মুখোমুখি নবনীতা দত্তগুপ্ত
“এক আত্মীয় তো মাকে বলেছিল, তোমার ছেলে অভিনয় করতে কলকাতা গেছে? নাকি হিজড়ে হতে গেছে? এতে আমার মা ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল।”- নবনীতা দত্তগুপ্তকে জানালেন রূপান্তরকামী অভিনেত্রী সুজি ভৌমিক।
নবনীতাঃ এই লকডাউনে সময় কাটল কীভাবে?
সুজিঃ লকডাউনে আমার হোমটাউন বহরমপুরে গিয়েছিলাম। মা, বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গেই কাটল। মায়ের হাতের রান্না খেয়ে আর ল্যাদ খেয়ে কাটিয়ে দিলাম। এখনও তো সেভাবে আমার এই সুজয় থেকে সুজি হয়ে ওঠাটা পরিবার মেনে নেয়নি, তাই টুকটাক কথা হয়েছে। কথায় আছে না-“দূরে থাকলে হামলায় আর কাছে থাকলে কামড়ায়।”
আমার ক্ষেত্রেও বাড়িতে গেলে সেটা হয়। দূরে থাকি তাতে বাবা-মায়ের কষ্ট হয়। আমাকে চোখে হারায়। আর সামনে যাই যখন সুজিকে নিয়ে নানা কথা আর আপত্তির সুর। তবে, আমিও বুঝি ওদের যন্ত্রণাটা। আত্মীয়স্বজনদের কাছে অনেকরকম বাঁকা কথা শুনতে হয় ওদের। এক আত্মীয় তো মাকে বলেছিল, তোমার ছেলে অভিনয় করতে কলকাতা গেছে? নাকি হিজড়ে হতে গেছে? এতে আমার মা ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল। শত হলেও মা তো।…
নবনীতাঃ তুমি তো বহরমপুরের বাসিন্দা। কলকাতায় আসা কি অভিনয়ের কারণেই? নাকি হায়ার এডুকেশন এখান থেকে?
সুজিঃ সুজয় থেকে সুজি হয়ে ওঠার জন্য আমার কলকাতায় পা রাখা। আমার পাস কোর্সে গ্র্যায়জুয়েশন বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে। তখন ওখানেই নাটক করতাম। ওখানে একবার কলকাতা থেকে নাটকের জাজমেন্ট করতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রভারতীর ‘ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিক ডিপার্টমেন্ট’-এর বিভাগীয় প্রধান গৌতম ঘোষ। আমার অভিনয় ওঁর মনে ধরে। তিনি আমাকে বলেন নাটক নিয়ে পড়াশুনা করতে।
ওটা একটা ছুতো হয়ে যায় আমার কলকাতায় থাকার। ফাইনালি অবশ্য পড়াটা হয়নি। কলকাতায় আসার পিছনে আরও দুজনের অবদান আছে। তাঁরা হলেন বিভাস চক্রবর্তী এবং ঊষা গাঙ্গুলি। বিভাস চক্রবর্তীর হাত ধরেই আমার কলকাতায় আসা। ‘অন্য থিয়েটার’-এ আমি অভিনয় করতাম। কলকাতায় এসে নিজের মোড়কটা খুলতে পেরেছি আমি। ‘অন্য থিয়েটার’-এ নাটক করাকালীনই আমি নান্দিকারে ওয়ার্কশপ করি।
নবনীতাঃ তোমার কলকাতায় চলে আসাটা বাবা-মা মেনে নিয়েছিলেন?
সুজিঃ মানাতে কষ্ট তো হয়েছিল। তবে, বাবা-মা পাঠিয়েছিলেন সুজয় হিসেবে। আমি সুজি হয়ে যাব ওরা ভাবেনি। বাবাকে বলেছিলাম আমি এক বছর থাকব কলকাতায়। তার মধ্যে আমি কিছু একটা করে দেখাব। আমায় কিছু টাকা দাও। বাবা সেদিন না করেনি। ওই দিন বাবার কাছ থেকে সাপোর্টটা পেয়েছিলাম।
আমাকে প্রতিদিনের খরচ লিখে রাখতে হত ডায়েরিতে। বাবাকে খরচের হিসেব দিতে হত আমায়। বাবা-মা সেদিন ভরসা রেখেছিল আমার উপর যে তাদের ছেলে কিছু না কিছু একটা করবেই। তবে, বাবা এখনও বলে, বহরমপুরে থাকলে এতদিনে একটা চাকরি জুটে যেত।…
নবনীতাঃ একটা প্রশ্ন, সুজয় থেকে সুজি হয়ে ওঠাটা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
সুজিঃ চ্যালেঞ্জিং মানে? কত প্রশ্ন আর কত ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছি, বলে শেষ করতে পারব না নবনীতা দি। বহরমপুরে যখন থাকতাম তখন মা সারাক্ষণ চাপে রাখতেন। তখন আমি সুজয় হয়েই বেরোতাম বাড়ির বাইরে। তবে, খালি ভাবতাম আমার হাঁটা দেখে হয়ত সবাই মুচকি হাসছে, বলাবলি করছে। সকালে নেলপালিশ পরতাম, বিকেলে নেলপালিশ তুলে রিহার্সালে যেতাম। এটা বহরমপুরেও হয়েছে কলকাতাতেও হয়েছে। আমাকে এখানে এসে পুরুষের পোশাকই কিনতে হত। কারণ খরচের হিসেবটা বাবাকে দেখাতে হত৷ মেয়েদের পোশাক পরতে ইচ্ছে হত। কিন্তু কোথায় পাব? কিনতে পারতাম না তো। তখন আমার পাশে এসে দাঁড়ায় আমার দুই বন্ধু সুজয় এবং সুমন। ওই সুজয়ের রূপান্তরিত নাম সুজান। ওরা আমাকে মেয়েদের পোশাক দিত। আর সেই পোশাক পরে আমি নিজের মনের যত্ন নিতাম। তৃপ্ত হতাম।
আমার মা জানতে পেরে বলেছিল- “এগুলো যদি তুই বহরমপুরে এসে করিস আমি গলায় দড়ি দেব।” আর মজার কথা শুনবে? সেই মা আমার জন্য বছর দুয়েক হল শাড়িও কেনে। এবার পুজোয় জামদানি শাড়ি কিনেছে। লকডাউনে একটা গাউন কিনে দিয়েছে। পরা হয়নি এখনও। মা এখানে এলে আমার শাড়ি পরে। আর আমি তো মায়ের শাড়ি পরিই।
নবনীতাঃ এটা কিন্তু তোমার অনেক বড় পাওয়া।
সুজিঃ শুধু পাওয়া? নিজেকে জয়ী বলে মনে হয় তখন, মা যখন আমার জন্য শাড়ি কেনে কিংবা আমার শাড়ি পরে।
আরও পড়ুনঃ বিয়ে সারলেন মানালি-অভিমন্যু
নবনীতাঃ তুমি তো থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ডের। কখনও এমন কোনও পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে যে তোমাকে কোন চরিত্রে দেওয়া হবে মানে পুরুষ নাকি মহিলা এই নিয়ে মতপার্থক্য হয়েছে…
সুজিঃ আমাকে সবাই পুরুষ চরিত্রই দিত গো। কিংবা ক্যারিক্যাচারের চরিত্র। মানে মেয়েলি পুরুষের চরিত্র। যা দেখে সবাই হাসবে। কাজ চাইতে গেলে আমাকে বলা হত, আমার মতো যখন কোনও অর্ধনারীশ্বরের চরিত্র আসবে তখন আমায় ডাকা হবে। কিন্তু একবার যখন এক বলিষ্ঠ অর্ধনারীশ্বর চরিত্রে আমার অভিনয় করাটা পাক্কা ছিল সেই বার দেখলাম, আমি না অভিনয়টা করল একজন পুরুষই। সেদিন খুব আঘাত পেয়েছিলাম।
নান্দিকারে ওয়ার্কশপ করার সময় একবার আমায় বলা হল রাজার মতো হেঁটে দেখাতে। সতীর্থরা সেদিন পরিহাস করে বলেছিল -“হ্যাঁ রে, তুই রাজার মতো হাঁটবি নাকি রানির মতো?” আমি বলেছিলাম, আমি অভিনয়টা করব। আমার হাঁটা হয়ে গেলে ওয়ার্কশপের প্রশিক্ষক ঝুলন দি আমায় জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন- “তোমরা সবাই দেখো আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। সুজি যখন হাঁটছিল আমার মনে হচ্ছিল একজন রাজাই হেঁটে যাচ্ছে!” আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল সেদিন অনেকটা।
নবনীতাঃ আজকাল আর থিয়েটার করা হয়?
সুজিঃ না। অনেক আঘাত থেকে সরে এসেছি। কলকাতায় এসেছি লড়াই করতে, সুজি হয়ে উঠতে। থিয়েটারে আমি সুজি হিসেবে চরিত্র পেতাম না। পেতাম সুজয় হিসেবে। শুধুই পুরুষ কিংবা ক্যারিকাচারের চরিত্র পেয়েছি। থিয়েটারের পয়সায় পেট চলত না। নাটক থেকে এই সব কারণেই সরে আসা। ২০১৪-১৫-তে নাটক থেকে বেরিয়ে এসে ঠিক করলাম আর চুল কাটব না।
এবার থেকে আমি সুজিই হব। লড়াই করব সুজি হয়েই। পুরুষ চরিত্র করার সময় মনে হত নিজেকে ঠকাচ্ছি। অনেক আঘাত নিয়ে গোয়া চলে গেলাম এরপর। ভেবেছিলাম ওখানেই বন্ধুদের সঙ্গে কাজ করব৷ আর বহরমপুরে ফিরব না। কিন্তু মন পড়ে থাকত সেই অভিনয়ে। তবে, বেশিদিনের জন্য নয়। কারণ টাকা পাব কোথায়? কে দেবে ওখানে আমায় অভিনয় করার সুযোগ? ফিরেও এলাম আবার এই শহরেই।
নবনীতাঃ এই শহরে কোনও ভাল পাওয়া?
সুজিঃ হ্যাঁ আছে তো। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল মোশন পিকচার্স’-এ একটা টেস্ট দিতে গিয়েছিলাম। সেখানে ফাল্গুনি চট্টোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি দা, লাবণী দি ছিলেন। আমাকে শাশুড়ির চরিত্র করে দেখাতে হয়। আমি অভিনয়টা করার পর আমায় লাবণী দি, ফাল্গুনি’দা বলেছিলেন – “একজন মেয়েও এত সুন্দর শাশুড়ির অভিনয় করতে পারেন না যেমনটা তুমি করলে।” সেদিন আমার আত্মবিশ্বাস অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। ওঁদের মতো অভিনেতাদের কাছ থেকে নিজের প্রশংসা শুনে খুব ভাল লেগেছিল। মনে মনে নিজেকে আরও ভাল করে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম।
নবনীতাঃ কী ধরনের চরিত্রে অভিনয় করার শখ তোমার?
সুজিঃ পছন্দের চরিত্র অনেক আছে জানো তো? আমি ত্রিকোণ প্রেমের প্রেমিকার চরিত্র চাই। যে প্রেমিকা অবহেলিত। যাকে প্রেমিক বিয়ে করতে চায় না। আমাদের লুকিয়ে লুকিয়ে অনেকেই প্রেম নিবেদন করে। কোথাও গিয়ে সেই অবহেলিত প্রেমিকার সঙ্গে আমাদের জীবন মিলে যায়। হোক না ট্রান্সদের নিয়ে আরেকটু গল্প। আসি না আমরা আমাদের মতো করে কোনও চরিত্রে। কনসেপ্ট লাগলে আমরা দেব৷ অনেক আছে।
নবনীতাঃ একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে হয়, মন তোমাকে যখন অন্য কথা বলত পরিবার তখন কী বলত?
সুজিঃ সুজয় হয়েই থাকতে বলত। আজও সেটাই বলে।
আরও পড়ুনঃ আসছে ‘সারেগামাপা ২০২০’
নবনীতাঃ এই সময়ে দাঁড়িয়ে কী ধরনের গল্প বাংলা টেলিভিশনে দেখালে ভাল হবে বলে একজন অভিনেত্রী সর্বোপরি একজন দর্শক হিসেবে মনে হয় তোমার?
সুজিঃ শাশুড়ি-বউমার ঝগড়া, লড়াই দেখতে দর্শক আর ভালোবাসে না। প্রত্যকের সংসারে সমস্যা আছে। আর এই লকডাউনে সাংসারিক সমস্যা, জটিলতা বহুগুণে বেড়ে গেছে। ফলে, টিভিতেও নিজেদের ঘরের চিত্র দেখতে মানুষের আর ভাল লাগে না। তাই এমন কিছু দেখাক যা সমাজের কথা বলে। ধারাবাহিক তো সমাজ নিয়ে কথা বলে। ট্রান্স’রা তো সমাজেরই মানুষ। তাদের নিয়ে গল্প বাঁধা হোক না। দেখি না একজন ট্রান্স পিসি, ট্রান্স কাকা কিংবা ট্রান্স ননদ কিংবা প্রেমিকাকে দর্শক কী ভাবে নেয়। সমাজ পাল্টেছে। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টেছে। ব্যতিক্রম নেই বলব না। ‘নগরকীর্তন’ একটাই কেন হয় বাংলায়? আর হতে পারে না? দর্শক হল আসল বিচারক। তাদের বিচার শেষ বিচার। তারা সেরাটা ভালোবাসে। কোনওরকম পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই। তারা নতুনের খোঁজে থাকে। তাই গল্পভাবনায় নতুনত্ব থাকা আবশ্যক বলে মনে হয় আমার। অভিনেত্রী হিসেবে নয়, সাধারণ দর্শক হিসেবে।
নবনীতাঃ বড় পর্দাতেও কাজ করেছো, ওয়েব সিরিজও করেছো। অভিজ্ঞতা কেমন?
সুজিঃ খুব ভাল। শতাফ ফিগার, মিমি চক্রবর্তীর সঙ্গে ‘মন জানে না’ তে অভিনয় করেছি। খুব ভাল অভিজ্ঞতা৷ মিমির সঙ্গে একই লিফটে যেতে যেতে আমি একটা সেলফি চাইলে মিমি বলেন, এখন কাজলটা ঘেটে আছে। আমি টাচ আপ দিয়ে সেলফি তুলব। তারপরে সেদিন আর সেলফি তোলা হয়নি আমার। পরদিন আমায় একজনকে দিয়ে ডেকে পাঠান মিমি। তারপর তোলা হয় সেলফি। অবাক লেগেছিল সেদিন। মিমির মনে ছিল সেদিন ছবিটা তোলা হয়নি। আর তাতে আমি কষ্ট পেতে পারি। একইভাবে সবাই আমরা একসঙ্গে একই মেক আপ ভ্যান ব্যবহার করতাম। এস ভি এফ আমাকে খুব কদর করেছে। টাকা যা চেয়েছিলাম তাই পেয়েছি। ‘মন্টু পাইলট’ রিলিজ করার পর পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য আমায় বলেন- “তোমার মধ্যে রিয়েল অভিনয়ের ক্ষমতা আছে। তুমি ছেড়ে দিও না। আমরা আবার একসঙ্গে কাজ করব। ইউনিটের সবার কাছ থেকে খুব সহায়তা পেয়েছি। সুব্রত দা (দত্ত), চান্দ্রেয়ী দি (ঘোষ) সবাই আমাকে খুব সাপোর্ট করেছেন। খুব মজা করে কাজ করেছি।
ঋতু দি’র সঙ্গে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। রাত দু’টোর সময়েও হোয়াটস আপে আমাদের অনেক কথা হয়। একবার দিদির ব্র্যান্ডের একটা র্যাম্প শো-তে আমি, স্বস্তিকা দি আর ঋতুদি একসঙ্গে শো স্টপার ছিলাম। আমিই প্রথম কোনও ট্রান্স যে কিনা কোনও মেন স্ট্রিম ফ্যাশন শো তে শো স্টপার ছিলাম। নিজেকে সেদিন ধন্য মনে করেছিলাম।
নবনীতাঃ এই পুজোটা অন্যরকম একদম। কী প্ল্যানিং?
সুজিঃ বহরমপুরে যাব। মা, বাবা, ভাইয়ের সঙ্গেই কাটাব পুজো। মা শাড়ি কিনেছে আমার জন্য। পরতে তো হবেই।
নবনীতাঃ অনেক ট্রান্স-এর মধ্যে সন্তান দত্তক নেওয়ার বাসনা থাকে। তোমারও কি সেরকম ইচ্ছা আছে?
সুজিঃ এখনও সেভাবে ভাবিনি। নিজের জায়গাটা এখনও শক্ত হয়নি। শক্ত করতে পারলে হয়ত নেব।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584