অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, স্পোর্টস ডেস্কঃ
দশম রাউন্ডের শেষে আইএসএল টেবলে যে দুটি মাত্র দল তাদের শেষ পাঁচ ম্যাচে অপরাজিত ছিল, তাদের মধ্যে একটি মুম্বই সিটি এফসি ও দ্বিতীয়টি এসসি ইস্টবেঙ্গল। গত ম্যাচে লিগের অন্যতম সেরা দল বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে তাদের ১-০ গোলে জয়টা যেমন এসসি ইস্টবেঙ্গল শিবিরে আত্মবিশ্বাসের স্তরকে এক লাফে অনেক উঁচুতে তুলে দিয়েছে, তেমনই এই পরিসংখ্যানটাও তাঁদের আরও অনেকটা অক্সিজেন জোগাচ্ছে।
এই বাড়তি আত্মবিশ্বাস ও অক্সিজেন নিয়েই শুক্রবার কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি-র বিরুদ্ধে নামতে চলেছে লাল-হলুদ বাহিনী। উদ্দেশ্য একটাই, ফের জিতে আরও তিন পয়েন্ট অর্জন করে লিগ টেবলে আরও একটু ওপরে ওঠা। কেরালা ব্লাস্টার্স শেষ পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে দু’টিতে জিতলেও দু’টি হার ও একটি ড্র কিবু ভিকুনার দলকে বেশ পিছিয়ে দিয়েছে। রবি ফাউলারের ছেলেরা যেখানে নয়ে, সেখানে কিবুর দল দশে। শুক্রবার তিলক ময়দানে নয়-দশের এই লড়াই কতটা জমজমাট হয়ে ওঠে, সেটাই দেখার।
গত শনিবার ফতোরদা স্টেডিয়ামে ২০ মিনিটের মাথায় ম্যাটি স্টাইনমানের গোলে গতবারের সেমিফাইনালিস্ট বেঙ্গালুরু এফসি-কে হারানোর পর থেকে লাল-হলুদ শিবির চনমনে। এসসি ইস্টবেঙ্গল প্রথম পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে চারটিতেই হারে ও একটিতে ড্র করে। এই পাঁচ ম্যাচে দু’টি গোল দিয়ে দশটি গোল হজম করে তারা। কিন্তু শেষ পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে দু’টিতে জয় আসে ও তিনটি ম্যাচ ড্র হয়। এই পাঁচ ম্যাচে আটটি গোল দিয়ে পাঁচটি গোল খায় তারা।
এই পরিসংখ্যানই বুঝিয়ে দিয়েছে সম্প্রতি কতটা উন্নতি করেছে তারা। চলতি মাসের শুরুতেই রাজু গায়কোয়াড়, অঙ্কিত মুখার্জিকে পাওয়ায় যেমন দলের ডিফেন্স আরও শক্তিশালী হয়েছে, তেমনই নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার ব্রাইট ইনোবাখারেকে পেয়ে যাওয়ায় গোল করার ক্ষমতাও বেড়েছে দলের। ফলে চোটের জন্য অ্যান্থনি পিলকিংটন খেলতে না পারলেও ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি। তাঁকে সাহায্য করার জন্য রয়েছেন জাক মাঘোমা, যাঁর পাসিং অ্যাকিউরেসি ৮১ শতাংশ।
আরও পড়ুনঃ স্মিথদেরও আইপিএলে বিরাটদের মতো অবস্থা হয়েছিলঃ পেইন
গত ম্যাচে বিপক্ষের অর্ধে তাঁর পাসিং অ্যাকিউরেসি ছিল একশো শতাংশ। এমন একজন সহায়ক পেয়ে যাওয়ায় ব্রাইট আরও ক্ষিপ্র হয়ে উঠছেন। সাহায্য পাচ্ছেন স্টাইনমানও। এঁরাই এখন রবি ফাউলারের প্রধান ভরসা।
ফাউলার গত ম্যাচে মাঠে থাকতে না পারলেও আগে বারবার বলেছেন, “আমরা ক্রমশ উন্নতি করছি। দলটা তৈরি করার যথেষ্ট সময় না পাওয়ায় প্রথম দিকে সমস্যা হচ্ছিল। এখন দল ক্রমশ তৈরি হয়ে উঠছে। তাই পরের দিকে আমরা অনেক ভাল খেলব।” ব্রাইট আগে এলে আরও ভালো হতো। দেখা যাচ্ছে, প্রধান কোচের কথাই হুবহু মিলে যাচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ লিও নয় অশ্বিনই পারবে ৮০০ উইকেটের কাছাকাছি যেতেঃ মুরলী
গত ম্যাচে বেঙ্গালুরুকে হারিয়ে যেমন আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নিয়েছে এসসি ইস্টবেঙ্গল, তেমনই ছয় নম্বরে থাকা জামশেদপুর এফসি-কে গত রবিবার ৩-২ গোলে হারিয়ে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে কেরালা ব্লাস্টার্স। তার আগের দুই ম্যাচে হেরেছিল তারা। হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধেও জয় পেয়েছিল। এসসি ইস্টবেঙ্গলের সংগ্রহে যেমন জোড়া জয় রয়েছে, কেরলের দলটিও এ পর্যন্ত এই দু’টির বেশি ম্যাচ জিততে পারেনি। ড্রয়ের সংখ্যা একটি কম থাকায় তারা লাল-হলুদ বাহিনীর চেয়ে এক ধাপ নীচে।
মাস খানেক আগে প্রথম লেগে এই কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধেই শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে ড্র করেছিল এসসি ইস্টবেঙ্গল। ৯৫ মিনিট পর্যন্ত বাকারি কোনের নিজগোলে এগিয়ে থাকার পরেও তাদের ১-১ ড্র করে বাম্বোলিমের জিএমসি স্টেডিয়ামের ছাড়তে হয়েছিল শেষ মুহূর্তে পরিবর্ত মিডফিল্ডার জিকসন সিং হেড করে গোল শোধ করে দেওয়ায়। তবে তখনকার এসসি ইস্টবেঙ্গল আর এখনকার লাল-হলুদ ব্রিগেডের মধ্যে অনেক ফারাক। রক্ষণ ও আক্রমণ—দুটোই এখন অনেক বেশি শক্তিশালী।
প্রতি ম্যাচে জাক মাঘোমা ও ব্রাইট ইনোবাখারের জুটি এখন আক্রমণে বিপক্ষের ত্রাস হয়ে উঠছেন। বিপক্ষের ডিফেন্ডাররা তাঁদের দিকে অতিরিক্ত মনযোগ দিয়ে ফেলায় জার্মান মিডফিল্ডার ম্যাটি স্টাইনমান অনেকটাই স্বাধীন ভাবে খেলতে পারছেন ও গোলও দিতে পারছেন। তিনি নিজে যেমন তিনটি গোল করেছেন, তেমন দু’টি গোলে সহায়তাও দিয়েছেন। যদি অ্যান্থনি পিলকিংটন সুস্থ হয়ে ওঠেন, তা হলে এই ম্যাচে তিনি প্রথম এগারোয় থাকবেন কি না, তা নিয়ে এখন চিন্তা করতে হবে ফাউলারকে।
তবে শুক্রবার পিলকিংটনকে পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলে জানিয়ে ফাউলার বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “উল্টোদিকে কারা, তা না দেখেই প্রতিটি ম্যাচকে আমরা এত দিন কঠিন বলে মনে করে এসেছি। প্রতি ম্যাচেই আমরা জেতার কথা ভেবে নেমেছি। আমাদের মানসিকতা এ রকমই। কেরালা ভাল ফর্মে আছে। আবার কিছু দল ভাল ফর্মে নাও থাকতে পারে। তাই বলে তাদের কখনও সহজ প্রতিপক্ষ ভাবি না।”
নিজেদের পারফরম্যান্সে ক্রমশ উন্নতি দেখে খুশি ব্রিটিশ কোচ বলছেন, “যে জায়গায় নিজেদের নিয়ে এসেছি, সেই জায়গায় নিজেদের ধরে রাখতে হবে। এখনও অনেক পয়েন্ট অর্জন করার আছে। বিভিন্ন দল জিতবে, হারবে। আমরা কী করব, সেটা পুরোপুরি নির্ভর করছে আমাদের ওপর। কী ভাবে আমরা প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করব, তার ওপর। আমরা এখন একটা ভাল দল হিসেবে খেলছি এবং ভাল জায়গায় আছি। তবে আবেগে ভাসতে রাজি নই।”
দলের নতুন তারকা ব্রাইটকে নিয়ে কোচের বক্তব্য, “দল যখন উন্নতি করছে, তখন কেউ সেই দলে যোগ দিয়ে যদি খুব তাড়াতাড়ি কিছু ভাল গোল উপহার দিয়ে কার্যকরী হয়ে ওঠে, তখন সেই দলে উন্নতি হবেই। ব্রাইট দারুণ ছেলে, ও খেলাটা খুব উপভোগ করে। ভাল খেলোয়াড়রা তাদের চারপাশেও কিছু ভাল খেলোয়াড়কে খুঁজে নেয় একটা ভাল দল তৈরি করার জন্য।”
কেরালা ব্লাস্টার্সও যে এখন আগের চেয়ে উন্নত ফুটবল খেলছে, তা গত ম্যাচে তাদের মরিয়া ফুটবল দেখেই বোঝা গিয়েছে। ৬৭ মিনিটের পর থেকে দলটা ১০ জনে হয়ে যাওয়ার সময়ে ম্যাচের ফল ছিল ১-১। দলের ফুলব্যাক লালরুয়াথারা লাল কার্ড দেখার পরে জর্ডান মারে তিন মিনিটের মধ্যে দু’টি গোল করেন। নেরিয়ূস ভাল্সকিস একটি গোল শোধ করতে পারলেও অন্যটি পারেননি।
এই জয়ের পরে গতবার মোহনবাগানকে হিরো আই লিগ খেতাব এনে দেওয়া কেরালা ব্লাস্টার্সের কোচ কিবু বলেন, “আমার দলের ছেলেরা আজ বুঝিয়ে দিয়েছে কত দৃঢ়চরিত্রের ওরা। আজ আমরা একটা বিপজ্জনক দলকে হারিয়েছি, যারা অনেক ভাল ভাল দলকে হারিয়েছে। বিশেষ করে সেটপিসে ওর খুবই ভয়ঙ্কর”। এমন এক দলকে হারানোর আত্মবিশ্বাস তো পরের ম্যাচে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেনই মারে, কোস্তা, কার্নেইরো, সাহাল, গ্যারি হুপাররা।
তাঁদের কোচ বলছেন, “ফুটবলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার গোল না খেয়ে গোল দেওয়া। কিন্তু কেউ যদি যত গোল খেয়েছে, তার চেয়ে বেশি গোল করে, তা হলেও সে মানসিক ভাবে শক্তিশালী থাকতে পারে। আমরা এই জায়গায় ভারসাম্য আনতে চাই। গোল খেতে পারি। কিন্তু তার চেয়ে বেশি গোল দিতে হবে। সে জন্য ফর্মেশনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোন ফর্মেশনে খেলে আমরা সাফল্য পাচ্ছি, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া প্রতিপক্ষের শক্তি ও দুর্বলতার বিচারে কোন ফর্মেশন সবচেয়ে কার্যকরী, সেটা ঠিক করাও একটা বড় কাজ। তিন পয়েন্ট পেতে গেলে এই কাজটা ঠিকমতো করতে হবে আমাদের।”
এসসি ইস্টবেঙ্গল যেমন গোলের জন্য মাত্র কয়েকজনের (৪) দিকে তাকিয়ে থাকে, কিবুর দলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিন্তু সে রকম নয়। তাঁর দলে আটজন গোলদাতা রয়েছেন। মারে (৫) ও হুপারই (২) অবশ্য সবার ওপরে। জামশেদপুরের বিরুদ্ধে এই দু’জনকে সামনে রেখেই দল সাজিয়েছিলেন কিবু। শুক্রবারের ম্যাচেও হয়তো এই একই ফর্মেশনে খেলবেন তাঁরা। তাই এসসি ইস্টবেঙ্গল শিবিরে এই দু’জনকে আটকানোর নীল নকশা নিশ্চয়ই তৈরি।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584