বৈষ্যমের বীজ সমাজের গভীরে প্রোথিত, তবু নারী চায় সম্পূর্ণ আকাশ

0
75

শুভশ্রী মৈত্র

৮ মার্চ বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ যদিও দিনটি আসলে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস’। বছরে এই একটা দিনই কেন নারী দিবস? অন্য দিনগুলো কি তবে পুরুষদের? এই প্রশ্নের উত্তর কখনই এক কথায় হ্যাঁ বা না তে দেওয়া যাবে না।

International Womens day in Russia | newsfront.co
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সেন্টপির্টাসবার্গে আন্তর্জাতিক নারী দিবস

১৯০৮ সালে আমেরিকার বস্ত্র শ্রমিকরা নিউ ইয়র্কে তাঁদের কাজের সম্মান আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘট শুরু করেন। নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী কাজ আর পুরুষ শ্রমিকদের সমমানের বেতনের দাবিতে চলে বনধ। অবশেষে আসে জয়, ১৯০৯ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকায় প্রথম পালিত হয় ‘জাতীয় নারী দিবস’।

১৯১০ সালে কোপেনহেগেনের উদ্যোগে ১৯ মার্চ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইৎজারল্যান্ডে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস চিহ্নিত হয়েছিল। নারীর কাজের অধিকার, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং কাজের বৈষম্যের অবসানের জন্য প্রতিবাদ করেন অগণিত মানুষ। একই সঙ্গে রাশিয়ান মহিলারাও প্রথমবার ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘রুটি ও শান্তি’র দাবিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরোধিতা করেন।

ইউরোপের নারীরা ৮ মার্চ বিশ্ব শান্তির দাবীতে বিশাল মিছিল আয়োজন করেন। ১৯১৩-১৯১৪ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিবাদ জানানোর একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে। আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ দিনটিকে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্বজুড়ে সামাজিক ক্ষেত্রে ও কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ সাম্যের উদ্দেশ্যে এই বিশেষ দিনটি পালন করা হয়।

এতো গেল দিনটির আনুষ্ঠানিক দিকের কথা,  কিন্তু প্রশ্ন হল এত বছরের এত নারীদের এত সংগ্রাম থেকে প্রাপ্তি ঠিক কতটা নাকি বিষয়টা শুধুই একটা ‘দিন’ হিসেবেই থেকে গেলো!

আসলে সমাজে লিঙ্গ বৈষম্যের বীজ এতটাই গভীরে প্রোথিত যে অনেককিছুই আমরা কিছুটা ‘স্বাভাবিক’ বলেই মানতে শিখেছি অর্থাৎ অভ্যেস করে ফেলেছি। ফলত, আজও নারীদের প্রাপ্য অধিকার কোনটা এবং তা থেকে আমরা বঞ্চিত কিনা সে হিসেবটা কষতে হয়, সেই স্বভাবিক অধিকার পাওয়ার জন্য আন্দোলন করতে হয়।

পরিস্থিতি আসলে এমনই যে, বিভিন্ন সংস্থাকে এখনো কাজ করতে হয়, সমীক্ষা করতে হয় মহিলাদের অবস্থান নিয়ে; আর সেই সব ফলের ওপর ভিত্তি করে দেশের সরকার করে নারী অধিকার সুরক্ষার বন্দোবস্ত।

অতি সম্প্রতি সারা বিশ্ব মুখোমুখি হয়েছে করোনা ভাইরাস অতিমারির। স্বাভাবিক ভাবেই শুধু স্বাস্থ্য ক্ষেত্র নয় সর্বত্র দেখা গেছে অতিমারির প্রভাব। সারা বিশ্বের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের কর্মজগত থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি স্তরে। এই বিষয়ে খোঁজ করতে গিয়েও দেখা গিয়েছে লিঙ্গ বৈষম্য কিভাবে আমাদের দেশে আষ্টেপৃষ্ঠে রয়েছে এখনও। দেখা যাক তার কিছু উদাহরণ…

ঠিক নারী দিবসের আগেই প্রকাশিত হয়েছে লিঙ্কডেইনের একটি তথ্য, LinkedIn Opportunity Index 2021, যেখানে দেখা যাচ্ছে ১০ জনের মধ্যে ৯ জন মহিলা বা ৮৯% মহিলার কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ৮৯% মহিলা তাঁদের প্রাপ্য প্রোমোশন পাননি, বেতন বৃদ্ধি হয়নি। কিন্তু কেন? পুরুষ কর্মীদের ক্ষেত্রটা একটু ‘আলাদা’, সোজাসুজি মহিলা বলেই তাঁরা অবহেলিত।

অতিমারির ফলে আমারা দেখেছি ওয়ার্ক ফ্রম হোম, বৈষম্য সেখানেও। বাড়িতে আছেন বলে বাড়ির কাজেও সমান নজর দিতে হচ্ছে অর্থাৎ একই সঙ্গে দু’ধরণের কাজই করতে হচ্ছে ফলত মহিলার হাতে উদ্বৃত্ত সময় বলে কিছু থাকছে না, ৭০% শতাংশ মহিলার সমস্যা।  চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও ৫০% মহিলা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার, বলছে সমীক্ষা। ৭১% মহিলা কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের সমান দায়িত্বপূর্ণ পদের যোগ্য হওয়া সত্বেও পাননা, ধরেই নেওয়া হয় পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতেই বুঝি তাঁর সময় চলে যাবে। ৩৭% মহিলা মনে করেন কর্মক্ষেত্রে তাঁরা সুযোগ পান পুরুষদের তুলনায় কম এবং বেতন ও পান পুরুশকরমির তুলনায় কম। যথাক্রমে ২৫ ও ২১ শতাংশ পুরুষ দুটি বিষয়ই স্বীকার করেন।

আরও পড়ুনঃ বিস্মৃত বাঙালি রেজিমেন্টের ইতিহাস

এ তো গেলো মহিলাদের কর্মক্ষেত্রের বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য প্রসঙ্গে দেখলে চোখ কপালে ওঠে আমাদের মত ‘প্রিভিলেজড’ মানুষদের।

‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ বা ডাব্লিউইএফ-এর রিপোর্টে লিঙ্গ বৈষম্যের নিরিখে বিশ্বের ১৪২টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১১৪তম৷ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে ভারতের নারীরা ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার হন।

রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টিতে ভারতের অবস্থান তুলনায় ভালো; সূচকে ১৫তম অবস্থানে রয়েছে আমাদের দেশ কিন্তু উপার্জন, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র ও সন্তান জন্মদানের ব্যাপারে বৈষম্য ভয়াবহ৷ সূচকে সবচেয়ে খারাপ ২০টি দেশের মধ্যে একটি ভারত। কর্মক্ষেত্রে একজন নারীকে পুরুষের তুলনায় ৩০০ মিনিট বেশি কাজ করতে হয় সেই তুলনায় বেতন নারীদের কম৷ ভারতে কন্যাভ্রূণ হত্যা ব্যাপকভাবে হয়ে আসছে, বছরে ১,০০০ টি ছেলে শিশুর জন্ম হলে সেখানে মেয়ে শিশু জন্ম নেয় ৯১৮ জন৷ নারীদের ওপর ঘটা অপরাধ এবং ধর্ষণে ভারত অন্যান্য অনেক দেশকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। সর্বোপরি, গার্হস্থ হিংসা, মহিলাদের ওপর ঘটা অপরাধের প্রবণতা কমার বদলে বেড়েই চলেছে।

তাহলে কি এত নারী আন্দোলন সব বৃথা গেল? অবশ্যই নয়, সমাজের সর্বস্তরের মহিলারা সচেতন হচ্ছেন তাঁদের অধিকার নিয়ে, কথা বলছেন সমস্যা নিয়ে মুখ খুলছেন; কিন্তু লিঙ্গ সাম্যের অধিকারের লড়াই এখনও অনেক বাকি, যেতে হবে অনেকটা পথ। নারী অর্ধেক আকাশ চায়না, গোটা আকাশজুড়ে হোক তার বিচরণ।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here