স্ত্রী’ও তার মানে সংস্কৃতিপ্রবণ?
সুদীপঃ একদম। ও আসলে ইঞ্জিনিয়ার। পাশাপাশি নাচটাও করে। আমার জীবনে মিতার ভূমিকা অনেক। শিল্পীদের সবসময় কাজ থাকে না। আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছে সেটা। সেই সময় আমাকে ধৈর্য না হারিয়ে সিদ্ধান্তে অবিচল থাকতে শিখিয়েছে আমার স্ত্রী মিতা।
নবনীতাঃ ভাগ্যে বিশ্বাসী?
সুদীপঃ কাজ আর ঠাকুরে বিশ্বাসী। আমার যখন দু’বছর বয়স তখন থেকে আমি পুজো করি। মন্ত্র বলি। বাবা অফিসে যাওয়ার সময় বলত, কী আনব ফেরার সময়? আমি আধো আধো উচ্চারণে বলতাম – “ফুল আর মালা আনবে।” আমি আজও পুজারি। পুজো না করে ঘর থেকে বেরোই না। আমার বিশ্বাস, যদি সিদ্ধান্তে অচল থাকি, কারো যদি ক্ষতি না করে থাকি কাজ আর ভাগ্য আমায় সঙ্গ দেবেই৷
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584